২২
"অরণ্য বাঁচাও প্লিজ"
অরণ্যর মনে হলো ওর আত্মাটা ধরে কেউ টান দিয়েছে। কি করে ও বিছানা থেকে উঠল, কি করে রুম থেকে বের হলো ওর জানা নেই। নিঝুমের কন্ঠস্বরে ও স্পষ্ট ভয়ের আভাস পেয়েছে, অরণ্যর মনে হলো এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে যদি কোনভাবে ও ঝুমের কাছে পৌছাতে পারত।
আমার ঝুমের যেন কিছু না হয়, ওর কিছু হলে আমি কি করে বাঁচব? প্লিজ প্লিজ আমার জন্য ওকে সুস্থ রাখো আল্লাহ , ভালো রাখো।
চৌষট্টি নম্বর রুমের দরজায় পৌছে ধাক্কা দেওয়ার পরও যখন ভেতর থেকে দরজার লক খুলল না, অরণ্যর জিহ্বা তখন ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রুমের কোন দিকে জানালা মনে মনে একটা হিসেব কষার চেষ্টা করল ও, কেউ আক্রমন করলে জানালাটাই ব্যবহার করবে যদি সে দরজা ব্যবহার না করে। আবার হতে পারে দরজা দিয়েই ঢুকেছে।
কিন্তু ঝুম সাড়া দিচ্ছে না কেন? অরণ্যর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
জোরে জোরে আরও কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পরও একই অবস্থা। ম্যানেজারের কাছে রুমের অতিরিক্ত চাবি থাকার কথা। কিন্তু ভিতর থেকে যদি ছিটকিনি দেওয়া থাকে? থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে, ফিফটি ফিফটি চান্স আছে। দৌড়ে নিচের লবিতে এসে ডেস্কে খোঁজ করতেই ম্যানেজারকে পাওয়া গেল। বেচারা বোধহয় সবেমাত্র ঘুমাতে যাচ্ছিল। চাবি চাওয়াতে একটু অবাক হলো। অরণ্য শেষে বলতে বাধ্য হলো, দরকার হলে আপনি আমার সাথে আসুন। কিন্তু চাবিটা আমার খুব আর্জেন্টলি দরকার ।
"না না... স্যার তার কোনো প্রয়োজন নাই। "
ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত ওর কাছে ঘরের চাবি দিয়ে সাথে একটা হোটেল বয়কে দিল চাবিটা ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য... সঙ্গের ছেলেটার নাম সেলিম।
চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই দরজার লকটা খুলে গেল। রুমে ঢুকেই অরণ্যর মাথা খারাপ, পুরো বিছানা উল্টোপাল্টা.. বালিশ সব নিচে পড়ে আছে, মনে হচ্ছে বিছানার উপর দিয়ে বড়ো কোনো ঝড় বয়ে গেছে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা বালিশ ওপরে তুলতেই ওটার নিচে ঝুমের প্রিয় লোশনটা চোখে পড়ল অরণ্যর। এটা ও চেনে। প্রতিদিনই এটা মাখতে দেখে ও ঝুমকে।
পুরো ঘরে তাকিয়ে কোথাও নিঝুমকে চোখে পড়ল না অরণ্যর। মনে হলো ওর নিঃশ্বাসটা বোধ হয় বন্ধ হয়ে আসছে। পার্থ বার বার মেসেজ করছিল যে, কোনো একটা বিপদ ঘটবে সামনে অরণ্যদা, রাইসুলের লোকজন সন্দেহজনক আচরন করছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। কিন্তু ওদের টার্গেট আবারও ঝুম হতে পারে এটা অরণ্যর চিন্তাতেও আসেনি। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল অরণ্য।
জোরে জোরে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে অরণ্যর, কিন্তু গলা দিয়ে একফোঁটা শব্দ বের হচ্ছে না। দুচোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে, স্পষ্ট করে কোনো কিছুই আর দেখতে পারছেনা ও।
আসলে দেখার আর কোনোরকম প্রয়োজনও বোধ করছে না অরণ্য। ওর দুনিয়া শেষ হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে অবুঝ বাচ্চার মতই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল অরণ্য। ঝুমকে ধরে নিয়ে গেছে ওর শত্রুরা৷
"প্লিজ হেল্প," করুন একটা চিৎকার, অরণ্যর মনে হলো খুব কাছ থেকে ডেকে উঠল নিঝুম।
"বাথরুম থেকে একটা শব্দ আসছে স্যার, " সেলিম ছেলেটা তখনও দরজার কাছে দাঁড়ান। সে অরণ্যর কান্না কাটির কোন কারনই বুঝে উঠতে পারছে না।
" ঝুম " জোর গলায় ডেকে উঠল অরণ্য।
"অরণ্য........."
"ঝুম.. কোথায় তুমি? "
পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজল অরণ্য। জানালার দিকে চোখ পড়তেই আরেক দফা ধাক্কা খেল ও। ঘরের জানালা ভিতর থেকে বন্ধ। তারমানে শয়তানগুলো দরজা দিয়েই ঢুকেছে। জোরে কিছু একটা পড়ার শব্দ এল বাথরুম থেকে। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেল অরণ্য, আশেপাশে তাকিয়ে শক্ত কিছু খুঁজল কিন্তু সুবিধামতো কিছুই পেল না। শেষে সেলিমের দিকেই সাহায্যের আশায় তাকাতে হলো অরণ্যকে। সেলিম ছেলেটা বুঝতে পেরে দৌড়ে বাইরে থেকে একটা স্টীলের পাইপ নিয়ে আসল অরণ্যকে দেয়ার জন্য।
অরণ্য বুঝতে পারছেনা শয়তানটার সাথে এই সামান্য অস্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করে ও জিতবে কিনা, কিন্তু ওর কিছু করার নেই৷ ডিউটিতে নেই বলে ওর রিভলভারটাও সাথে নেই। যাই হোক যে কোনো ভাবে ঝুমকে বাঁচাতে হবে ওর। কিন্তু অরণ্যকে দেখে আবার ঝুমকে কিছু করে না বসে শয়তানটা।
পরের মুহূর্তে ওয়শরুমের দরজাটা লাথি দিয়ে খুলে ফেলল অরণ্য।
"এতক্ষণ লাগে আসতে, এদিকে আমি মরে যাচ্ছিলাম। পচা একটা লোক," কাঁদো কাঁদো সুরে বলে উঠল নিঝুম।
অরণ্য ডানে, বামে,উপরে, নিচে তাকিয়ে কাউকেই খুঁজে পেল না সেখানে.... নিঝুম ছাড়া।
"অরণ্য প্লিজ আমাকে বাঁচাও। "
"নিঝুম আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কার কথা বলছ তুমি? কার কাছ থেকে বাঁচাবো?" অরণ্য হতভম্ব হয়ে জানতে চাইল। নিঝুম আবার ভূতের ভয় টয় পেল নাতো?
"অরণ্য ওখানে চাদরের নিচে "
"চাদেরর নিচে! চাদরের নিচে কী?"
"দুই তিনটা ইঁদুর...উমম সমানে লাফালাফি করছে।"
"ইঁদুর! "
"আছে ঘরের মধ্যে, অনেকগুলো। আমার খাটের উপর দিয়ে দৌড়ে গেছে। "
অরণ্য ঘরে এসে দেখল সত্যিই একটা বাচ্চা নেংটি ইদুর বিছানার মধ্যে, চাদর বেয়ে উঠানামা করছে।
"এই জন্য তুমি চিৎকার করছিলে ঝুম? " অরণ্য হাসবে না রাগবে বুঝতে পারেনা। এতক্ষণের টেনশনে ঘেমেচুমে একাকার হয়ে গেছে ও। এই মেয়ে ওকে মেরে ফেলবে একদিন, তাও হার্ট অ্যাটাক করে।
"হুমম"
অরণ্য কি বলবে বুঝতে পারলনা। ও এতক্ষণ কি নরক যন্ত্রনা ভোগ করেছে নিঝুম যদি সেটা একবার বুঝতো।
"অরণ্য আই অ্যাম ভেরি সরি টু ডিস্টার্ব ইউ, কিন্তু সত্যি আমি খুব ভয় পেয়েছি। তুমি ওগুলোকে বাইরে ফেলে দাও, প্লিজ।"
নিঝুমের কথায় এবার ওকে ধরে একদম একটা আছাড় লাগাতে ইচ্ছে হলো অরণ্যর। এখন এই রাত করে ও ইঁদুর মেরে বেড়াবে?
"মারছি তার আগে তুমি বাথরুম থেকে বের হও।"
"না... না প্লিজ। তুমি আগে ওদের দূরে ফেলে আসবে তারপর। "
"শোনো তুমি আমার রুমে গিয়ে বস,আমি এগুলোর ব্যবস্থা করছি।"
"না... তোমার রুমেও যদি থাকে?" চিন্তা করেই শিউরে উঠে নিঝুম।" আমি তাহলে ভয়েই মরে যাব। আমি তারচেয়ে এখানেই থাকি, তুমি ওগুলোকে এই রুম থেকে বের করো। "
অরণ্য আর সেলিম মিলে বহুকষ্টে একটা ইঁদুর মারতে পারল। বাকিগুলো যে কোথায় লুকাল কে জানে?
"সবগুলো গিয়েছে? " বাথরুম থেকে বের হয়ে জানতে চায় নিঝুম। অরণ্য হা করে তাকিয়ে থাকে। নিঝুম কি দিন দিন আরও বেশি সুন্দর হচ্ছে? হঠাৎ নিঝুমকে জড়িয়ে ধরার তীব্র একটা ইচ্ছা অরণ্যকে গ্রাস করতে থাকে, কিন্তু সেলিম ছেলেটা তখনও ঘরের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছে।
সেলিমকে একশটা টাকা বখশিশ দিয়ে এক্সট্রা চাবিটা ফেরত দিয়ে দিল অরণ্য। সাথে সকালে রুম সার্ভিসের লোক এসে যেন ভালো করে পুরো ঘরটা ক্লিন করে, ম্যানেজারকে সেটা বলা হলো। তা না হলে কালকেই অন্য হোটেলে চলে যাবে ওরা।
ফোন রাখতেই অরণ্যর পাশে এসে বসল নিঝুম।
"আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো। বাবা কি রকম ছোট ছোট আর জ্বল জ্বল করছিল চোখগুলো," কথাটা বলেই অরণ্যর হাত আঁকড়ে ধরে বসল নিঝুম। এত ভয় ও সত্যি অনেকদিন পায়নি।
অরণ্য এতক্ষণ পর এবার সত্যি হো হো করে হেসে উঠল, "যাক মুষিক রাজার অনেক ক্ষমতা.. আমার বউ সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে।"
" একদম হাসবে না, আমি আর একটু হলে ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করতাম তুমি জানে?"
অরণ্য এবার আর হাসল না। আসলে নিঝুম না, ওর মুড সুইং হচ্ছে বার বার। এই যেমন এখন প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে ওর ঝুমকে চুমু খাবার জন্য।
আর এটা না পেলেই ওর মেজাজ এখন তিরিক্ষি হবে।
"ঝুম...."
"কী "
" সরি সকালে ওই বাজে কথাগুলো বলার জন্য। আমি আসলে তখন"
"আমরা ওই বিষয়ে কথা না বলি।"
নিঝুমের জবাবে অরণ্যর মন আরও খারাপ হলো। ও যত চাইছে ঝুমকে সুখি রাখতে ততই উল্টো হচ্ছে।
"এক কাজ করি চল, বিচে যাই।"
অরণ্যর মুখে এমন কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠল নিঝুম," সত্যি....! কিন্তু এত রাতে? "
"তাতে কি? তোমার সাথে তোমার অরণ্য আছে না? "
"আচ্ছা তাহলে চলো যাই," প্রায় দৌড়ে স্যান্ডেল পায়ে ঢোকাল নিঝুম।
কিন্তু নিঝুমকে বলে অরণ্য নিজেই চুপটি করে বসে রইল।
"কি হল চলো "
"পাঁচ মিনিট এখানে একটু বসো।"
নিঝুম অবাক হলো অরণ্যর কথায়। অরণ্যকে কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। অবশ্য অনেক জার্নি করতে হচ্ছে ওকে। আজকেও আবার লং ড্রাইভই ছিল। হঠাৎ বুকটা চিনচিন করে উঠল নিঝুমের। নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে কি অরণ্যর উপর অত্যাচার করে ফেলছে ও? অরণ্যর হয়ত একদমই আসার ইচ্ছা ছিলনা, শুধু ওর জন্যই অনিচ্ছা সত্বেও এসেছে। কেমন একটা অভিমান হলো ওর অরণ্যর উপর, সাথে নিজের উপর প্রচন্ড রাগ।
ঝিম ধরে আসছিল অরণ্যর। আসলে ঘুমটা ওর হয়নি ভালোমতো। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সেটা দূর করার চেষ্টা করল ও। কিন্তু পাশে তাকাতেই ঘুমটা উড়ে গেল। নিঝুমের গালের উপর দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির বিন্দু ঝরে পড়ছে যে। নিঝুমের মুখটা যেন কুয়াশায় ঢাকা সূর্যদিন। বড্ড লোভ হলো অরণ্যর। কি হবে অত রাগ পুষে রেখে। সেই তো দিন শেষে অভিমানীটার কাছেই ফিরতে হবে ওকে..।
নিঝুম বুঝে উঠতেই পারলনা কি হচ্ছে, হঠাত করেই অরণ্য ওর মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে চুমো খেতে লাগল একের পর এক, অসংখ্য... ওর নাকে, মুখে, চোখে। কেমন পাগলের মতো চুমো খাচ্ছে অরন্য।
চমো দিতে দিতে কেমন হাঁফিয়ে গেল অরণ্য, তবু নিঝুমের মুখটা নিজের মুখের সাথে চেপে ধরে রাখল অনেকটা সময়। অরণ্যর এমন আচরনের সত্যি কোনো মানে খুঁজে পেলনা নিঝুম। মনে হলো মানুষটা অরণ্য না, আম্মু মাঝে মাঝে এমন করে চুমু দিত যেদিন অনেক মার খেত ছোটবেলায় আম্মুর হাতেই। কেমন একটা ভয় মেশানো ভালোবাসা থাকত ওতে। মনে হত নিঝুম যদি হারিয়ে যায়। কিন্তু অরণ্য এমন ভয় পাবে কেন ওকে নিয়ে?
"আমরা কি সমুদ্র দেখতে যাবনা? "
অরণ্য কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। রাইসুলকে ভুলতে পারছেনা ও। বার বার কেন যেন এই নামটা ওর মনের মধ্যে আসছে আর
কু ডাক গাইছে। নিঝুমের কিছু হওয়া যাবে না, নিজেই নিজেকে সতর্ক করল অরণ্য।
"কি হলো, আমরা যাব না বিচে?"
"যাব চল।"
ফুলহাতা গেঞ্জিটা গায়ে চড়াল অরণ্য। নিঝুমকেও বলল গায়ের ওড়নাটা দিয়ে গলা, কান ঢাকতে। এখন অনেক রাত। তবে আবহাওয়াটা ভালো আছে। আকাশ ভরা তারার মেলা। হোটেলে ম্যানেজারকে বলে বের হলো ওরা। ম্যানেজারকে বলল, কেউ ওদের খুঁজলে তাড়াতাড়ি অরণ্যর নাম্বারে কল দেয় যেন।
হাটতে হাটতে একদম পানির কাছে চলে আসল ওরা। এখন জোয়ার চলছে। পানি অনেক উপরে চলে এসেছে। বালির যে বস্তা গুলোর উপর দিয়ে বিকেলে সৈকতে নেমেছিল ওরা সেগুলো প্রায় ডুবু ডুবু।
চারদিক একদম শুনশান। লোক নেই বললেই চলে। একটা দুটো লোক আর রাস্তার কুকুর গুলোই যা ভরসা। আসলে একটু ভয়ভয়ও লাগছিল নিঝুমের। অরণ্যর গায়ের সাথে মিশেই সামনের দিকে এগুতে লাগল নিঝুম। অচেনা যায়গা, বলা যায়না কিছুই, ভুল সিদ্ধান্ত নিল কিনা ওরা এত রাতে বের হয়ে কে জানে?
তবে ভীষন মজাও লাগছিল নিঝুমের । আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের পানিতে সব চক চক করছে। সবচেয়ে সুন্দর লাগছে সমুদ্রের মাঝখানটা... মনে হচ্ছে যেন রূপো দিয়ে বাঁধানো। ঢেউ গুলো চিকমিক করছে, সেই ঢেউ যখন পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে তখন প্রচন্ড গর্জনে ওদের নিজেদের কথাগুলো পুরোপুরি চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে পানির উচ্চতা আরও বাড়তে লাগল। নিঝুমের খুব লোভ হচ্ছিল পানিতে পা ভেজায় কিন্তু অরণ্য চোখ পাকাতেই বাদ দিল। পচা একটা লোক। খালি এটা করোনা, ওটা করোনা। একটুও ভালো না।
"কি হলো... ম্যাডামের আবার মন খারাপ ?"
নিঝুম মুখ ভার করে, অন্যদিকে মুখ ঘুরাল।
"ঝুম এটা কক্সবাজার না, আর এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা বিচও না। দেখছ না এটা একদম মূল রাস্তা। একটু সামনে এগুলেই এবড়ে খেবড়ো। হঠাৎ ভিজতে ভিজতে যদি পানির টানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন তোমাকে বাঁচানো আমার সাধ্যের বাইরে।"
"পচা লোক একটা... ভীতু বগার ডিম একটা। তুমি তামিল ফিল্ম দেখো না, নায়করা কত কিছু করতে পারে আর তুমি কিচ্ছু পারো না। "
"আমার পারার দরকারও নাই। হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে আমি তোমাকে হারাতে পারবনা।ওর চেয়ে বউয়ের সামনে ভীতু বগার ডিম হয়ে থাকা ভাল। " মনে মনে বলল আমি আসলেই ভীতু হয়ে গেছি ঝুম,তুমি আসার পর থেকে তোমার অরণ্য ভীতু হয়ে গেছে।
"ইশশ এরচেয়ে একটা পাইলট বিয়ে করলে অনেক ভাল হতো, ওদের অনেক সাহস থাকে। কত উঁচু দিয়ে প্লেন চালায় বলতো। "
"আচ্ছা তাহলে একটা পাইলট পাত্রের বিজ্ঞাপন দেই পত্রিকায়, যে আমার বউয়ের জন্য একজন পাইলট পাত্রের দরকার। "
"পত্রিকায় সাথে সাথে অনলাইনেও দিয়ে দাও।"
"আচ্ছা পাত্রীর কোয়ালিফিকেশন কি দিব?"
"বলবা যে,পাত্রীর একটা রাগুটে টাইপ বর আছে, বিয়ের পর পাত্রী তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।"
নিঝুমের কথায় এবার হো হো করে হেসে ফেলল অরন্য। "তা হলে তোমার পাইলট বর করবে কি?"
"কেন? আমাকে বিদেশে ঘুরাতে নিয়ে যাবে।"
"আচ্ছা যেও। অল দি বেষ্ট ফর ইউর জার্নি বাই প্লেন। আমি কিন্তু তখন তোমার সাথে যাবনা। সতীন আমার ঠিক পোষাবে না। "
"অরণ্য "
"হমম"
"আমার না সত্যি পাইলট বিয়ে করার খুব শখ ছিল। তুমি প্লেন চালানো শিখে ফেলো।"
"বউ আমাকে মাফ করো। এখন আমার আর এনার্জি নাই, পরের জন্মে শিওর ট্রাই করব।"
"হ্যা তা তো করবাই, তখন দেখা যাবে তুমি কোনো বুড়ির চার নম্বর জামাই... হু।"
"সো স্যাড... তুমি আমাকে ছাড়াও আরও তিনটা বিয়ে করবা।"
"উগগ... এ কথা কখন বললাম? ফালতু যত কথা।"
"আমরা এতক্ষণ সব ফালতু কথাই বলেছি। কাজের কথা হলো এখন হোটেলে চলো।"
নিঝুম মুখটা কতক্ষণ এদিক ওদিক করে শেষে রাজি হলো।
"আচ্ছা ওয়েট " অরণ্য হঠাৎ নিঝুমের পা দুটো নিজের পায়ের পাতার উপর তুলে নিল দুহাত ধরে।
"এটা কি? " নিঝুম খিল খিল করে হেসে ফেলল। অরণ্য এক পা এক পা করে এগুচ্ছে ওকে সামনে নিয়ে। মাঝে মাঝে বাচ্চারা পায়ের পাতায় হাটে যেভাবে ঠিক সেরকম।
"বউয়ের মন খারাপ ভালো করার চেষ্টা করছি," নিঝুমের মনে হলো অরণ্য একটু বেশি বেশি ভালো। এতোটা ভালো ও না হলেও চলত। তারপরও নিঝুম ওকেই ভালোবাসত। আর মা বলে, বেশি ভালো জিনিস আবার ভালো না, সবার সহ্য হয়না।
কিছুদূর হাটতেই একটা ভ্যানের উপর কতগুলো ডাব চোখে পড়ল নিঝুমের। ওর এখন ডাব খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ভ্যানের পাশে কোনো লোক নেই। খোঁজা খুঁজি করে একটা লোককে পাওয়া গেল বেঞ্চের উপরে ঘুমাচ্ছে। নিঝুমের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত অরণ্যকে জিজ্ঞেস করতেই হলো ডাবের মালিক ওই লোক কিনা? ঘুম থেকে ডেকে তোলাতে ওই লোক অসম্ভব বিরক্ত ওদের প্রতি। একটা ডাব প্রায় সত্তর টাকায় কিনতে হল অরণ্যকে।
.......................................….........
বিছানায় বসে অরণ্যর শার্টের কলারটা ধরে টানতেই অরণ্যর চোখ কপালে উঠল। নিঝুমের হলো কি? এমন করছে কেন? কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল। হাসিও কেমন বেসামাল।
"ঝুম কি হলো বউ.. তুমি এরকম কেন করছো?"
ইঁদুরের উপদ্রপে নিঝুমের ঘরে থাকার কোন উপায় নেই, অরণ্যর রুমেই তাই দুজনের ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে অরণ্য।
কিন্তু ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দুহাত দিয়ে অরণ্যর চুলগুলো খামচে ধরে নিজের ঠোঁট দুটো অরণ্যের ঠোঁটের উপর চেপে ধরল নিঝুম। এই রকম দুঃসাহসিক কাজ নিঝুম আগে কোনেদিন করেনি.... বড়ো ধরনের গন্ডগোলের আভাস পাচ্ছিল অরণ্য।
অরণ্য শুধু অবাক হলো না, মহা অবাক হলো।
অরন্যর নাকে প্রথমে যে জিনিসটা এসে ধাক্কা দিল সেটা হলো নিঝুমের মুখ দিয়ে ভীষন রকমের ঝাঁঝালো একটা গন্ধ আসছে।
কিন্তু ঝুমতো ওর সাথেই ছিলো গত দুই ঘন্টা ধরে। একদম ওর বুকের কাছে ছিল। তাহলে তখন গন্ধটা পায়নি কেন অরণ্য? আর নিঝুম কোন কিছু খেলে সেটা ওর নজরে এলো না কেন ? নাকি একটু আগে যে ডাব খেল ওতে ছিল। কিন্তু সেটাতেই বা কি করে থাকে? লোকটাতো ওর সামনেই ডাব কেটে দিল। আর নিঝুমকে নেশা ধরিয়ে কার কি লাভ? না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আছে এর পিছনে।
নিঝুমের হাত ততক্ষণে অরণ্যর শার্টের একদম শেষ বোতামে চলে গিয়েছে।
"আমাকে একটু আদর করো প্লিজ। "
"পরে, আগে বলো তুমি কি খেয়েছ?"
"চুমু "
"ঝুম... আমি সত্যি সত্যি খাওয়ার কথা বলছি। তোমার মুখ দিয়ে বাজে গন্ধ আসছে। নেশা হয়ে গেছে তোমার," অরণ্য নিঝুমের মুখটা শুকে দেখল।
"কি জানি... আমি আরেকটা চুমু খাব।"
"একটা থাপ্পর খাবা, আমার কথার উত্তর দাও আগে। "
"উমম...পচা, " অরণ্যকে একটা কিল দিল নিঝুম ঠোঁট ফুলিয়ে।
"ঝুম প্লিজ তুমি আমাকে সাহায্য না করলে আমি তো রহস্য উদ্ধার করতে পারছিনা। কোথায় কি খেয়েছ বলো তো সোনা।"
"তাহলে আমাকে অনেক আদর করতে হবে, এই এত্তগুলা। "
নিঝুম পুরাই বেসামাল। কি বলছে কি করছে সব আবোলতাবোল।
"কিন্তু তোমার তো এখনও মাথা ঘুরছে।"
"হি হি হি... আমার! না তো। কেমন উড়ে বেড়াচ্ছি দেখছ না, " হেসে আবার অরণ্যর গায়ের উপর ঢলে পড়ল নিঝুম।
"উড়ো কিন্তু তার আগে আমার কথার ঠিকমতো উত্তর দাও।"
"কী? " বলেই নিঝুম অরণ্যর গাল দুটো ধরে দুদিকে টানতে লাগল পাগলের মতো।
"বলছি ডাব খাওয়ার সময় তোমার বাজে লাগেনি?"
"উমমম.... ডাবআলাকে চুমু কেন খাবো? তুমি কি এখন ডাবও বিক্রি করো? "
অরণ্যর গলায় চুমু দিতে লাগল নিঝুম পাগলের মতো। একদিকে নিঝুম আরেকদিকে রাইসুল। নিঝুমের পাগলামিতে ডুবতে ডুবতেও মাথার মধ্যে রাইসুলের নামটা ঘুরপাক খেতে লাগল
অরণ্যর।
নিঝুমকে জিজ্ঞেস করে করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল অরণ্য। কালকেই বরিশাল ব্যাক করতে হবে ওকে সবাইকে নিয়ে ৷ পারলে কাল রাতের লঞ্চেই ঢাকা চলে যেতে হবে। দ্রুত ডিউটিতে জয়েন করা দরকার। নিঝুমের আশেপাশে কড়া পাহারা রাখতে হবে। রাইসুল খুব বেপোরোয়া হয়ে উঠছে... সে নানা ভাবে অরণ্যকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
চলবে.....
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro