৪৬
"মন খারাপ? "
"নাহ... " নিঝুম হাসল। আজ ফাহিম ভাই আর আশু ঢাকায় চলে গেল। সকাল সকাল ওদের নাস্তা খাইয়ে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছে ও আর অরণ্য। নাস্তায় পাতলা আটার রুটির সাথে আলুর দম, ডিম ভাজি আর সুজির হালুয়া ছিল।
ব্যাস অরণ্য বাবুর মেজাজ ঠান্ডা.... সুজির হালুয়া এত পছন্দ তার, কেন কে জানে? অবশ্য ফাহিম ভাই চলে যাচ্ছে এটাও অরণ্যর একটা বড়ো স্বস্তির কারন, কিন্তু এখন থাকলেও বা কী এসে যেত। ফাহিম ভাই একেবারে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছে আশুকে আর তাও একেবারে সাথে করে নিয়ে যাবার প্রস্তাব। এখন আশুর আপত্তি থাকলে আলাদা কথা ছিল কিন্তু ও তো একেবারে আনন্দে আত্মহারা, পারলে আজই বিয়ে করে।
নিঝুমও আসলে আনন্দটা চেপে রাখতে পারছেনা কিন্তু কেমন ভয় ভয়ও হচ্ছে। আম্মু- আব্বু রাজি হবে কিনা বুঝতে পারছেনা নিঝুম। আশু এখনও ছোট বিয়ের জন্য আর সবাই এটা না মনে করে যে ওই আশুকে এইসব উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দিয়েছে। বড়ো ফুপিকে ভীষন ভয় করে ওর, ওনার মুখের কোন লাগাম নেই আর ওর সাথের এই হাড় বজ্জাত লোকটা... কিছু কলকাঠিতো পিছনে নেড়েছে শিওর।
"তাহলে? " অরণ্য পেছন থেকে নিঝুমকে আকড়ে ধরল দুহাত দিয়ে।
থুতনিটা নিঝুমের কাঁধের উপর রেখে দূরের ছোট ছোট টিলাগুলো দেখছিল অরণ্য। চারপাশ এতো সবুজ যে, প্রতিটা নিঃশ্বাসকে একদম বিশুদ্ধ মনে হচ্ছে ওর। মানুষ আসলেই অদ্ভুত একটা প্রানী.... যান্ত্রিকতা ভাল লাগে না আর যন্ত্র ছাড়া থাকতেও পারেনা। কোলাহল ভালো লাগেনা, কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই ওই সিএনজি আর ধোঁয়া উঠা বাসের শব্দ শোনার নেশা জাগে, কথাটা ভেবে একাই হো হো করে হেসে ফেলে অরন্য।
আসলে এখানে যতই ভাল লাগুক না কেন আবার সেই যান্ত্রিক শহরেই ফিরে যাবার জন্য দুদিন পর মন টানতে থাকবে। ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর আকর্ষন তখন এই মেঘ ছুঁয়ে থাকা পাহাড়গুলোকেও বুঝি হার মানায়।
"খুব চিন্তা হচ্ছিল জানো... তুমি যখন বললে যে আশু ফাহিম ভাইকে পছন্দ করে তখন থেকে নিজেকে কী রকম অপরাধী মনে হচ্ছিল। কিন্তু আজ খুব শান্তি লাগছে, নির্ভার লাগছে।"
"এটাতো খুব ভালো যে শেষ পর্যন্ত ওই বইপোকাটা মুখ তুলে কিছু দেখতে পেয়েছে, হাঁদারাম একটা। চোখের সামনে এতো সুন্দর একটা অবিবাহিত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পন্ডিতের বাচ্চা ডুবে ডুবে পাশের বাড়ির বউয়ের আঁচল খুজছে.... ছাগল।"
"অরণ্য প্লিজ তুমি এই কথায় কথায় আমার ভাইকে গালাগাল করবে না। তার মতো পড়ুয়া লোক আমি খুব কম দেখেছি... আর উনি ডাক্তার হিসেবে খুব ভাল। "
"আরে আমি কী খারাপ বলেছি নাকি?"
"মাত্রই হাঁদারাম, ছাগল বলেছ।"
"ওহ ওটা তো আমার ছোট শালীকে বিয়ে করবে তাই আদর করে বলেছি, ভবিষ্যতে আরও বলব। ফাহিম তুই আস্ত একটা বলদ। "
নিঝুম এবার আর হাসি চাপতে পারলনা। এই লোক জন্মেও শুধরাবে না। কী বিশ্রী বিশ্রী গালি দেয়।
"আচ্ছা এবার বলো তোমার কেন অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে, ফাহিম কী আশুর রেজিষ্ট্রেশন করা মা* নাকি? এমনকি তুমি যদি ফাহিমকে বিয়েও করতে সেটাও অযৌক্তিক ছিল না আমার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর।"
অরণ্যর কথায় এবার নিঝুমের মেজাজটা খারাপ হলো। দুম দুম দুটো কিল বসিয়ে দিল ও অরণ্যর হাতে। এখন যখন তখন এসব কথা বলে অরণ্য... ভীষন রাগ হয় নিঝুমের। সরতে না পেরে কিল দুটো হজম করতে হলো অরণ্যকে।
"আমি ওনাকে বিয়ে করতাম না কক্ষনো। আমি ওনাকে সেই চোখে দেখিনি কোনদিন। "
নিঝুমের চোখদুটো চিক চিক করছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি শিশিরকণাগুলো ওর গাল বেয়ে ঝরে পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি হাতটা বাড়িয়ে দিল অরণ্য নিঝুমের চোখের নিচে। সাথে সাথেই টুপ করে এক ফোঁটা চোখের পানি অরণ্যর হাতের উপর এসে পড়ল।
"মোস্ট ভ্যালুয়েবল থিঙ্ক ইন মাই ওয়ার্ল্ড," অরণ্য চোখের সামনে নিয়ে পানির ফোঁটাটা দেখল কিছুক্ষণ। এরপর আস্তে করে নিঝুমের কোমরের কাছটা ধরে টেনে আনল নিজের কাছে। বাচ্চাটা বোধহয় এখন দ্রুত খেয়েদেয়ে বড়ো হচ্ছে... পেটটা বেশ উঁচু হয়ে এসেছে নিঝুমের।
কী আজব বাচ্চাটা ওদের মাঝে আছে আবার নেই, কেমন লুকোচুরি খেলছে ওদের সাথে। আর এই অদেখা মানুষটার জন্য ওদের দুজনের বুকে কত ভালোবাসা জমে গেছে। অরণ্য নিঝুমের পেটের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। বাচ্চাটা ওদের কত তাড়াতাড়ি নতুন এক সম্পর্কে জুড়ে দিল। এই ছোট্ট পোটলাটার জন্য ওদের এখন কত হিসেব করে চলতে হয়, তারপরও ওরা ওকে কত ভালেবাসে। সব ভালয় ভালয় হলে সামনের বছর এই সময় ওর আঙুলটা ধরতে শিখে যাবে বাচ্চাটা। হয়তো বাবা ডাকাও শুরু করবে।
"অ্যাই তুমি হাসছ কেন একা একা ? তোমার কী মনে হচ্ছে আমি নিজেকে এখন তোমার চোখে ভাল দেখানের চেষ্টা করছি? তাই কান্নার নাটক করছি?"
"না..... তুমি অপচেষ্টা করছ আর নাটক করাও এতো সহজ নারে বউ, আমি কয়দিন করে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।"
"মানে? "
"মানে... তুমি দোষী নও তারপরও আমার সামনে সাফাই কেন দিচ্ছ ঝুম । অতি ভক্তি চোরের লক্ষন জান না? আমি জানি তুমি ফাহিমের প্রতি দুর্বল নও। দুর্বল আমি... কারন অপরাধ আমি করেছি তোমার কাছে, তাই সারাক্ষণ হারানোর ভয় হয়। আর এখন তোমাকে ছাড়া আমার জীবনে আনন্দের আর আলাদা কোন রঙ নেই। আমার চারদিকে লাল,নীল, হলুদ, গোলাি যত সুন্দর রঙ দেখ সবগুলো মিলেমিশে তুমি। "
অরণ্যর অকপট স্বীকারোক্তিতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল নিঝুমের। স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, কিন্তু অরণ্য যখন দোষ স্বীকার করে তখনও কেন যেন ওর খুব কষ্ট হয়। ভালবাসার এত কঠিন কঠিন ধাপগুলোর সাথে একেবারেই পরিচয় ছিল না নিঝুমের কোনকালে আর এখন সেই অনুভূতিগুলো বাধ ভেঙে হুড়মুড় করে এসে একেবারে তান্ডব শুরু করে দিয়েছে ওর সাধাসিধে জীবনে।
"তুমি অরণ্য নামের মানুষটার বুকে একফালি সূর্য ঝুম.... খটখটে মরুর বুকে স্নিগ্ধ মরুদ্যানের মতো, তোমার প্রতিটা হাসি, প্রতিটা কান্না আমাকে ভীষন দুর্বল করে দেয়। তোমার প্রতিটা আচরনে আমি আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি।
তুমি কি জানো ঝুম...... তোমাকে ছাড়া আমি কী ভীষন একা? আর এই একা পথ চলতে আমার ভয় করে, ভীষন ভয় করে। তাই কোনভাবেই আমি তোমার হাতদুটো ছাড়ব না, কক্ষনও ছাড়ব না যতক্ষন মৃত্যু না আসে।"
অরণ্যর কথাগুলো কেমন বাতাসে ভর করে নিঝুমের কানে এসে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। থেমে থেমে বলতে লাগল ভয় করে, ভীষন ভয় করে। কিন্তু মৃত্যু সবকিছুকে আলাদা করে দেয়, হুট করে অয়নের কথা মনে পড়ে গেল নিঝুমের।
নিঝুম সর্বশক্তি দিয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কেমন যেন সুখের কান্না পাচ্ছে কথাগুলো শোনার পর থেকে। অরণ্যকে ও একদমই দুঃখ পেতে দিতে চায়না, একদমই না। ও আর ওদের বাবুইটা একসাথে এই লোকটাকে সমস্ত দুঃখ থেকে আগলে রাখবে, একটুও কষ্ট পেতে দিবে না।
দূরে গাঢ় সবুজ পাহাড়ের দলগুলো তখন হাতছানি দিয়ে আয় আয় করে ডাকছে ওদের। নিঝুম অরণ্যর বুকে মাথা ঠেকিয়ে সেই ডাক শুনতে লাগল। কালই ওর মনে হচ্ছিল কী বিশ্রী জীবন ওর...একটুও শান্তি নাই কোথাও আর এখনই মনে হচ্ছে ওর সব শান্তি এই লোকটার কাছেই আছে, শুধু ওকে মন থেকে চাইতে হবে।
"ঝুম ঘরে চল, এখানে বেশ ঠান্ডা লাগছে। "
"কিন্তু আমার তো খুব ভাল লাগছে।"
"ঘরেও ভাল লাগবে চল এক্ষুনি," অরণ্য সত্যি এবার একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করল। বাতাসে শীতের আমেজ আর এই বাতাস গায়ে লাগলে ঠান্ডা লাগার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে নিঝুমের। আর এই অবস্থায় ঠান্ডা লাগলে ওষুধ খাওয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা। এক রকম ধরে বেঁধে নিঝুমকে ঘরে নিয়ে আসল অরণ্য।
আসলে মেজাজ ওর কাল ভয়ংকর রকম খারাপই হয়েছিল ঝুমের কথায়। ও রকম একটা নোংরা কথা কী করে ওকে বলল ঝুম। ঝুমকে ওর অনেক ভালো লেগেছে বলেই না, অয়নের কাছে ছবি দেখে পরদিনই ওর পিছনে ছুটেছে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। আর সেই ঝুমই কিনা বলে ও ওই নোংরা একটা পরিকল্পনা করেছে ওকে বিয়ে করার জন্য ! আচ্ছা নিজের হবু বউকে কোন লোক ওরকম করে বিয়ে করে?
রাগে রাতের খাবারও খায়নি অরণ্য। কিন্তু মাঝরাতে ঝুম এমন কান্না শুরু করে দিল যে রেগে ওকে বকতে যাচ্ছিল অরণ্য। কিন্তু নিঝুমের মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ওর। ঝুম ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছিলনা, বসে কেমন জালে আটকে পড়া মাছের মতো খাবি খাচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্য পুরো পৃথিবী একদম থেমে গিয়েছিল অরণ্যর। সেকেন্ডের মধ্যে জমে থাকা অভিমান হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে ফুড়ুৎ করে। ঝুমের জন্য অমন হাজার অপমান কবুল ওর, ভয়ে নিজের দুমদাম বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দনটাও স্পষ্ট গুনতে পারছিল অরণ্য।
একটুপরে একা একাই নিঝুমের শ্বাসকষ্টটা থেমে গেল। ওইটুকু সময় অরণ্য ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। নিঝুম এক একটা শ্বাস টানছিল আর অরণ্যর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল ঝুমও ওকে ছেড়ে অয়নের মতো অনেক দূরে চলে যাবে।
বাকি রাতটা তীর্থের কাকের মতো নিঝুমের হাত ধরে ছিল অরণ্য... ভয়ে। নিঝুমের মুখে কষ্টের ছাপ দেখে ভিতরে ভিতরে কাঁদছিল ও। রাগ করার মতো মনমানসিকতাও আর ছিল না। মনে মনে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিঝুমের সাথে আর কখনোই রাগারাগি করবে না ও। ঝুমের চাইতে প্রিয় ওর জীবনে আর কিছু নাই এখন আর এই সত্যিটা ও খানিক আগে ভাল মতো টের পেয়েছে। মানুষের জীবনে সুখের মুহূর্তগুলো আসলে খুবই ছোট আর অরণ্য এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো দিয়ে নিঝুমের জীবনটা আলোয় আলোয় ভরে দিবে, আর কক্ষনো ওকে কোন দুঃখ পেতে দিবে না। কখনই না।
.......................................................
ফাহিম অবাক হয়ে দেখছিল আশুকে। মেয়েটার চোখদুটো এতো সুন্দর এতোদিন কেন চোখে পড়েনি ওর? আশু কথা বলার সময় চোখ দুটো হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠছে, ফাহিমের খুব ইচ্ছে হচ্ছে চোখ দুটো ছুঁয়ে দিতে ।
কিন্তু এই হঠাৎ পাওয়া অনুভূতি গুলো ফাহিমকে মোটামুটি বিপর্যস্ত করে ফেলছে। নিজের কাছেই কেমন কেমন যেন লাগছে। এতদিন নিঝুমের প্রতি এত তীব্র একটা টান কাজ করছিল সেটার বদলে হঠাৎ আশুর জন্য এত আগ্রহ এটা ঠিক কী ও বুঝে উঠতে পারছেনা। শুধুমাত্র নিঝুম ওকে অবহেলা করেছে সে জন্যই কী ওর মন আশুর প্রতি ঝুকল?
এটা সত্যি নিঝুমকে অরণ্যর জন্য অত বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন করতে দেখলেই প্রতিবার ফাহিমের বুকের ভিতরে রক্তক্ষরন হচ্ছিল । ও একদমই সেটা সহ্য করতে পারছিলনা। কিন্তু কাল বিকেলে কী একটা যেন হলো... পায়ের নিচে ইটের টুকরোতে হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। ঠিক সেই সময় আশু খপ করে ধরে ফেলল ওকে.... আর আশুর মুখটা দেখে বুকটা কেমন হু হু করে উঠল ফাহিমের। কেমন যেন খুব আপন মনে হলো ওর আশুকে অথচ আগে এমনটা কখনোই হয়নি ফাহিমের সাথে।
নিঝুমকে মনে হলেই ওর অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো সময়ের ডাইরি থেকে উঠে এসে চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, আর সেগুলো সবই রঙিন সুতোয় বাঁধা। কিন্তু আশুকে দেখলে কখনই সেরকম কিছু মনে হয়নি ওর।
আশুর জন্য গতকাল বিকেলের আগে বিশেষ কোন অনুভূতি ছিলনা ফাহিমের বুকে ,তবে আজ কেন? এত হুট করে কী ভালেবাসা হয়? ফাহিমের দুশ্চিন্তা হয়।
একা থাকতে থাকতে কী আসলে হাঁপিয়ে গেছ ও?
কিন্তু আশুর ওর প্রতি যত্নশীল আচরনটা আজ এত করে ধরা পড়ছে অথচ কাল বিকেলের আগ পর্যন্ত এগুলো ওর নজরে আসেনি কেন? আশু তো তখনও ওর যত্ন করেছে। ও কেমন করে ডিম সিদ্ধ খায় সেটাও মেয়েটা খেয়াল করে রেখেছে।
আশুকে ফাহিম সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কারন মধ্যামধ্যি ওসব ভালোবাসার সম্পর্কের প্রতি ওর নিজের আর কোন বিশ্বাস নেই। নিঝুমকেও তাই বিয়েই করতে চেয়েছিল। এখনও নিঝুমের প্রতি একটা সূক্ষ্ম অভিমান কাজ করছে ওর, এটাই আশুকে ভালো লাগার কারন নয়তো..... আশুকে সত্যি ও ভালোবাসেতো? নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করে ফাহিম। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর সবকিছু।
"আপনার কী মন আবার খারাপ? " আশুর কথায় অবাক হয় ফাহিম। মেয়েটা কত দিকে খেয়াল করে!
"কেন বলতো? " গলাটা একটু খাকড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করে ফাহিম। মেয়েটা কী ওকে পুরোটাই পড়তে পারে?
"কারন আপনি আপনার নিজের কাজ, চিন্তা ভাবনা, আচরনের কোন মাথা মুন্ডই খুঁজে পাচ্ছেন না... তাই।"
ফাহিম জুতসই উত্তর না পেয়ে চুপ করে থাকে। একটা জিনিস ঠিক... সেটা হলো আশু, নিঝুমের চেয়ে অনেক বেশি চটপটে। ওকে ফাহিমের মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না।
"ফাহিম ভাই আমি জানি আপনি আমাকে ঠিক ভালোবাসেন বলে বিয়ের করতে চাইছেন তা নয়। কিন্তু দেখেন আমি আপনার পছন্দের মানুষটার আদরের বোন। পুরো নিঝুমকে না পেলেও চার ভাগের এক ভাগ সাদৃশ্য তো পাবেনই আমাদের মধ্যে, এটাই বা কম কী... আর আমার কথা ভাববেন না। আমার নিজের উপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে। এসব ছেদো বিষয় নিয়ে গুরুত্ব দেয়ার আমার সময় নেই আর আমি আপনাকে আমার মনমতো গড়ে নিব একসময়, তাই দুশ্চিন্তা করা বাদ দিন। "
আশুর কথায় এক ধরনের স্বস্তি পায় ফাহিম। ওর নিজের অনুভূতি এখনো ঘোলাটে ওর কাছে এটা সত্যি কিন্তু আশু ওকে ভালোবাসে এটা এখন বিশ্বাসে পরিনত হয়েছে ফাহিমের কাছে। এক জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য আর চেয়ে বেশি আর কী লাগে?
"তুমি তো পাগল আছ," হেসে উঠে ফাহিম।
"হুমমম... অনেক বড়ো।"
..............…..........
অরণ্য......
নিঝুমের ডাকে সামনের ল্যাপটপটা সরাতে বাধ্য হলো অরণ্য। নিঝুম আবার উঠে বসে আছে ঘুম ঘুম চোখে । অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ওর আবার । ডাক্তার বলেছে ওরকম হলে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে কিছুটা সময়। এখন বাচ্চাটা রাতে নাড়াচাড়াও করে বেশি। লাথিও দেয় বেশ, নিঝুমের ঘুমের মোটামুটি চৌদ্দটা বাজে এখন।
"কী হলো? আবারো সমস্যা হচ্ছে? " অরণ্য এগিয়ে এসে মাথাটা ধরল নিঝুমের। ঘুমে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
"হু..."
"আচ্ছা বসো আমি আসছি। অরণ্য কাপড় পাল্টে বিছানায় বসে হাতটা বাড়িয়ে দিল নিঝুমের দিকে। বাড়ানো হাতদুটো দেখেই মুহূর্তের মধ্যে অরণ্যর বুকে ঠাঁই নিল নিঝুম। প্রশস্থ বুকে মুখ লুকাল... যেমন মেঘের আড়ালে চাঁদ টুপ করে ডুব দেয়।
নীরবে নিঝুমের মসৃণ চুলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল অরণ্য। মাথায় হালকা এই স্বস্তিকর অনুভূতির জন্য যখন নিঝুমের চোখের পাতায় ঘুম পরীরা এসে ভর করল তখনই দুষ্ট লোকটা ওর কপালে, চোখের পাতায়, নাকের ডগায়, কানে, গোলাপি টুল টুলে দুটো গাল আস্তে আস্তে আদর করতে লাগল।
নিঝুমের মনে হলো ও আকাশের উপরে হাঁটাহাটি করছে চাঁদের দেশে, আর সেই আকাশ থেকে একবার ঘুমের পরীটা আর একবার এই রাজপুত্তুরের বাচ্চাটা.... দুজনেই ওর হাত ধরে টানাটানি করতে করতে ওকে নিচে ফেলে দিবে। তাই শেষ পর্যন্ত ও আর চুপ থাকতে পারলনা। বিড়ালের বাচ্চার মতো দাঁতমুখ খিচিয়ে বলে উঠল, " উহ! সবাই খারাপ,সবাই খারাপ, কেউ একটু ঘুমাতে দিচ্ছে না। পেটেরটাও শত্রুতা করছে।"
অরণ্যও চাচ্ছে নিঝুম একটু আরাম করে ঘুমাক। কিন্তু বুকের মধ্যে এরকম নরম তুলতুলে একটা জিনিস এসে বসে থাকলে ও চুপ থাকে কী করে? তারমধ্যে কী রকম ঠোঁট ফুলিয়ে, দাঁত খিচিয়ে বিরবির করে গালি দিচ্ছে। ওরকম হলে ওকে খোঁচাখুচি না করে অরণ্য ঠান্ডা মেরে বসে থাকেই বা কী করে? ও কী সাধু সন্নাসী নাকি?
.......................................
পার্থ পর পর তিনবার কল করেছে কিন্তু অরণ্যদা একবারও ওর ফোন ধরেনি। কী করবে বুঝতে না পেরে মেজর মশিউরের দিকে তাকাল পার্থ।
এই পুরো অপারেশনের টিম লিডার হিসেবে মেজর মশিউর অত্যন্ত যোগ্য একজন ব্যাক্তি। শান্তি মিশনে প্রতিবারই তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। উনার কমান্ডো ট্রেনিংয়ের পারফরমেন্স খুবই ভাল, এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট, ট্র্যাকিং এ সুনাম আছে আর খুব ভাল একজন স্নাইপার। আড়ালে তাকে" ঈগ্যালস আই "বলে ডাকে অনেকে দুর্গম এলাকায় দক্ষভাবে ট্র্যাকিং এর জন্য। উনার অধীনে কাজ করতে পারবে ভেবে পার্থ ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজনা বোধ করছে।
এই মিশনের জন্য মেজর মশিউর, পার্থ, অরণ্য ছাড়াও আরও সাত জন যোগ্য সদস্যকে নির্ধারন করা হয়েছে আর্মি ও পুলিশ ফোর্স থেকে। কিন্তু মিশন সাকসেসফুল হওয়ার জন্য অহনা নামের মেয়েটাকে ওদের আগে প্রয়োজন, আর এই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হলে অরণ্যদাকে জরুরি ভিত্তিতে লাগবে। কিন্তু অরণ্যদা এখনও ওর ফোন ধরছে না আর কোন কল ব্যাকও করেনি।
"উনি কী একটু দায়িত্বহীন ধরনের? "বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন মেজর মশিউর। এই লোকের কাছ থেকে জরুরি ইনফরমেশন লাগবে ওর আর ওই লোকের কোন খবরই নাই... দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
"না স্যার... আসলে অরণ্যদার মাত্র বিয়ে হয়েছে তো, বৌদিকে নিয়ে একটু বেড়াতে গিয়েছে," শেষ কথাটা একটু মিনমিন করে বলল পার্থ। কথাটা মেজরকে বলা ঠিক হলো কিনা ঠিক বুঝতে পারছেনা পার্থ।
"ওহ... কিন্তু এমন একটা সময় বিয়ে কেন? একমাস পরে করতো, যদিও ব্যাপারটা পার্সোনাল।"
মশিউর উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ করে মিশুর কথা মনে পড়ে গেল আবার, ছেলেটা রাতে গায়ে কাঁথা রাখতে চায় না, কিন্তু এদিকে শীত পড়ে যাচ্ছে।
"না আসলে ওনাদের স্টোরিটা যথেষ্ট প্যাঁচ মারা। নিঝুম বৌদির পেটে বাচ্চা, আর তিনমাস বাকি আছে বোধহয়।"
"ওহ... " মশিউর হাসার চেষ্টা করলেন।
"তাহলে মিস্টার অরণ্য কল ব্যাক করলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে বলবেন দ্রুত, ইটস অ্যান অর্ডার।"
" জি স্যার।"
অরণ্যদা আজ মান ইজ্জত ডুবাবে মনে হচ্ছে মাথা নাড়তে নাড়তে অরণ্যর নাম্বারে আবারো ডায়াল করতে লাগল পার্থ।
.........................................................
উমম... অরণ্য...
হুমম....
"আরে ধুর... কী এক ভাইব্রেশন দিয়ে রাখ, ভো ভো করতে থাকে মাথার কাছে," নিঝুম বিরক্তির সাথে ফোনটা চোখের সামনে তুলে ধরল। কিন্তু সব ঝাপসা দেখছে ও ঘুমে।
"কী? " কয়েকবার চোখ পিট পিট করল অরণ্য। কিন্তু নিঝুমের অনাবৃত শরীর আর বালিশ জুড়ে ছড়ান চুল ছাড়া আর কিছুই ও ঠিকমতো বুঝতে পারেনা।
"তোমার ফোন বাজে।"
"ওহ তো...দেখো না কে?" বিরবির করে বলে আবার বালিশে মুখ গুজল অরণ্য। মাথা পুরো আউলে আছে ওর, দুনিয়াদারি এখন ঘুমের কাছে পরাস্ত।
"আমি জানিনা," বলেই আবার প্রচন্ড ঘুমে তলিয়ে গেল নিঝুম। পাজি লোকটা ওকে আদর করে ভুজুং ভাজুং দিয়ে সেই ছাদনাতলাতেই নিয়ে গেছে। এখন ব্যাথায় নিঝুম শরীর এদিক থেকে ওদিক নিতে পারছেনা.....
অসভ্য, বদমাইস লোক কোথাকার।
হু হু.... করে অরণ্যও আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
বেচারা ফোনটা ওদের দুজনের মধ্যে পড়ে অসহায়ের মতো বাজতে থাকে বার বার।
চলবে........
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro