৫১ ( শেষ পর্ব)
পতেঙ্গা বীচে দাঁড়িয়ে দূরে নোঙর করা জাহাজগুলোকে দেখছিল অরণ্য।
অহনা কয়েকবার ওর হাত ধরে টানলেও পানিতে যায়নি অরণ্য। কিছু মুহূর্ত নিঝুমের জন্য তোলা থাক। ভীষন ঠান্ডা লাগছে বলে অহনাকে এড়িয়েছে অরণ্য কিন্ত আসলে ওর খুব
বোর লাগছে। অহনার ন্যাকামি দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে একটা ধাক্কা দিয়ে অহনাকে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেয়। রাইসুলকে খুঁজে পেতে অহনাকে না লাগলে এই কাজটা বোধহয় অরণ্য সবার আগে করতো... হুহ।
মানুষ আসলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেনা। অহনা না হয়ে সঙ্গী নিঝুম হলে অরণ্য নিশ্চিত এতোক্ষনে ওই বিশাল জলরাশির প্রাচুর্যের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেত। আবার ওর জায়গায় অয়ন হলেও হয়তো এই মুহূর্তে আনন্দে ভাসত কিন্তু ওর ভীষন বাজে লাগছে অহনার সাথে সময় কাটাতে। কখন যে মেজরের মেসেজটা আসবে।
ঠিক তখনই টিং শব্দ করে একটা মেসেজ আসল অরণ্যর ফোনে। মেসেজটা দেখতেই শরীরে একটা শিহরন বয়ে গেল অরণ্যর। শেষ পর্যন্ত ওরা তাহলে যাচ্ছে। মেজর মশিউরের ম্যাসেজে ওর জন্য বিশেষ কিছু নির্দেশনা দেয়া আছে। বিশেষ কিছু অস্ত্র ওর জন্য রাখা হয়েছে। সেগুলো ওখান থেকে সংগ্রহ করে ওকে অহনাকে নিয়ে বের হতে হবে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সাথে ওর জন্য একটা রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে ওর পিলো কাভারের ভিতরেই। যেহেতু ওদের প্ল্যান এ বাতিল হয়েছে তাই পুরো পথটাই অরণ্য, অহনার সাথে যাবে। এখন অহনা যদি ওই টানেলটাই ব্যবহার করে তবে অরণ্য একটা সিগন্যাল দিবে আর যদি ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঢোকে তবে দুটো। যদি কোন কারনে মোবাইল নেটওয়ার্ক ডাউন থাকে সেক্ষেত্রে হাই কাভারেজের জন্য আলাদা ফোন রাখা হয়েছে ওর অস্ত্রের সাথে। তবে এগুলো যেহেতু বিশেষ একটা চেহারার হয়ে থাকে তাই অহনার সামনে ওটা ব্যবহার না করতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওকে, আর করলেও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। কারন এই হাসতে থাকা অহনাই প্রয়োজনে ওকে ভয়নক আক্রমন করে বসতে পারে। রাইসুল ওর নিজের লোকদের বাইরের দেশ থেকে ট্রেইনার এনে ট্রেনিং দেওয়ায়। অহনারও সেই হিসেবে যথেষ্ট ট্রেনিং আছে ধরে নেয়া হচ্ছে।
অরণ্য একরকম জোর করেই অহনাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অহনা বেশ চটলো অয়নের উপর। আজ ও পুরো দিনটাই ঘুরতে চেয়েছিল অয়নের সাথে । আসলে রাইসুলকে কিভাবে ফেস করবে অহনা বুঝতে পারছেনা। হাজার হলেও অয়ন, অরণ্যর ভাই। কিন্তু অহনার দিকটাও তো ভাইয়ের বোঝা উচিত। শেষ পর্যন্ত দ্বিধায় দুলতে দুলতেই ওরা রওনা হলো রাইসুলের ডেরার উদ্দেশ্যে।
নিঝুমের খুব গলা শুকিয়ে গেছে। হাত, পা কেমন অবশ অবশ হয়ে আসছে। একটু আগে এক মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডের একটা কল এসেছিল অরণ্যর কাছ থেকে... বললো, এই নাম্বার থেকে ওটা ওর শেষ কল। নিঝুমের সিমটাও খুলে নষ্ট করে ফেলতে বলেছে। অরণ্য মিশন থেকে ব্যাক করলে ওকে ল্যান্ড লাইনে কল করবে। নিঝুম কেবল জড় পদার্থের মতো কথাগুলো শুনেছে। কী বলবে, কী বলা উচিত ওর মাথায় আসেনি। এমনকি যখন অরণ্য ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল তখনও না। আচ্ছা অরণ্য কী কাঁদছিল? নিঝুম কেন কোন কিছুই মনে করতে পারছেনা। সব কেমন সাইলেন্ট হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য, থমকে গিয়েছিল। যেন সত্যি নয় মুহূর্তগুলো। মনে হচ্ছিল ও টিকেট কেটে সিনেমা হলে ঢুকেছিল... তাই স্ক্রীনের বাইরের সবটাই ছিল ঘন অন্ধকারে ঢাকা।
উঁচু হয়ে থাকা পেটে হাত বুলাতে বুলাতে নিঝুম বিরবির করে বলতে লাগল,"তোর বাবাইটা না খুব বোকা। ও ঠিক কাল অহনার সাথে কোন একটা জায়গায় খেয়েছে। আর সেই জন্য কাল থেকে সে যখনই কথা বলেছে আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। আমিতো জানি সে কাজে গিয়েছে। তুই ওকে বলতো যে এসব ভেবে যেন আর কষ্ট না পায়। ও সুস্থভাবে ফিরলেই হবে, আর আমাদের কিচ্ছু চাওয়ার নেই... তাই নারে সোনা।"
অরণ্য বুঝতে পারছে অহনা ওই গোপন সুড়ঙ্গের রাস্তাটাই এবার ধরবে। রঞ্জুর নামে লাইসেন্স দেখানো ভাড়ার ফোর হুইলার গাড়িটা এখন অহনার দখলে আর মেয়েটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাহাড়ের আঁকাবাকা উঁচু- নিচু পথ ধরে ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছুটে চলেছে। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে ওর গাড়ি ঘোরানোর বহর দেখে অরণ্যর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে অহনা একজন পাকা খেলোয়ার। এই মেয়েকে কোন মতেই এলেবেলে ভাবার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে সে মুহুর্তের মধ্যে দানবী হয়ে উঠবে। অহনা প্রায়ই রাইসুলের সাথে কথা বলছে আর বিভিন্ন জায়গার নাম উচ্চারন করছে। নামগুলো অরণ্যর ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে এরই মধ্যে...খুব পরিচিত । তাছাড়া গুগল ম্যাপেও ওদের যাত্রাপথটা সেদিকেই নির্দেশ করছে।
নিজের ইমেজ পরিস্কার রাখতে অরণ্য আরো একটু অভিনয়ের আশ্রয় নিল। ওদের রাস্তাটা ততক্ষনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক চলাচলের রাস্তা থেকে দূরে সরতে শুরু করেছে। যেদিকে চোখ যায় কেবল ছোট বড়ো পাহাড়। অরণ্য চোখে মুখে অপার বিস্ময় আর সেই সাথে ভীষন আনন্দের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলে অহনাকে বলতে লাগল, এরকম ভয়নক রাস্তায় ওর মতো মেয়ে দক্ষতার সাথে চালিয়ে যেতে পারে, এ যে কল্পনারও অতীত। অহনাকে নিয়ে ওর ভীষন গর্ব হচ্ছে।
অরণ্য লক্ষ্য করলো অহনার চোখ মুখ খুশিতে ঝলকাচ্ছে। মেয়েটা ওর মিষ্টি কথার জালে আটকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা বহাল থাকলে রাইসুলকে পাকড়াও করা ওদের জন্য তুলনামূলক সহজ হবে। মেজর বলেছে রাইসুলকে একদমই সাবধান হতে দেয়া যাবেনা। এমন কোন কাজ করা চলবে না যাতে রাইসুলের মনে এক ফোঁটা সন্দেহ হয়। অরণ্যকে তাই অয়নের চাইতেও শতভাগ অয়ন হয়ে দেখাতে হবে। ওর মূল কাজ মেজরকে রাইসুলের ডেরার সন্ধান দেয়া। বাকি রইল বিড়ালের গলায় ঘন্টা পড়ানো... সেই দায়িত্ব মেজর মশিউরের।
কিন্তু তবু অরণ্য পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
থেকে থেকে সূক্ষ্ম কাপড়ের ভাঁজে শরীরের সাথে লেগে থাকা অস্ত্রগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে মন চাইছে।
ওই সুড়ঙ্গের ভিতরে রাইসুল বাহিনীর সিকিউরিটির ব্যবস্থা কেমন ওরা শতভাগ জানার সুযোগ পায়নি। আসলে ওরা রাইসুলকে ওর চ্যালা-চামুন্ডাসহ... একদম ওর ডেরায় গিয়ে ধরতে চায়। আর সুড়ঙ্গের ভিতর অহেতুক মানুষের ঘোরাঘুরি চোখে পড়লে রাইসুল সতর্ক হয়ে উঠতে পারে। লোক দিয়ে তাই দূর থেকে কেবল সুরঙ্গের প্রবেশমুখের দিকেই কড়া নজর রাখা হয়েছে।
তবে প্রয়োজনে এই সুড়ঙ্গের ভিতরে লড়াই করতে হতে পারে অরণ্যকে আর তার জন্য অরণ্যর ভারী অস্ত্রের প্রয়োজন হবে। সেই হিসেব করে গাড়িতে বেশ কিছু অস্ত্র ওর জন্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এছাড়া বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অরণ্যর অস্ত্রগুলো ওর শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকানোর জন্য বিশেষ পোশাক ওকে দেয়া হয়েছে। মেজর
মশিউর যে সব দিক থেকে একজন যোগ্য দলনেতা সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হলো অরণ্য। লোকটা অসম্ভব চতুর আর দক্ষ। ওরা বাসায় ঢোকার আগেই গ্রুপের বাকি সবাই ওদের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। আর অরণ্য অহনাকে নিয়ে একটা ভাড়ার গাড়িতে করে যাচ্ছে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে... কী ভীষন বিয়ে পাগলা রে!
মাঝরাস্তায় টয়লেটের অজুহাতে একটা ঝুপরি দোকানের পিছনে গিয়ে মশিউরকে সিগন্যাল পাঠালো অরণ্য। এরপর পর পর দুকাপ রং চা খেল। নার্ভকে আজ খুব শান্ত রাখা প্রয়োজন ওর, পরিকল্পনার বাইরে একটু এদিক ওদিক হলেই নিঝুমকে আরেকবার দেখার সুযোগ অরণ্যর আর হবেনা।
পাখির কূজন আর সবুজের সামরোহকে সঙ্গী করে আবারো গাড়ি ছোটাল অহনা। দূরে সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের নীরবতা... আর হঠাত হঠাত ঝর্নার চপল উচ্ছাস, অরণ্যর মনে হলো ওই মূক পাহাড়গুলো নীরবে আজ ওর রোমহর্ষক পথচলা দেখছে। ওরাই যেন আজ ওর প্রকৃত সাথী। সেই কোন জনম জনম ধরে ওরই অপেক্ষায় ছিল এতকাল বিনা শর্তে, বিনা আড়ম্বরে।
.................................
মশিউর যখন সুড়ঙ্গটার ভিতরে ঢুকল ততক্ষণে ভীষনাকারে আতশবাজির মতো বুলেট ছোটা শুরু হয়ে গেছে। প্রায় বিশ মিনিট পর শান্ত হয়ে আসল চারদিক। কে যে জখম হলো বোঝা মুশকিল। অন্য সময় এখানে হালকা কিছু বাতি জ্বলে, গোলাগুলিতে তার অনেক গুলোই নষ্ট হয়ে গেছে। ভিতরে প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। পার্থকে আপাতত এখানকার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সামনে এগুলো মশিউর। সুড়ঙ্গমুখে আসতেই আরো দুটো গার্ডকে ধরাশায়ী করল সে, দেখল সুরঙ্গের এ পাশটা ঐ পাশের মতো ততটা নীরব নয়। বেশ কিছু চেয়ার বসান আছে। তার এক পাশে ছোট একটা গুদাম ঘর... খুব সম্ভবত গার্ডদের বিশ্রামের কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘরটা।
ঘরের একপাশে রঙচটা একটা পিকআপ নজরে এলো মশিউরের। খানিকটা খোঁজাখুঁজির পর একজন গার্ডের পকেট থেকে তার চাবির হদিশ মিলল। চাবি ঢুকাতেই সানন্দে সচল হওয়ার সংকেত দিতে লাগল গাড়িটা, মশিউর আনন্দে হেসে ফেলল। গাড়িটা না পেলে দুপায়ের উপর ভরসা করেই এগুতে হতো তাকে। গাড়িটা ওর অনেক সময় বাঁচিয়ে দিল।
অরণ্যর জুতা ও টাই পিনের সাথে ইনডিকেটর চিপ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ মশিউর ল্যাপটপ ওপেন করে পাসওয়ার্ড দিতেই সেটা কানেক্ট হয়ে গেল ওগুলার সাথে। অরণ্যর কাছ থেকে আসা সিগন্যাল গুলো ওকে জানাতে লাগল যে, ওরা এখনো চলছে।
মশিউর যখন গন্তব্যে পৌছাল অর্ধেক আকাশে তখন সন্ধ্যার লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলোটার গেটের সামনে চারটে গার্ড এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর হাসাহাসি করছে। নানা কায়দায় একজন একজন করে তাদের ঘায়েল করল মশিউর। অরণ্য এখন কী অবস্থায় আছে সেটা ভিতরে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝার কোন উপায় নেই কিন্তু তারপরও গাঢ় অন্ধকারে কিছুক্ষন গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করলো মশিউর।
মিষ্টি একটা মুখ ভেসে উঠছে ওর স্মৃতির মনি কোঠায়। এই রাইসুল ওর সাজানো সংসারটাকে মশিউরের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। ভীষন সুন্দরী ছিল বউটা, রাইসুলের চোখ কিভাবে যে ওর উপর পড়েছিল জানেনা মশিউর। মশিউরের পোস্টিং তখন সাভার ক্যান্টনমেন্টে । বাবার বাড়ি ঢাকাতে হওয়ায় ঘনঘন বাবার বাড়ি যেত মিশুর মা। একদিন হঠাৎ খবর পেল কারা ওকে তুলে নিয়ে গেছে। খবর পেয়ে উদ্ধার করতে পেরেছিল কেবল স্ত্রীর লাশটা। এরপর থেকে রাইসুলকে হন্য হয়ে খুঁজেছে মশিউর। একবার প্রায় ধরেও ফেলেছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে ওর হাত ফসকে বের হয়ে গিয়েছে রাইসুল।
রাইসুল অনেকগুলো ছদ্মনাম ব্যবহার করে।তারমধ্যে রাইসুলটা জনপ্রিয়। ওর আসল নাম যে কোনটা বোঝা মুশকিল।
একপাশে একটা থলে মতো ব্যাগ নিয়ে বুকের সামনে রাখল মশিউর ৷ তাতে গ্রেনেড ভরল।নিজের ব্যবহারের ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটাকে পকেটে ভরল। আরেকহাতে সাইলেন্সর লাগানো হেকলার অ্যান্ড কচ রাইফেলটা তুলে নিল।
যাওয়ার পথে একজন দুজন করে আরো কিছু রক্ষীকে খতম করলো মশিউর। এরপর এক রকম হেলতে দুলতে দুলতে বাসার মালিকের ডেরায় গিয়ে পৌছাল। মশিউরকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল রাইসুল। আশেপাশে তখন দু,চারটে গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই।
এরকম রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে বিনা দাওয়াতে ওর সামনে কেউ হাজির হতে পারে এটা রাইসুলের জন্য অকল্পনীয় ব্যাপার। ঘরে ঢুকেই রাইসুলের বাকি রক্ষীগুলোকে শেষ করল মশিউর। এরপর রাইসুলের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো শিকারীর মতো।
অরণ্য আর অহনাও তখন ওখানেই বসা। মুখচোরা প্রেমিক অয়নের বেশে অরণ্য তখনও রাইসুলের সামনে ভয়ে খাবি খাচ্ছে... যদিও অহনার অলক্ষ্যেই সুরঙ্গের ভিতরের পাহারা কতোটা জোরদার মেজরকে জানিয়েছে ও।
মশিউরকে দেখেই অরণ্যর চোখের তারাদুটো জ্বল জ্বল করে উঠলো। ফাইনালি ওর খোলস পাল্টানোর সময় এসে গেছে। এই ভীতু গোবেচারা ইমেজ ধরে রাখতে রাখতে ভিতরে ভিতরে ভীষন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল ও।
অরণ্য রহমানের ভাই অয়ন আর মেজর মশিউর একই সাথে ওর ডেরায়! দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাল রাইসুল... তারপর প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়লো অহনার উপর, " শেষ পর্যন্ত তাহলে তুই বিশ্বাস ঘাতকতাটা করেই ফেললি?"
"বিশ্বাস করো ভাই আমি কিছু জানিনা।"
কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু বলার সময় অহনা পেল না। তার আগেই রাইসুলের পিস্তল থেকে বের হয়ে আসা বুলেটের আঘাতে মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেল ওর নিস্তেজ দেহটা। পর পর দুটো গুলি ছুড়েছে রাইসুল অহনাকে লক্ষ্য করে।
এর পরই মশিউরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে গেলে ভীষন একটা ধাক্কায় হাতের কব্জিসহ উড়ে গেল রাইসুলের। বোকা ভোলাভালা চেহারার আড়াল থেকে ততক্ষণে বের হয়ে এসেছে অরণ্য।
"গুড জব অরণ্য। "
মশিউরের কথায় যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকা রাইসুল বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল অয়ন নামের অরণ্যর দিকে।
"তুই অরণ্য?" ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে জানতে চাইল রাইসুল।
" হুমম... তোকে দেখার বড্ড শখ ছিল। তোকে না দেখে মরি কী করে বল? "
"শখটা মিটেছে?"
ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠল রাইসুল। গলায় যতোটা সম্ভব তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে গেল," এবার তোর খাতিরদারি কিভাবে করি দেখ। ভাইকে মরতে দেখে শান্তি হয়নি যে এখন নিজের জান নিয়ে হাজির হয়েছিস?"
আদতে মশিউর আর অরণ্য ওর নিরাপত্তার কঠিন বলয় পার করে ভিতরে ঢুকতে পেরেছে... এটা বিশ্বাস করতেই রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে রাইসুলের। অহনাকে বিশ্বাস করাটা এতো বড়ো বোকামী হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি ও। কথায় আছে পচা শামুকে পা কাটে... রাইসুলের আজ সেই দশা। এতো অস্ত্র, এতো ক্ষমতা কিছুই ওর কাজে লাগবেনা! শেষকালে এভাবে চুনোপুঁটির মতো মরতে হবে ওকে?
"তোকে নিজের হাতে শেষ করব কু** বা* তারপর আমার শান্তি হবে," দাঁতে দাঁত ঘষল অরণ্য। ভিতরটা আবেগে পাগল হয়ে গেছে ওর।
জবাবে হা হা করে হাসল রাইসুল। এরপর চোখের পলকে অক্ষত হাতটি দিয়েই গুলি করে বসল অরণ্যর বুক বরাবর।
অরণ্যর মনে হলো প্রচন্ড ধাক্কায় উড়ে গিয়ে একপাশের দেয়ালের উপর পড়ল ও। পর পর কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো ওর, বিশ্রী রকম এক ধাতব গন্ধে ভরে উঠল ঘরটা।
"অরণ্য আপনি ঠিক আছেন?"
মশিউরকে প্রশ্ন করতে শুনল অরণ্য।
" স্যার "
ধুলোবালি ঝারতে ঝারতে উঠে দাঁড়াল অরণ্য। রাইসুল গুলি ছোড়ার সাথে সাথেই মশিউরের রাইফেলও গর্জে উঠেছিল। রাইসুলের ছোড়া গুলিটা তাই ফসকে অন্যদিকে চলে গিয়েছে।
"হারা*টা বহুত ডেঞ্জারাস ছিল।"
"সে আর বলতে।"
দুজনেই ওরা সময় নিয়ে পরীক্ষা করল আসলেই রাইসুল মরেছে কিনা। এরপর বাকি মৃতদেহ গুলো চেক করলো। পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখে যখন দেখলো কেউ বেঁচে নেই তখন সিসি টিভির ফুটেজ গুলো আগে নষ্ট করল ,তারপর ক্যামেরাগুলো পুড়িয়ে দিল ওরা। এরপর রাইসুলের সাজানো নরকটায় অগ্নিকাণ্ড ঘটাল।
একটু পরে দমকল বাহিনীর লোক রওনা হবে... কিন্তু ততক্ষনে সেখানে খুঁজে পাওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা সব পুড়ে শেষ।
পিছনের লেলিহান শিখাকে অগ্রাহ্য করে ওরা যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন দুজনের চোখে অনেকদিনের জমানো কান্না বিরামহীন ভাবে ঝরে পড়ছে, অথচ দুজনের কেউই সেটা মোছার চেষ্টা করলনা।
...................................................
"হ্যালো.... "
নিঝুম কানে ফোন চেপে কেঁদে ফেলল। ওপাশ থেকে যে স্বর ও শুনতে পাচ্ছে সেটা কী আসলেই অরণ্যর! সত্যি অরণ্য কথা বলছে না ও এমনি এমনি ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে? গত চব্বিশ ঘন্টায় কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা ও বুঝতে পারছেনা।
"কী রে নিঝুম? ওরকম খালি খালি ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা? "
আসমা বিষন্ন হয়ে জানতে চান। মেয়েটাকে কাল সারাদিন ফোনের কাছ নড়ানো যায়নি। এমন হলেতো যে কোন মুহূর্তে বড়ো কোন বিপদ ঘটে যেতে পারে।
"একটা ফোন আসল যে..."
নিঝুম কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবারো কানে চেপে ধরলো।
"ফোন আসলে কথা বল, অমন হা করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিস কেন?"
"না মানে... মনে হলো অরণ্য।"
আশান্বিত হলেন আসমা, এত রাতে অরণ্য! আশায় চকচক করে উঠলো মায়ের দুটো চোখ।
"শুনতো ভালো করে, কী বলে। আমার তো বুক করছে।"
কিন্তু নিঝুমের ভয়কে দূর করে দিয়ে ওপাশ থেকে অরণ্যর ক্লান্ত স্বর ভেসে এলো,"ঝুম দরজা খোল বউ...আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা।"
"মানে! তু.. তুমি কোথায়?"
"বাসার দরজায়,দশ মিনিট ধরে বেল বাজাচ্ছি অথচ কেউ দরজা খুলছে না।"
"আমি.. আমি আসছি।"
"না খবরদার,আম্মুকে আসতে বলো। তুমি তাড়াতাড়ি আসতে যেয়ে আমার ছেলের কিছু হলে তোমার বারটা বাজাব আমি বউ।"
"না আমি একদম আস্তে আস্তে আসছি। "
নিঝুম চেষ্টা করেও টিপে টিপে আসতে পারলনা। আনন্দে তখন ওর বুক কাঁপছে। কালকে দুপুরের দিকেই তো অরণ্য কল করে বলেছিল, আর কথা নাও হতে পারে। আর আজ বলছে দরজার ওপাশে। নিঝুম যখন দরজা খুলল, তখন ওর পুরো মুখে নোনাজলের স্রোত বইছে। অরণ্য যখন ওকে বুকে জড়িয়ে নিল তখন নিঝুমের পুরো মুখটা কান্নায় মাখামাখি।
"উমম.. একি অবস্থা। ফ্যাত ফ্যাত করে কেঁদে কেটে পুরো মুখটা নোনটা বানিয়ে ফেলছে, মনে হচ্ছে করলার বাচ্চাকে খাচ্ছি।"
নিঝুম আসলে কোন কিছু বলার মতো অবস্থাতে নেই। ওর এখন এতো আনন্দ হচ্ছে যে, আজ অরণ্য ওকে বকাবকি করলেও ও কিছু বলবেনা। আজ অরণ্য সত্যি সত্যি ওর কাছে ফিরে এসেছে এটাই যে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।
আসমা বেগম, রায়হান সাহেব নিঝুমের পিছে পিছে এসে অরণ্যকে দেখতে পেয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললেন।
মাকে জড়িয়ে ধরে অরণ্য যখন বলল, আম্মু আমরা অয়নের হত্যাকারীর উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি, আসমা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন।
"শয়তানটাকে আমরা তোমার সামনে নিয়ে আসতাম আম্মু কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওকে মেরে না ফেললে হয়তো আমার বেঁচে ফেরা মুশকিল হয়ে যেত। "
"নারে অরু আমার কাছে তোর জীবনের চেয়ে বড়ো কিছুই নেই। তুই যা করেছিস আমি তাতেই অনেক খুশি বাবা, অনেক খুশি।"
...................................................
"আর কতক্ষণ কাঁদবা ঝুম ?"
অরণ্য, নিঝুমের মাথায় নিজের গালটা কাত করে দিলো। থুতনিটা ব্যাথা হয়ে গেল অরণ্যর কিন্তু তবু নিঝুমের কান্না ফুরায় না।
"মেয়েরা যে সুযোগ পেলেই এতো কাঁদে কেন?"
"আমার কাঁদতে অনেক ভালো লাগছে তাই।"
অরণ্যর বুকের ভিতরে আরো ক্ষানিকটা সেধিয়ে গেল নিঝুম। অরণ্যর গায়ের গন্ধটা বুক ভরে টেনে নিল ও... এই মনকাড়া গন্ধটা পৃথিবীর আর কোন বুকে নেই, কোথাও নেই।
নিঝুমের চোখ মুখে তৃপ্তির আভাস। প্রিয় মানুষটার এভাবে ফিরে আসাটা যে ওকে কতটা স্বস্তি দিচ্ছে, নিঝুম নিজেই এখনো সেটা বিশ্বাস করতে পারছেনা।
অরণ্য আর কিছু বললো না। কাঁদুক পাগলীটা মন ভরে। আসলে কিছু সময় মানুষ নিজেকে হালকা করার জন্য কাঁদে আর অরণ্য চায় মন খারাপের গাড়িটা ওর ঝুমের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকুক।
.................…..........................
"এটা কী হচ্ছে.....? "
"কী হচ্ছে"
"এইযে মা বেটায় এতো আদর সোহাগ চলছে... " অফিস থেকে ফিরে মা ছেলের আহ্লাদ দেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল অরণ্য।
"এটাতো হবারই ছিল তাই না?"
ছেলের নাকের উপর ছোট্ট একটা চুমু খেল নিঝুম।
"তোমার সামনে অন্য একটা ছেলের ঠোঁটে চুমু খাব বলেছিলাম না? খাচ্ছি।"
"খাও, বেশি করে খাও। আমারো দিন আসবে,"
অরণ্য কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে বললো। অফিসের কাপড় পরে আবার ছেলের কাছে আসা অ্যালাও না ওর, নিঝুমের কড়া নিষেধ।
অরণ্যর কথায় খিল খিল করে হেসে ফেলল নিঝুম," আমার আবারো ছেলে হবে।"
"হলে হবে, একসময় না একসময় তো মেয়ে একটা আল্লাহ দিবেই দিবে।"
"হু সেই আশায় বসে থাকো মেয়ের বাপ।"
"ওকে, এখন সিরিয়াস কথা শোন। ছেলের নাম কী সত্যিই অয়ন রাখতে চাও। কাল আকিকার সময় তাহলে বলে দিয়ো আত্মীয় স্বজনকে। "
"নিশ্চই, অয়ন আমাকে তার সবচেয়ে বড়ো উপহার দিয়ে গেছে,আমি সারাজীবন এই নামটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। "
" ধন্যবাদ, অনেকে আবার অনেক ধরনের কুসংস্কার বিশ্বাস করে কিনা।"
"ছি.. অয়ন নাম না রাখলে কী ও আজীবন বাঁচবে? মানুষ মরনশীল, শুধু এটুকু দোয়া রইল যে ওর চাচার মতো অমন অসহায়ের মতো কিছু না হোক। জীবনটা উপভোগ করুক, জীবনে সফল হোক, নিজের স্ত্রী, ছেলে মেয়ে নিয়ে সুন্দর একটা সময় কাটাক।"
"হুমম"
নিঝুমের গালে চট করে একটা আদর দিল অরণ্য।
"এটা কী হলো? "
"এটা আদর। সারাদিন এই নাক বোঁচাটা আমার অর্ধেক আদর খেয়ে ফেলে। এখন আমার ভাগেরটা আমাকে দাও," বলেই অরণ্য ছেলের নাকটা একটু টেনে দেয়। ছেলেটা এতো সুন্দর করে কেন হাসে?
"পেটুক বাবা একটা... নিজের ছোট্ট বাবুর সাথেও বুঝি কেউ পাল্লাপাল্লি করে? "
" আমি করি, আমার আদরের ভাগ আমি কাউকে দিব না বলে রাখলাম,"ছেলে আর বউকে একসাথে বুকের মধ্যে টেনে নেয় অরণ্য
পরদিন সকালে অয়নকে তৈরি করে শাশুড়ির কোলে দিয়ে দিল নিঝুম।
" মামনি আপনার অয়নকে রেডি করে দিয়েছি, আমার কাজ আজকের মতো শেষ। এখন আমি রেডি হবো, আমাকে আর ডাকবেন না। "
আসমা বেগম মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রইলেন। জানেন, তার অয়ন আর ফিরে আসবেনা কখনো , তবু নামটা ডাকতে পেরেই প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছিল মনটা। রায়হান সাহেবকে ডেকে বললেন," দেখো দেখি.... অয়নের থুতনির সাথে তো নাতির থুতনি একদম মিলে যাচ্ছে তাই না? "
"মিলবেই তো... বাপ, চাচা দেখতে একই রকম। "
" তাও তো বটে, একদম মনেই থাকে না আমার ওরা জমজ ছিল।"
হাসতে হাসতে চোখের পানি মুছলেন আসমা।
ঘরের পিছনের জানালার পর্দা সরিয়ে ঝুমারণ্য তখন বৃদ্ধ এক জোড়া অভিজ্ঞ বাবা - মাকে নতুন করে বাবা - মা হওয়ার আনন্দে আনন্দিত হতে দেখছে।
"অসংখ্য ধন্যবাদ ঝুম। তুমি আমার রঙহীন পৃথিবীটাকে অসংখ্য রঙে রাঙিয়ে দিলে, তোমার এ পাওনা আমি কী করে শোধ করব?"
"আমি তো প্রতিদানের আশায় কিছু করিনি অরণ্য। যা করেছি নিজের জন্য করেছি, আমার ভালবাসার মানুষটার জন্য করেছি। তাই আমরা কেউ কারো কাছে ঋনি নই। আমরা আমাদের এই ছোট্ট পরিবারটাকে অনেক ভালোবাসি, সেই ভালোবাসা আমাদের দিয়ে এগুলো করিয়েছে। শুধু অনুরোধ ভবিষ্যতে তোমার দুঃসময়ে যেন পাশে রেখ, আগের মতো লুকোচুরি করোনা... দূরে ঠেলে দিওনা।"
"আদেশ শিরোধার্য ম্যাডামের, আর কোনদিন লুকোচুরি খেলব না, সরি।"
নিঝুমকে এক হাতে জড়িয়ে নিল অরণ্য। নিঝুমের ঠোঁটে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। এই মানুষটা কেমন করে ওর সমস্ত পৃথিবী হয়ে গেল... অথচ এক বছর আগেও ওরা একজন আরেক জনকে চিনতো পর্যন্ত না।
অরণ্যর হঠাৎ কি হলো কে জানে.... নিঝুমের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো, "ঝুমঝুমি ভাল আছ?"
" সমাপ্ত "
*** বিশেষ অংশ ***
"হ্যালো.... শুনতে পাচ্ছেন?"
অনেক কষ্টে চোখের পাতা মেলল অহনা। বুকটা তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে ওর। সামনে অপরিচিত উদ্বিগ্ন একটা মুখ দেখতে পেল ও। শরীরের নিচে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছ, মনে হচ্ছে ইঞ্জিন চালিত কোন নৌকায় শুয়ে আছে ও।
"আমি কোথায়?"
ক্ষীণ স্বরে জানতে চায় অহনা।
"আপনাকে আমরা নদীর কিনারায় আহত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছি। ভাববেন না আমরা দ্রুত আপনাকে কোন হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করছি, ততক্ষন নিজেকে কোনভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।"
চেষ্টা! অহনার বড্ডো হাসি পায়। চেষ্টা তো ওকে করতেই হবে। অয়ন এতো বড়ো বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে ওর সাথে... বেঁচে থাকলে এর শেষ দেখতে হবেনা?
(লুকোচুরি ২ পড়তে চাইলে আমার লেখা বুক লিস্টে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন....... 😊)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro