২৮
" শোন না, আমি আজ কোন কানের দুলটা পরব? ওই যে ঝুমকো মতো ওটা নাকি মুক্তো বসানো টপের মতো, সেটা?"
কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে একটা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেল না নিঝুম। উত্তর না পেয়ে প্রশ্নটা আবারো করল ও অরণ্যকে।
"আমি তোমার কোন কথারই উত্তর দিব না। আমার খুব মন খারাপ। আমি কাল থেকে বলছি আমি কোন পাঞ্জাবি পরব ঠিক করে দাও কিন্তু তুমি তার কোন উত্তরই দিচ্ছ না। আসলে কোন আগ্রহই নাই তোমার আমার ব্যাপারে," অরণ্য রীতিমতো অভিযোগ করে বসল নিঝুমকে।
"তার মানে? অরণ্য আমি নিজে তোমার কাপড়গুলো বক্সে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছি। মার্কিং ও করে দিয়েছি যে কোনটা হলুদের, কোনটা বিয়ের, কোনটা বৌভাতের। তারপর তুমি কী করে সেটা বুঝতে পার না আমার তো মাথায়ই আসছেনা," নিঝুম অবাক না হয়ে পারল না। এই লোক দিনকে দিন একটা অবুঝ বাচ্চায় পরিনত হচ্ছে।
"আমি তো একবারও বলিনি যে তুমি দাওনি কিন্তু হলুদের কাপড়ের বক্সে দুইটা পাঞ্জাবি, আমি কোনটা পরব?"
"যেটা তোমার পছন্দ হবে... আসলে আব্বুর দুটোই পছন্দ হয়েছিল,তাই দুটোই কেনা হয়েছে।"
"কিন্তু আমি তো একটাও পছন্দ করতে পারছিনা। "
"মানে! দুটোর একটাও তৈভালো লাগেনি?"
"না মানে দুটোই অনেক ভাল লাগছে কিন্তু দুটো তো আর আমি একসাথে পরতে পারছিনা, তাই তুমি যে কোন একটা আমাকে ঠিক করে দাও।"
"আচ্ছা তাহলে তুমি ভিডিও কল দাও,আমি দেখে বলছি।"
"না, মোবাইলে ওভাবে দেখলে কিছু বোঝা যায় নাকি? সামনা সামনি না দেখলে কিচ্ছু বোঝা যায় না।"
"তোমার মাথা গেছে, আমি সামনা সামনি দেখব কী করে?"
"খুব সহজ... ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। আমি পাঞ্জাবি নিয়ে চলে আসছি আগোরার সামনে, তুমি বারোটার মধ্যে ওখানে চলে আসো।"
এতক্ষনে পাঞ্জাবি নিয়ে টানা হেচাড়া করার কারন মাথায় ঢুকল নিঝুমের। কী দুর্বুদ্ধি এই লোকের..
"কিন্তু অরণ্য"
"কোন কিন্তু না, তুমি আসছ, আর এটা ফাইনাল ঝুম," বলেই ফোনটা কেটে দিল অরণ্য।
"অরণ্য...উগগ.."
রাগে নিঝুমের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো। এই লোক একটা পাগল আর আমি এই লোককে লাফাতে লাফাতে যেয়ে বিয়ে করেছি... আসল ছাগল তো আসলে আমি।
" ছাগল! ছাগল কোথায় পেলিরে আপু?"
"এই যে আমি, আর কে.."
আশু কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে? আপু নিজেকে নিজে ছাগল বলছে কেন?
"আশুমনি, আমি এখন কী করে বের হবোরে বাসা থেকে ? প্লিজ হেল্প মি..."
"আপু, আমাকে এত আদর করে ডেকে কোন লাভ নাই, আমি আজকে কোনোভাবেই তোমাকে হেল্প করতে পারব না।"
"আশু প্লিজ, দেখ তুই আমার সমস্যাটা বোঝ। আমি এখন যদি না যাই তাহলে ওই ফাজিল ব্যাটা আমার সাথে বিয়ের দিন কত রকম ঢঙ ঢাং করবে তুই সেটা চিন্তাও করতে পারবিনা। ছুটকি প্লিজ হেল্প মি, নইলে তোর বোনের সংসার হওয়ার আগেই ভাঙবে। "
"আপু তুমি কিন্তু ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা করছো এটা কিন্তু খুব খারাপ। "
"আশুবুড়ি প্লিজ, তোকে আজ দুইটা, না না তিনটা আইসক্রিম দিব আপুনি, প্লিজ।"
" আগে ওয়াদা করো... পরে কিন্তু আপু তুমি কথা ঘুরাতে পারবানা। আর যদি কথা ঘুরাও তাহলে আজকে জিজুকেই ধরব আইসক্রিমের জন্য, আর বলব যে, তুমি একটা মহা ঘিরিঙ্গিবাজ মেয়ে। জিজু যেন তোমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে আচ্ছা মতো ধোলাই দেয়।"
"আশ্চর্য, আমি বলছিতো তিনটাই দিবো। আচ্ছা যা চারটা কিনে দিব। এখন তুই আমার বেরেনোর ব্যবস্থা কর।"
"মনে থাকে যেন।"
"থাকবে থাকবে "
"হুমম।"
........................................
"ভাইয়া তুই কী বেরোচ্ছিস?"
অয়নের প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে গেল অরণ্য।
"হ্যাঁ, কেন?"
"কোথায় যাচ্ছিস?"
" সামনে, একটা রেজার কিনব...এখন যেটা আছে ওটার অবস্থা একেবারে করুন, ঘাস কাটারও যোগ্য না।"
"এই ড্রেসে!"
" হ্যাঁ, কেন?"
"কিছুনা... আচ্ছা চলো আমিও তোমার সাথেই যাই।"
"তুই! তুই যাবি কেন? আর আমি যাবো টোকিও স্কয়ারে.. না মানে ওখানকার আগোরাতে, আসলে ওখানকার রেজারগুলো নাকি ভাল পার্থ বলেছে।"
"আমিও একটা রেজারই কিনব আগোরা থেকে, " অয়ন ঠোঁট টিপে হাসল। ভাইয়া যে আস্ত একটা গবেট হয়ে যাচ্ছে ঝুমঝুমির প্রেমে পড়ে... ওর ভাইয়া যদি সেটা বুঝতো! যাচ্ছে ঝুমঝুমির সাথে দেখা করতে অথচ.. নইলে এক রেজার কিনতে কোন পাগলেও এখন ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর যাবেনা।
তারমানে কী অয়ন ওদের কথা সব শুনে ফেলছে? ধরা খেয়ে চুপ হয়ে গেল অরণ্য। তারপর মিনমিন করে বলল," সঙ্গে যাবি চল, কিন্তু গোয়ান্দগিরি করবি না কোন রকম। আমি ঝুমকে নিয়ে একটু আমার কলিগের বাসায় যাব। আম্মু কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি যে, আমি অফিসে যাচ্ছি আর আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে।"
"আসতাগফিরুল্লাহ... ভাইয়া আমি আর গোয়েন্দাগিরি? জীবনেও সম্ভব না। যাক,
এখন চল তো আগে,আমি সত্যি একজোড়া স্যান্ডেল কিনব।"
"চল " অরণ্য আর কথা বাড়াল না, জানে এখন চাইলেও অয়ন ওর পিছন ছাড়বেনা। তবে অয়নকে আবারো সতর্ক করতে ভুলল না ও, খানিকটা হুমকির স্বরে বলে চলল...
" দুপুরের পর আমার সত্যি আজকে মিটিং আছে। তার উপর আবার কাল থেকে টানা কয়েকদিনের ছুটি... বুঝতে পারছিস কথাটা?"
"আহা পারছি.. পারছি.. চল তো," অয়ন, অরণ্যর কথাগুলো গায়েও মাখলনা, কেবলই মুখ টিপে হাসতে লাগল।
...............................................
"ভাইয়া ওখানে একটু চলতো।"
"ছোট, ঝুমকে আমি আগোরার সামনে আসতে বলেছি।"
"ভাইয়া তোমার বউ কী টোকিও স্কোয়ার চিনে না? একটা ফোন দিয়ে মন্দাকিনীকে বলে দাও আমরা টোকিওতে আছি।"
"কী কিনীকে!"
"আরে ছিল ঐ এক পুরানো হিন্দি ফিল্মের নায়িকা।"
"ওহ.. তা কোথ থেকে পাস তুই এসব, ব্যাংকে বসে কি এই সব গিলিস নাকি?"
"আরে ওগুলা দেখে আসছি কোন কালে। আমাদের ম্যাথের স্যার ছিল না, ওই যে ইয়াসির স্যার, ওনার মেজ ছেলে তো আমাদের সাথেই পড়ত। ওর কাছেই শুনেছিলাম যে স্যারের ফেভারিট নায়িকা ওটা... হা হা।"
"তুই উল্টো লাইনে গিয়েছিস, তোর গোয়েন্দা হওয়া উচিত ছিল, " অরণ্য এগিয়ে গিয়ে আগোরার উল্টোদিকের ক্যাটস আইয়ের শোরুমে গিয়ে ঢুকল। ভাইয়ের এরকম বেহাল দশা দেখে অগত্যা অয়নকেও তার পিছে পিছেই যেতে হলো। ঝুম আসলে যদি ওদের খুঁজে না পায়.. অরণ্যর দুশ্চিন্তার এই বহর দেখে অয়নের বিরক্তি আর হাসি দুটোই পাচ্ছিল, ভাইয়া তো শেষ.. লাইফ এক্কেবারে রসাতলে গিয়েছে।
"মাফ কর বাবা...যা আছি তাতেই আমি পেরেশান তার উপর তোমার ওই গুন্ডা মাস্তানের পিছনে ঘুরে আমার এই নায়কের মতো চেহারা ওয়েস্ট করার কোনো ইচ্ছা... আমার নাই। তার চেয়ে সারাদিন আমার ওই বুড়ি বুড়ি ক্লায়েন্টগুলোর সাথে গল্প করা ঢেড় ভাল," অয়ন দেয়ালে গাঁথা আয়নায় এক পাশের চুলগুলো একবার আঁচড়ে নিল হাত দিয়ে। অহনা বলে ওকে নাকি এভাবে দেখতে খুব ম্যানলি দেখায়।
"হমম.. ওই বুড়ি বুড়ি ক্লায়েন্টগুলো আজকাল আবার তোমার স্বপ্নেও নাকি আসা যাওয়া করে শুনলাম।"
অরণ্য একটা হ্যাঙ্গার সহ শার্ট নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
উহহ্.. উহহ্... অযথাই খুক খুক করে কয়েকবার কাশল অয়ন, খাইসে ঝুমঝুমি কি অনার বিষয়টা বলে দিয়েছে নাকি ভাইয়াকে?
"কিরে কাশছিস কেন? ঠান্ডা লেগেছে নাকি?" অরণ্য তেরছাভাবে অয়নকে একটু দেখল। অয়নের চেহারা নার্ভাস দেখাচ্ছে। তারমানে তীর জায়গামতো লেগেছে। অরণ্যর খুব হাসি পেল এবার... দেখ ব্যাটা ফাঁদে পড়লে সিংহও কেমন করে বিড়াল হয়ে যায়। আসলে সেদিন অয়ন যখন অহনা নামের একটা মেয়ের কথা ঝুমকে বলছিল ও তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো সবটাই শুনে ফেলেছে। কিন্তু গাধাটা ঝুমকে এই কথাটা বলতে পারল আর ওকে বলতে পারলনা! ঘোর তুই ঝুমের পিছনে পিছনে.. দেখি ওই ভীতু বগির ডিম কবে মাকে তোর আর অহনার কথা বলে.... ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মজা তোকে আমি বোঝাব।
"না.. এমনি গলা শুকিয়ে গেছে তাই,"অয়ন তাড়াতাড়ি একটা গেঞ্জি হাতে নিয়ে ট্রায়ালরুমে গিয়ে ঢুকল।
অয়ন যে আপাতত ওর সামনে থেকে ভাগল সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হলো না অরণ্যর। অয়নটা আগে ওর সাথে সব কথাই খুব সহজে শেয়ার করতো কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পর থেকে কেমন একটা দূরত্ব বেড়ে গেছে ওদের দুজনের মধ্যেই। বিশেষ করে ট্রেনিং পিরিয়ডটায় বাড়ির সাথে যোগাযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল অরণ্যর... খুব সম্ভবত সেই সময়েই অহনা মেয়েটার সাথে অয়নের পরিচয় হয়েছে।
কিন্তু এই অহনা মেয়েটা কেমন, একটু খোঁজ খবর নেওয়া দরকার। বিশেষ করে সে যখন বাড়ির ছোট বউ হতে চলেছে... ঝুম মায়ের কাছে ভাল করে ব্যাপারটা খুলে বলার আগেই মেয়েটা সমন্ধে ভাল ভাবে জানতে হবে অরণ্যকে। কিন্তু ওর চিন্তার সুতোয় টান পড়ল হাতের মোবাইলের রিংটোনে।
এদিক ওদিক তাকাল অরণ্য। না... কোথাও চোখে পড়ছে না। ফোনটা ধরে কানে নিতেই ওপাশ থেকে নিঝুমের কাতর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
"আমার আসতে আরও আধাঘন্টা দেরী হবে অরণ্য... বড়ফুপি একদম ডাইনিং রুমে বসা, সিড়ি দিয়ে নামলেই ধরা খেয়ে যাব।"
অরণ্যর যে কী হলো.. মনে হলো এক্ষুনি অনেকগুলো হামি দেয় বউটার দুগালে কিন্তু বউয়ের কাছে তার বেয়ে পৌঁছান ওর পক্ষে সম্ভব না, এই অসাধ্য ওর ক্ষমতার বাইরে। তাই বাধ্য হয়ে বলতে হলো,"আচ্ছা... আমি আছি, তুমি এখানে না এসে সোজা টোকিওর ফিফথ ফ্লোরে চলে আসো। "
"আচ্ছা।"
"ভাইয়া এটা কেমন দেখতো?" অয়ন হালকা বাদামী রঙের একটা গেঞ্জি পরে সামনে এসে দাঁড়াল।
ফোনটা রেখে অরণ্য, অয়নের গেঞ্জিটা ভাল করে দেখল। ভালই লাগছে... গেঞ্জিটায় ক্রীম আর বাদামী রঙটা খুব চমৎকার একটা কম্বিনেশন তৈরী করেছে। বেশ সুন্দর লাগছে অয়নটাকে দেখতে।
"ভাল লাগছে, এখন চল তোর টোকিওতে, কী যেন কিনবি।"
"হ্যাঁ চল, আমার পায়জামার সাথে পরার স্যান্ডেল নাই।"
ওরা দুভাই মিলে স্যান্ডেলের একটা দোকানে গিয়ে ঢুকলো। ওরা ঢুকতেই সাধারনত সব খানে যেটা হয় তা হলো... সবাই ওদের খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওদের মিল গুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে আর ওদের অমিলগুলো বাইরে থেকে বোঝা খুব কঠিন, খুব সামান্য কিছু পার্থক্য বাইরে থেকে টের পাওয়া যায়, তাও খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষনের পর।
তবে মানুষ ওদের একসাথে দেখলে খুব আগ্রহ সহকারে দেখার চেষ্টা করে.. কেউ সামনা সামনি আবার কেউ আড়চোখে, এইটা ওদের খুব মজা লাগে। ওরা দুইভাই ই এটা খুব উপভোগ করে।
অয়নের স্যান্ডেল কিনে অরণ্য যখন ঘড়ি দেখল, ততক্ষণে মিনিটের কাটা অনেক দূর এগিয়ে চলে গিয়েছে নির্ধারিত সময়ের গন্ডী পেরিয়ে। আজ এই মেয়ে ওকে ভোগাবে.... কিন্তু অরণ্য কী করবে, আজ ওর ঝুমকে প্রচন্ড দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ ওকে জড়িয়ে ধরতে না পারলে অরণ্য শান্তিতে ঘুমাতেই পারবেনা, একদম মরে যাবে।
সাথে ঝুমকে নিয়ে আজ ও পার্থর বাসায় ছোটখাট একটা মিটিং করবে... ঝুমের নিরাপত্তার খাতিরে। কাল থেকে আগামী দশ দিনের জন্য ছুটিতে যাচ্ছে অরণ্য, এই দশদিনের সমস্ত ভার পার্থর কাঁধে তুলে দিয়েছে ও.. ঝুমের তাই পার্থর প্ল্যানটা ভাল করে জানা ও বোঝা জরুরি।
তারপর ঝুমকে নামিয়ে দিয়ে সোজা মিটিংয়ে গিয়ে ঢুকবে অরণ্য... যদিও আজকের অফিসিয়াল মিটিংটা আসলে বিকেল তিনটার পরে। কিন্তু আজ ডি আই জি স্যার বিশেষ কয়েকটা কেসের ফলোআপ দেখবেন, এসপি স্যার সবাইকে তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অফিসে এসে উপস্থিত হতে বলেছেন। কিন্তু এখন ওর অর্ধাঙ্গীনি অরণ্যর এই সমস্যা কবে বুঝবে কে জানে... একদিনও ঠিকমতো আসে না। অপেক্ষা করতে না পেরে শেষে আবারো একটা গেঞ্জির দোকানে গিয়ে ঢুকলো অরন্য, অয়নকে নিয়ে।
নিঝুমের মেজাজ সেই থেকে চড়ে বসে আছে। বড়ো ফুপি সেই যে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে ডাইনিং টেবিলে, একবারও একটু ওঠার নাম করছেন না। ও সেই কখন থেকে কাপড়চোপড় পরে তৈরী হয়ে বসে আছে, অরণ্য বেচারা এতক্ষনে কতবার যে ফোন করেছে... নিঝুমের খুব... খুব খারাপ লাগছে। লোকটা ওকে একটু দেখবে বলে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে যদিও অরণ্য কথাটা মুখ ফুটে আজ একবারও বলেনি। কিন্তু তাতে কী? নিঝুম তো ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
"আশু,কিছু একটা কর।"
"আমি কি করব?"
"জানি না প্লিজ, আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ লোকটা ওভাবে অপেক্ষা করবে, আর আমার সাথে দেখা করে আবার অফিসে যাবে," বলতেই নিঝুমের মনে হলো অফিসে যাবে মানে তো অরণ্য ইউনিফর্মে আছে নিশ্চই। ছি... কি খারাপ একটা বিষয় হলো। লোকজন তো মনে করবে যে ও অফিসের ডিউটি রেখে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনটা যতটুকু খাড়াপ ছিল,তার চেয়েও আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল নিঝুমের... কেমন কান্না এসে গেল।। অরণ্যকে কেউ খারাপ মনে করবে মনে হলেও ওর এখন মন খারাপ হয়।
"আচ্ছা আপু কাঁদিস না,আমি দেখছি বড়ো ফুপিকে কিভাবে ওখান থেকে সরানো যায়। কিন্তু ওই ফাঁকে তুই গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াবি সোজা, ঠিক আছে।"
নিঝুম মনে মনে আশুকে একশটা চুমু খেল। এতক্ষণের গুমোট আকাশে যেন শরতের হালকা মেঘের ভেলাটা ভাসল। আশু যখন বলেছে তখন ও কিছু একটা করবেই। আসলে দোষটা বড়ফুপিরও না... উনি নিঝুমের অন্যান্য ফুপিদের সাথে বসে ওর বিয়ের গয়নাগাটি এসব নিয়েই কথা বলছেন।
"যত দোষ সব ওই পঁচা লোকটার। যখন মন চাবে তখনই ওকে ওনার দেখতে হবে, ডাকাত একটা," বিরবির করে একটা ধমক দিল নিঝুম অরণ্যকে।
কিন্তু মনে মনে যতই দোষ দিক, একটা মিষ্টি হাসির ঝলক ঠিকই ছন্দ তুলল নিঝুমের চোখের তারায়, ফিসফিস করে বলল,"অরণ্য তুমি আর একটু খানি দাঁড়াও, তোমার ঝুম এক্ষুনি আসছে।"
কিছুটা দূরত্ব যে ভালোবাসার তীব্রতা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়, এই কয়দিনে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে নিঝুম। উপরে উপরে যতই অনিচ্ছা দেখাক, অরণ্যর কাছে ছুটে যাবার অজুহাত না পেয়ে ও এই কয়দিনে কারনে অকারনে অরণ্যকে ফোনে বিরক্ত করেছে অসংখ্যবার। মা কড়া করে বলে দিয়েছে, কোনো রকম কথা যেন তাকে আর শুনতে না হয় মানুষের কাছ থেকে। ভয়ে আর অরণ্যর সাথে দেখা করবে বলার সাহস হয়নি নিঝুমের।
কিন্তু এখন বিপদ মাথায় নিয়েই বের হতে হবে নিঝুমকে। মাকে কী বলবে মনে মনে এতক্ষন তাই ঠিক করেছে ও। আগে ও কৃষি মার্কেটে নিজের টেইলরের কাছে যাবে.... তারপর মার সাথে ফোনে দর্জির আলাপ করাবে। তারপর ও টোকিও স্কোয়ারে যাবে। কিন্তু এখন আশুবুড়ি পুরো কাজটা কিভাবে সামাল দেয় সেটাই হলো মূলকথা।
...................................
"ভাইয়া এটা কিন্তু খারাপ না দেখ।"
"অয়ন এগুলোর এখানে যা দাম, এগুলো তুই ভ্যানে অর্ধেক দামে পাবি।"
"ভাইয়া... "
"কি ভাইয়া, আমি সত্যি বলছি। সেদিন শফিকের এক গেঞ্জি দেখে আমরা মনে করলাম ওটা বোধহয় কানাডা থেকে উড়ে এসেছে। ওর শ্বশুর তো ঘন ঘন কানাডা যায় আসে। তা শফিক বলার আগেই দেখি নাবিলা হেসে দিয়েছে। পরে শুনলাম বঙ্গ থেকে কিনেছে। "
"ভাইয়া ওটা আমিও জানি। কিন্তু তোর বিয়েতে আমি ভ্যান থেকে কিনে পরব?"
"আরে আমি তাই বলছি নাকি। আর বিয়েতে গেঞ্জি পরবি কেন, তোর শেরওয়ানি কই? সেদিন না নতুন শেরওয়ানি পরে তোকে ট্রায়াল দিতে দেখলাম। "
"ওটা আছে, তাই বলে আমার ভাইয়ের বিয়েতে আমি আমার পয়সায় একটা গেঞ্জি কিনব না?"
"তা কেন, ঠেকাচ্ছে কে?"
"আর ভাইয়া স্যান্ডেলটা কিন্তু তোমার টাকা দিয়ে কিনব, ওকে?"
"আচ্ছা,আচ্ছা তুই কিন। "
"ভাইয়া ওটা কী ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড না?"
"হ্যাঁ.. "
"ঝুমঝুমি এলে ওখানে ঢু মারা যেত।"
"তুই আজকাল এত মেয়েদের জিনিসপত্রের খোঁজ নিস কেন বলতো, কেউ আছে নাকি পছন্দের? "
"আরে আমি তো ঝুমঝুমিকে নিয়ে ঢুকতে চাচ্ছি।"
"ওই আশা বাদ দে, তুই বড়লোক মানুষ, তোর বউ নিয়ে ঢুকিস। আমার বউকে ওগুলো পরাতে গেলে এদিক ওদিক অনেক রকম রাস্তার ব্যবহার করতে হবে। তারচেয়ে চল এই দোকানে খানিক কাপড় দেখি, তারপর একটু মোবাইলের দোকানে যাই। আমার স্ক্রীন প্রোটেকটরটা ফেটে গেছে, ওটা পাল্টাবো। "
"ওকে.... চল।"
অয়ন, অরণ্যর কাছে ধরা খাওয়ার ভয়ে আর কোন রকম বিরোধিতায় জড়াল না।
..............…................
"আপু আমি ফুপিকে নিয়ে বাবার পাশের রুমে যাচ্ছি, তুই এক্ষুনি নাম। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।"
"উমমা...." একটা উড়ন্ত চুমু আশুর দিকে ছুড়ে দিল নিঝুম। হাসতে হাসতে সেটা মুঠিতে ধরে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল আশু। অরণ্যকে এবার একটা ফোন দিতে হবে মনে করতেই নিঝুমের মোবাইলটা বাজতে লাগল। ধরতেই উদ্বেগ জড়ানো স্বর শুনে, চোখে পানি এসে গেল নিঝুমের।
"আসছ ঝুম?"
"আসছি। শোনো আমি কিন্তু একটু কৃষি মার্কেট ঘুরে আসছি, পাঁচ দশমিনিট দেরী হবে। "
"আমি আসব ওখানে?"
"না, আমি এখনও বের হইনি। তুমি ওখানেই থাকো, আমি আসছি।"
"বউ... "
"হমম..."
"আই লাভ ইউ..."
"আমি এক্ষুনি আসছি..।" মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিল নিঝুম। কথাটা শুনলেই গালটা কেমন অদ্ভুত রকমের লালচে হয়ে উঠে ওর।
.
.
.
.
.
"হ্যালো... হ্যালো...."
"কে?"
"অরণ্য.. হ্যালো.."
"আমি অয়ন বলছি..."
"অয়ন! আচ্ছা অরণ্যকে দাওতো একটা কথা বলবো.."
"ঝুমঝুমি তুমি এখানে এসো না।"
"আসবনা? কী বলছ তুমি.. অরণ্য কী রাগ করেছে? আমি এক্ষুনি আসছি। "
"না, তুমি এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও। "
"কেন অয়ন? অরণ্য কই? তুমি অরণ্যকে একটাবার দাও।"
"ঝুমঝুমি ওরা ওর বুকের বাম পাশে পরপর তিনটা গুলি করেছিল... ওই দৃশ্য তুমি সহ্য করতে পারবে না, তুমি প্লিজ এখানে এসো না।"
চলবে......
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro