৩৮
"আচ্ছা ওটা না খেলে, এটা খেতে তো কোন সমস্যা নেই," অরণ্য সব্জির বাটিটা এগিয়ে দিল নিঝুমের দিকে।
কিন্তু নিঝুম অরণ্যর কোন কথারই কোন উত্তর দিচ্ছেনা। সে আগের মতোই একমনে ভাত খেয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে শুধু শুধু ভাত খাওয়ার মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ বুঝি আর হয়না। মনে হচ্ছে ওদের দুজনের মধ্যে কিছুই হয়নি... রাগ, অভিমান কিচ্ছু না। সবকিছু যেন খুব বেশি মাত্রায় ঠিকঠাক। অথচ অরণ্য জানে নীরব অভিমানে বিশ্ব চরাচর ভেসে যাচ্ছে।
সেই সকাল থেকে নিঝুমের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কৈফিয়তের পাহাড় গড়ে তোলার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অরণ্য। কিন্তু ফলাফল যেই লাউ সেই কদু। নিঝুম ওর কৈফিয়ত শোনা দূরে থাক অরণ্যর দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত।
অরণ্য আর কী ভাবে মাফ চাইবে বুঝতে পারছেনা। এত লোক থাকতে নিঝুমের চোখেই ওই নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনাটা পড়া লাগল? এরচেয়ে তো বাবার চোখে পড়লেও মনে হয় ওকে কম লজ্জায় পড়তে হতো... আর বোঝানোও অনেক সহজ ছিল। কিন্তু কথায় আছে না চোরের দশদিন আর গেরস্তের একদিন। আসলে অহনাকে আস্বস্ত করতে গিয়ে একটু অতিরঞ্জিতই হয়ে গিয়েছিল অরণ্যর অভিনয়, কিন্তু অরণ্য চেয়েছিল অহনা যেন ওদের পিছুপিছু শ্রীমঙ্গল অব্দি চলে না আসে... নিঝুমের সাথে এ কটা দিন অয়ন সেজেও নিজেদের মতো কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু ও কী জানত যে ঘটনা সোজা বউয়ের চোখেই পড়বে? ধুর ধুর... জীবন একদম নরক বানিয়ে ফেলল ওর দুই মিনিটের মিথ্যে অভিনয়টা। আর এখন সেই মিথ্যে অভিনয়ের ঠিকঠাক আউটপুট দেখে বউ ওর দিকে তাকাচ্ছেও না, কথাও বলছেনা। এরচেয়ে তো মনে হয় নিঝুমের হাতে দুটো চড় খেলে কম কষ্ট হতো অরণ্যর।
"ঝুম প্লিজ আমার কথাটা শোন একটু.. "
কিন্তু নিঝুম যেন বোবা.. কথাই বলতে জানেনা।
কোনোমতে খাবার শেষ করে দোতলায় নিজের ঘরের দিকে চলল।
"ঝুম তুমি আমার কোন কথাই কেন শুনছ না?
ঝুম!"
"তুমি এত বিশ্রীভাবে চিৎকার করছ কেন?" নিঝুম নাক টেনে টেনে উত্তর দিল। আসলে যতই উল্টো দিকে ঘুরে থাকুক না কেন নিঝুমের কন্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে যে ও নিঃশব্দে কাঁদছে।
ভাল এক শাস্তির ব্যবস্থা হলো অরণ্য তোর। কোনটা রেখে এখন কোনটা করবি? বউয়ের রাগ সামাল দিবি না শত্রু নিধন? মন মেজাজ এমনিতেই সেই রকম হয়ে আছে। মুখোশ খুলেই গেল শেষ পর্যন্ত মাঝখান থেকে অহনা নামের ফাউ ঝামেলাটা উড়ে এসে জুড়ে বসল ওর কাঁধে। ঝুম এখন কতদিন ওর উপর কারফিউ জারি করে নিজের মনের ঝাল মিটাবে আল্লাহ জানে। রাগে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে অরণ্যর, আরও সাবধান থাকা উচিত ছিল ওর। বউটা ওকে এখন আর জড়িয়ে ধরার পারমিশনটাও দিবেনা।
"ঝুম তুমি আমার কোন কথাই কানে তুলছ না কেন? "
"এরকম চিৎকার করলে বাচ্চাটা ভয় পাবে অয়ন, সরি অরণ্য।"
খোঁচাটা গায়ে মাখল না অরণ্য।
" ঝুম তুমি আমার কথাটা মনযোগ দিয়ে একটু শোন প্লিজ। আমি মোটেও তোমার সাথে কোন রকম জোর জোরাজুরি করতে চাচ্ছি না। শুধু অনুরোধ আমার কথাগুলো শান্ত হয়ে একটু শোন।"
"অরণ্য আমি তোমার ভালো মন্দ কোন কথাই শুনতে আগ্রহী নই," নিঝুমের একদমই আগ্রহ হচ্ছে না এই মিথ্যুক লোকটার কথা শুনতে। ঠিক দেখা যাবে ভজিয়ে ভাজিয়ে পাঁচশ হাত লম্বা একটা মিথ্যের ঝুড়ি ওর হাতে ধরিয়ে দিবে আর ও গাধী সেটাই বিশ্বাস করে আবারও প্রতারিত হবে।
"কিন্তু আমি বলতে আগ্রহী আর কথাগুলো তোমাকে এখন শুনতেই হবে। আমি সকাল থেকে তোমাকে কথাগুলো বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছি... করেই যাচ্ছি কিন্তু তুমি সেই এক জেদ আঁকড়ে ধরে বসে আছ যে আমার কোন কথাই তুমি শুনবে না," অরণ্য হতাশার সুরে জানাল। সকাল থেকে সব ছেড়েছুড়ে ও নিঝুমের পিছন পিছনে ফেউয়ের মতো ঘুরছে অথচ বউ ওর সেই এক কথার উপরই অনড় হয়ে আছে। নিঝুম এরকম অবুঝ হলে অরণ্য কার কাছে যাবে?
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। ওর বুকের ভিতরে কী তুফান চলছে সেটা কী অরণ্য বুঝতে পারছে? এই লোক ওকে নিজের খেলার পুতুল মনে করেছে। নিঝুমের ভালো লাগা মন্দ লাগা কিছুতেই আসলে অরণ্যর কিচ্ছু আসে যায় না। আর তাই নির্দ্বিধায় অহনাকে চুমু খেয়েও অরণ্যর মনে হয়নি ও পাপ করেছে, আর সেই পাপ মন থেকে না করলেও তাতে যে শরীরে উত্তেজনা জাগে, শরীর তখন পাপ পূন্যের হিসেব রাখতে ব্যার্থ হয়... এটা অরণ্য তার যুক্তির খাতায় রাখেইনি। অথবা রাখলেও নিঝুম ওর কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, জাস্ট পাস টাইম।
অরণ্য কথা বলতে বলতে হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলল নিঝুমের চোখে চোখ পড়াতে। নিঝুমের চোখের কোল বেয়ে একেবেঁকে নদীর মন্থর একটি ধারা বয়ে চলেছে সীমান্তের তারকাঁটা পেরিয়ে। অরণ্য সেই নদীর নাম জানে না কিন্তু নদীটি ছুঁতে ওর বড়ো ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু অরণ্যর দুর্ভাগ্য ... ছুঁয়ে দেখার সাহসটাই ওর ছিলনা।
"ঝুম প্লিজ বউ, তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়," ফ্যাস ফ্যাসে গলায় কথাটা কোনমতে বলল অরণ্য। নিঝুম এরকম করে কাঁদছে কেন? ওর কাছে অহনা নামের মেয়েটার কানাকড়ি মূল্য নেই, কিন্তু ওই মেয়ে যে একটা বড়ো গুটি অয়নের হত্যাকান্ডের, ওকে যে কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবেনা।
"তোমার সত্যি কষ্ট হয়! " নিঝুমের কন্ঠে প্রচ্ছন্ন উপহাস টুংটাং করে বেজে উঠে। কষ্ট! তাও আবার সত্যি?
" একটুও মিথ্যা বলছি না," অরণ্য বলল।
"তাহলে আমাকে আর বউ বলে ডাকবে না কোনদিন," তীব্র শ্লেষের সাথে উত্তর দিল নিঝুম। হঠাৎ হঠাৎ ওর ভীষন ঘেন্না হচ্ছে অরণ্যকে দেখে। মনে হচ্ছে খানিকটা থুতু যদি ছুড়ে দিতে পারত ওর চোখে মুখে, খানিকটা হলেও ওর ভিতরের আগ্নেয়গিরিটা বুঝি শান্ত হতো।
"তুমি কী আমার কথা একটু শুনবা? " আক্ষেপের সাথে জানতে চাইল অরণ্য।
"কী শুনব! তুমি অহনাকে চুমু কেন খেয়েছ?" চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্নটা করে নিজের ক্রোধটা উপশমের চেষ্টা করে নিঝুম, কিন্তু শান্তি হচ্ছে না। ওর রাগ, ঘৃনা উত্তোরাত্তোর কেবল বাড়ছে, মনে হচ্ছে ভেঙ্গেচুরে সব শেষ করে দেয়।
"ঝুম আমি সবটাই বলতে চাই। পুরো ঘটনায় অহনার সাথের ওই অংশটুকু বিচ্ছিন্ন আর আকস্মিক একটা অংশ। তোমার কাছে ওই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত, আমার খুব ভুল হয়েছে কিন্তু আমার পুরো কথা আগে তুমি শোন, তারপর রিঅ্যাক্ট করো। তারপর তোমার যদি মনে হয় আমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তখন যা মন চায় শাস্তি দিও। শুধু একটা জিনিস আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেনা। তাছাড়া আর যা মন চায়,যা শাস্তি দিতে চাও... দিও।"
অরণ্যর এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে একটু হলেও নিঝুমের অভিমানের বরফটা বুঝি গললো। শুনবেনা শুনবেনা করেও শেষ পর্যন্ত অরণ্যর কথার জালে আটকে গেল ও, পাথরের মতো মুখ করে বসে পড়ল ঘটনার বিস্তারিত শুনতে।
"আমি কী এবার কথাগুলো বলব ঝুম.. তোমার শুনতে কষ্ট হবে নাতো,? "
দাঁত দিয়ে ঠোঁট আকড়ে ধরে নিঝুম জানাল, "তোমার মর্জি, আমি আবার একটা মানুষ হলাম নাকি তোমার কাছে যে আমার আবার ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকবে।"
"আচ্ছা তাহলে শুরু থেকে শুরু করি কেমন? কিন্তু ওতে কিন্তু অনেকটা সময় লেগে যাবে। ততক্ষণে আমরা বরং কথার সাথে সাথে খাবারটা শেষ করে ফেলতে পারি" অরণ্য কোমল স্বরে অনুরোধ জানাল। নিঝুমের চোখে মুখে অসহনীয় একটা কষ্টের ছাপ... নিজেকে এখন সত্যি খুব জঘন্য আর নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে অরণ্যর।
"বেহায়া একটা লোক, ঢং করে আবার ভালবাসা দেখাতে আসছে" বিরবির করে রাগ উগরে দিল নিঝুম কিন্তু মুখে সেটা জাহির করলনা একদমই।
"আমি আর খাবনা... ভাল লাগছে না।"
"এই মুহূর্তে বাচ্চাটা কিন্তু খুব দ্রুত বাড়ছে ঝুম, তুমি না খেলে ওরও কিন্তু পুষ্টির অভাব হবে। জন্মানোর পর অনেক রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে, এমনকি নাও বাঁচতে পারে। তখন কিন্তু তোমারও আমার মত কেবল অনুতাপে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু তখন তোমার আর কিছু করার থাকবে না। কথায় আছে না, সময় আর নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আজ যে জায়গায় আমি আছি ঝুম কাল সে জায়গায় তোমাকে না দাঁড়াতে হয়।"
"বুঝলাম না," নিঝুম তীর্যক দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে রইল সামনে বসা পুরুষটির দিকে। অরণ্যর কথাগুলো কেমন দুঃখী দুঃখী, বুক মুচড়ে আসে... নিঝুমের আবার বিভ্রম হতে লাগল।
"বলছি.. কিন্তু তার আগে তুমি খাওয়া শুরু করো। কথা দিচ্ছি আর লুকোচুরি করব না তোমার সাথে, লুকোচুরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে তোমার অরণ্য," গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরণ্য। আসলেই ক্লান্ত ও। সব কিছুতেই আজকাল রাগ হয় ওর, নিজেকে অধৈর্য লাগে, অস্থির হয়। সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা তৈরী হয় যখন আম্মু ওর জন্য কাঁদে। অরণ্যর খুব ইচ্ছে হয় মাকে বলে যে, আম্মু আমি খুব দুঃখিত, আমার জন্য তোমার অয়নটা তোমাকে,আমাকে, আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। সেখান থেকে আর কোনোদিন ও অভিমান করে, আবদার করে বলবে না, ভাইয়া তোর বিয়েতে কিন্তু আমায় একজোড়া স্যান্ডেল কিনে দিবি।
অরণ্যর কথাগুলো নিঝুমের মনের দেয়ালটাকে ছুঁয়েও কেন যেন ছুঁতে পারেনা। কেবলই মনে হচ্ছে এটাও যদি অরণ্যর কোন নাটক হয়। অরণ্যকে একটা ঠকবাজ,প্রতারক মনে হচ্ছে ওর... কী করবে এখন নিঝুম?
"আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা, তাইত? " নিঝুমের মনের কথাটা কিভাবে যেন পড়ে ফেলল অরণ্য। ওর কথায় রীতিমতো চমকে গেল নিঝুম। মিথ্যে বলে লাভ নেই, ওর বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে তাতে সন্দেহের বিষ গলে গলে বেরুচ্ছে। এখন অরন্যকে দেখলে ওর ভালোবাসার নদীতে... ঢেউগুলো আর আনন্দে উথাল-পাতাল করছে না।
খুব আস্তে আস্তে সর্তকভাবে নিঝুমের হাতটা ধরল অরণ্য, " আমি দুম করে একদিনে তোমার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসটা হয়তো ফিরে পাবনা ঝুম ,তবু চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে। আর আমি জানি আমি একদিন সেটা পারব, আমাকে পারতেই হবে। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না ঝুম, দুনিয়া উল্টে গেলেও আমাকে, তোমার ফেরত নিতে হবে।"
"আমরা মনে হয় আসল কথা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি, এখন এসব অবান্তর কথা না বলে তোমার মূল কথায় আসা উচিত, আমার ঘুম পাচ্ছে," নিঝুম নিরাসক্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল।
নিঝুম ওর উপর খুব... খুব অভিমান করে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না অরণ্যর। তবে আর যাই হোকনা কেন ঝুমকে ও এইটুকু অন্তত চেনে। সবটা শুনলে একসময় হয়তো ওকে মাফ করে দিবে ঝুম কিন্তু তার আগে ও জল ঘোলা করবে, তারপর তাতে অরণ্যকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। এখন কী আর করা অরণ্যকে সেই শাস্তি ঠান্ডা মাথায় সয়ে যেতে হবে আরকি।
"আচ্ছা আমি বলছি, কিন্তু তুমি মুখটা হা করো প্লিজ।"
"অরণ্য তোমার কী মনে হয়না আমার হাত আছে? আমার যখন ক্ষিধে পাবে আমি খেয়ে নিব," নিঝুম বিরক্ত স্বরে বলল।
"কিন্তু আমার এখন তোমাকে খাইয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুমি অনেকদিন আমাকে খাইয়ে দিয়েছ, আজ নাহয় আমি দিলাম।"
"অরণ্য..."
"মুখ হা করো ঝুম। তুমি খাবার না খেলে আমি আমার পিস্তলের ব্যবহারটা নিজের মাথায় করব,তুমি কী এখন সেটাই চাচ্ছ?"
কী সব অলক্ষুণে কথা বলে এই লোক, অসহ্য! অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো নিঝুম।
"ঝুম তোমার মনে আছে সেদিন আমি তোমাকে বার বার তাড়া দিচ্ছিলাম, আর তুমি বার বার বলছিলে এই আসছি, আসছি। "
"হমম "
"সেদিন আমি আর অয়ন ওর স্যান্ডেল কিনে এক দোকান থেকে আরেক দোকান ঘুরছিলাম, কেবল মাত্র সময়টা পার করার জন্য। এখনও জানো কী প্রচন্ড আফসোস লাগে, কেন ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম না। যা হতো আমার হতো, আমার জন্য ওর কোন ক্ষতিতো হতো না। নিরাপরাধ ভাইটা আমার কিছু না করেই এভাবে মারা গেল আর আমি অসহায়ের মতো সেটা দেখলাম। আমার চোখের সামনে ও ছটফট করতে করতে মরে গেল, মেঝেটা পুরো ওর রক্তে লাল হয়ে গেল, আ..মি, কিছুই করতে পারলাম না। ঝুম আমি কেন কিছুই করতে পারলাম না?" অরণ্যর বিষাদগ্রস্ত স্বর, এবার নিঝুমের মনের কোনে সত্যিকার অর্থে কাঁপন তুলল। অরণ্যর এরকম অসহায় চেহারা ও আগে কখনো দেখেনি, এমনকি ওদের সেই জবরদস্তির বিয়ের দিনও না। অয়নের কথা মনে হতেই সেই বিভৎস দিনটার স্মৃতি চোখের সামনে আবারো ভাসতে লাগল নিঝুমের। সাথে কেমন তাজা রক্তের গন্ধ , পেট গুলিয়ে বমি আসতে লাগল ওর।
"কি হলো? খারাপ লাগছে? " অরণ্য উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। " ঝুম... "
"ওক্.. কেমন বমি বমি পাচ্ছে অরণ্য , কেমন রক্ত রক্ত গন্ধ লাগছে।"
"সরি... আমার আসলে মনে ছিলনা একদম। আর ওসব উল্লেখ করবনা। তুমি আস্তে ধীরে সময় নিয়ে নিয়ে খাও, " অরণ্য তাড়াতাড়ি খাবারের থালাটা পাশে রেখে নিঝুমের পাশে গিয়ে বসল।
"ঝুম জানো, ওইদিন না অয়ন একজোড়া স্যান্ডেল কিনেছিল আমাদের বিয়েতে পরবে বলে, আরও কতকিছুর বায়না ধরেছিল ছোট বাচ্চাদের মতো।" অরণ্য বিষন্ন মুখে হাসল। "পাগলটা দুম করে কোথায় হারিয়ে গেল বলতো? "
" অরণ্য তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?"
নিঝুমের প্রশ্নে অরণ্য হাসল," একটা কেন একলক্ষ প্রশ্ন করো, আমি সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব, আর ভাগব না... ভয় নেই।"
"তুমি নিজের পরিচয় গোপন কেন করলে ? তারচেয়েও বড়ো কথা তুমি আমার কাছে, তোমার নিজের পরিবারের কাছে নিজেকে কেন লুকালে? এই লুকোচুরির কী মানে অরণ্য? " প্রশ্নটা করতে পেরে নিঝুমের মনে হলো বুকের ভিতরের চাপ অনেকটা কমে গেল ওর। এই প্রশ্নটা ওকে সকাল থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
"কেন লুকালাম? নিঝুম আমার সাহস হয়নি আম্মুকে বলার যে তার ছোটকে আমি বাঁচাতে পারিনি। আমার... আমার এখনও সাহস হয় না, আমার আম্মুর সামনে গেলেই ভয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে। আমি আম্মুকে কী জবাব দেব ঝুম? আমি পুলিশ হয়ে আমার ভাইকে বাঁচাতে পারিনি। "
"কিন্তু অরণ্য এই সত্যি তুমি কতদিন লুকিয়ে রাখবে? "
"যতদিন পারি, অন্তত যতদিন ওর খুনিকে আমি তার যোগ্য শাস্তিটা না দেই, ততদিন," অরণ্য অনমনীয় স্বরে উত্তর দিল। ওর ভিতরের আক্রোশটা আবার দানা বাঁধছে, নিঝুম তার উত্তাপটা টের পেল। কিন্তু তাহলে অহনার সাথে অরণ্যর এত ভালোবাসা, সেটা আবার কোথ থেকে জন্মাল। কিছু একটা ভজঘট তো আছে।
"আর আমার কাছে? আমি কী অপরাধ করেছিলাম অরণ্য?" নিঝুম উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল।
"তোমার অপরাধ? তোমার অপরাধ তুমি আমাকে ভালোবাস, তোমার অপরাধ তুমি আমার স্ত্রী আর তার চাইতেও বড়ো অপরাধ হলো আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি, তুমি আমার অনেক বড়ো দুর্বলতা ঝুম। অয়নের পরে রাইসুলের টার্গেট তুমি হতে ঝুম যদি আমি মানুষের চোখে বেঁচে থাকতাম, কারন রাইসুল অয়নকে নয় আমাকে মারতে চেয়েছিল। "
"কিন্তু অরণ্য আমি যেমন বুঝে ফেললাম, রাইসুলও তো তেমনি ভাবে তোমাকে চিনে ফেলতে পারে। "
"পারে... অবশ্যই পারে, কিন্তু সেদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল যেটা সেদিনের সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা ছিল। অয়ন সেদিন আমার ইউনিফর্মটা দুষ্টামি করে পরেছিল তোমাকে বোকা বানাবে বলে, কিন্তু সেটা আর কখনো সম্ভব হয়নি।" অরণ্য ছলছল চোখে জানাল নিঝুমকে।
নিঝুম বুঝতে পারলনা ওর ঠিক কী বলা উচিত এখন অরণ্যকে। একজন ভাইকে তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে ঠিক কী বলে স্বান্তনা দেয়া যায়?
তবে অয়নের দুষ্টুমি করে অরণ্যর ইউনিফর্ম পরাটা দুর্ঘটনা বলতে... নিঝুমের মন সায় দিলনা। আচ্ছা ওকি স্বার্থপর হয়ে গেল? কিন্তু সেই দিন অয়নের মৃত্যু যেমন কারও কাম্য ছিলনা, ঠিক তেমনি অরণ্যর মৃত্যুও তো ওর কাম্য নয়।
অরণ্যকে স্বান্তনা দেবার মতো উপযুক্ত কোন শব্দ আসলে খুঁজে পেলনা নিঝুম।
চলবে....…..
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro