৪
পিউয়ের আগে এরকম কখনো হয়নি। বিগত দুই বছর ধরে শুধুমাত্র রিদম ছাড়া আর কারও চিন্তা বা কষ্ট ওকে ছোঁয়নি। কিন্তু আজকাল এই লোকটা ওকে ভাবাচ্ছে। লোকটা তেমন কোনো কিছু না করেও চোরাগলি দিয়ে ওর মনের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে নিঃশব্দে। পিউ চেষ্টা করেও আটকাতে পারছে না। ভোররাতে আজকাল ঘুম ভেঙে গেলে চুরি করে শ্রাবণের ঘুমন্ত মুখটা ও হা করে গেলে। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকাতে ভয় হয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে বলে প্রথম কয়দিন বেশ রাগ ছিল ওর শ্রাবণের উপর, কিন্তু লোকটা অনবরত ওকে গলানোর চেষ্টা করছে। প্রথম দিন বলার পর আর একবারও ওর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেনি, যদিও একবিছানায় মধ্যে বালিশ রেখে ঘুমায় ওরা। সাথে প্রতিদিনই বাইরে থেকে আসার সময় লোকটা কিছু না কিছু নিয়ে আসে ওর জন্য চকলেট, চিপস ধরনের। আর পিউ এগুলো কিছুই পছন্দ করে না। কিন্তু লোকটা নিজে পছন্দ করে, কারন ওর সাথে নিজের জন্যও আনে আর খায়। প্রথম প্রথম খুব বেশি বিরক্ত লাগলেও ইদানিং সেটা একটু একটু করে কমছে পিউয়ের। চকলেট গুলো না খেলেও ওর মধ্যে থাকা কেয়ারনেসটা ওর নজর কেড়েছে। লোকটা ওকে ছাড়া খায়না। ইদানিং লোকটা হাসলে হঠাত হটাত আনমনে হেসে ফেলে পিউ। তারপরই রিদমকে মনে পড়ে। হাসিটা তখন আর আসতে চায়না। পিউ যদি শ্রাবণের সাথে সংসার শুরু করে তাহলে রিদমের কী হবে?
রিদমকে কি মেনে নিবে শ্রাবণ? বিয়ের আগে রিদমের কথা তো শ্রাবণকে বলনি পিউ।
"আপনি এখানে কী চান?"
শ্রাবণের রূঢ় প্রশ্নে চমকে ওঠে পিউ।
"আমি... আমার কিছু বলার ছিল।"
"কিন্তু আমার তো আর কিছু শোনার নেই। আর অন্য কারো স্ত্রীর সাথে গোপনে কথা বলা আমি শ্রেয় মনে করি না। আপনি এখন আসতে পারেন।"
শ্রাবণ গম্ভীরমুখে জবাব দেয়। ওযে এত গম্ভীর হতে পারে পিউ জানত না।
"অন্যকারো স্ত্রী! দেখুন... আপনি.. আপনি ভুল বুঝছেন। আমি... "
পিউয়ের এখন খুব ভয় হচ্ছে। শ্রাবণের সামনে এভাবে ব্যাপারটা চলে আসতে পারে ওর ধারনা ছিল না। এখন কী হবে?
"ও ইউ স্যাটাপ প্লিজ।"
শ্রাবণের এরকম ভয়েসের সাথে একেবারেই পরিচিত না পিউ। কী রাগ হয়ে গেছে লোকটা। কিন্তু ও তো কোনো অন্যায় কাজ করেনি। ওকে ভুল বুঝছে লোকটা। রাহাতকে নিশ্চই ওর স্বামী ভেবেছে শ্রাবণ।
"এন্ড ক্যান ইউ প্লিজ লিভ নাউ? আমার কাজের জায়গায় বসে আপনার কাঁদুনি শুনতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। সরি বাট আপনি এখন আসতে পারেন। আর আমি হয়ত তেমন বিশ্বাসী লোক নই বাট তাই বলে অন্যের স্ত্রী চুরির দায় আমি নিতে আগ্রহী না। "
শ্রাবণের কথায় পিউ কথা হারিয়ে ফেলল। লোকটা তো ওর কোনো কথাই শুনছে না।
এরপরের ঘটনার জন্য পিউ একেবারেই তৈরী ছিলনা। শ্রাবণ বেল টিপতেই একজন লোক এসে ঢুকল ।
"দেখুন তো এর হাসব্যান্ড কোথায়? খুঁজে পাচ্ছে না বোধহয়। "
পিউ আর দাঁড়াল না, ছলছল চোখেই বেড়িয়ে এল ঘরটা থেকে। কী অপমান।
"কী ব্যাপার পিউ.. তোমার কী হয়েছে?"
রাহাত অবাক হয়ে দেখল পিউকে। পিউ বেশ শক্ত মেয়ে। রিকশা থেকে পড়ে হাত ভেঙে এসে ওকে বলছে আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে হবে। হাতটা বোধহয় ভেঙেই গেছে। কিন্তু তখনও ওর মুখ এত করুন ছিল না। রাহাত ওকে বহুদিন থেকে চেনে। বড়ো ধরনের কোনো কিছু হয়েছে মেয়েটার।
"কিছু না।"
"তুমি ডাক্তারের সাথে কী আলাপ করছিলে? কোনো বিশেষ কিছু? "
"রাহাত ও শ্রাবণ, আমার স্বামী।"
পিউ মাথা নিচু করে উত্তর দিল। কী অসম্ভব কথা... ওর চোখ দিয়ে পানি আসতে চাইছে কেন?
"কী বললে, উনি শ্রাবণ? চল তো দেখি কী হয়েছে?"
রাহাত কথাটা বলেই রুমের ভেতরে ঢুকে গেল। পিউ মানা করার কোনো সময়ই পেল না।
শ্রাবণের বিরক্তির মাত্রাটা এবার চরমে উঠল রাহাতকে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকতে দেখে।
" কী ব্যাপার! আমি তো প্রেসকিপশনে সব লিখে দিয়েছি। তারপরও আপনারা এরকম হুটহাট করে চলে আসছেন কেন বিনা অনুমতিতে? আমি কি একটু বিশ্রামও নিতে পারব না।"
শ্রাবণের চোখে মুখে বিরক্তির আভাস স্পষ্ট। কিন্তু রাহাত ওগুলো গায়ে মাখল না। ও শ্রাবণের জায়গায় থাকলে হয়ত এর চাইতেও খারাপ ব্যবহার করত।
"আমি একটু কথা বলতে চাই। আপনি কি কাইন্ডলি আমার কথাগুলো একটু শুনবেন। আমি আসলে বেশ কদিন ধরেই আপনার সাথে কথাগুলো বলতে চাচ্ছি.. মানে পিউয়ের আর রিদমের ব্যাপারে।"
রাহাতের কথা শুনে শ্রাবণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। রাহাতের পিছে পিছে পিউ আবার এসে এ ঘরে ঢুকেছে।
"শ্রাবণ আপনি যা ভাবছেন সেটা ঠিক না।"
রাহাতের কথায় শ্রাবণ ঠোঁট বেকিয়ে হাসল।
" ঠিকই বলেছেন। আমি যা ভেবেছিলাম, পিউ তার সম্পূর্ণ উল্টো । আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমার চেয়ে বড়ো বোকা দুনিয়ায় আসলেই আর নেই। মেয়ে নিজে সেধে বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিল আর আমি গাধা এক বাচ্চার মাকে পাগল হয়ে বিয়ে করলাম। কত বড়ো মাপের স্টুপিড না হলে কেউ এই কাজ করে। আমি... প্লিজ আপনার যান এখান থেকে। যা খুশি করুন, আমাকে জড়াবেন না আপনাদের কোনো কিছুতে। "
পিউ ঘুরে বের হতে যাচ্ছিল, রাহাত আটকালো।
"পিউ দোষটা কিন্তু ওনার না। আসলে, এই যে ছোট্ট বেবিটাকেে দেখছেন ও আসলে আমার আর কথার একমাত্র সন্তান। পিউয়ের সাথে ওর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। যা আছে তা শুধুই আত্মার, মানবিকতার। "
"মানে! বুঝলাম না। "
শ্রাবণ এবার প্রশ্ন না করে পারলনা, "আত্মার সম্পর্ক মানে?"
"আসলে পিউ আর আমার বউ কথা ছোটবেলার বান্ধবী। আমরা সবাই এক পাড়াতেই বড়ো হয়েছি।আমিই কথাকে প্রোপোজ করি প্রথমে। আমরা আমাদের ফ্যামিলিকেও আমাদের সম্পর্কের কথা জানাই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার পার্থক্যের কারনে পরিবার থেকে ব্যাপারটা মেনে নেয়নি। কথার পরিবার অনেক ধনী আমার পরিবারের থেকে।এক পর্যায়ে দুই পরিবারই অমত জানায়। কিন্তু আমরা সত্যি একজন আরেকজনকে ছাড়া ভালো থাকতাম না। শেষে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করে ফেলি। কেউ তেমন বাঁধা দেয়নি কিন্তু আমাদের সাথে সম্পর্কও রাখে নি। তারপরও আমরা নিজেদের মতো করে ভালো ছিলাম। সমস্যা যখন শুরু হলো তখন কথার কনসিভের পাঁচ নম্বর মাস চলছে। ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। নানা ধরনের কমপ্লিকেশন শুরু হলো। ও ঠিকমত কিছু খেতে পারত না, প্রচন্ড বমি, ডায়বেটিসের সাথে প্রেশার ধরা পড়ল। ডক্টর বলল প্রেগনেন্সিটা খুবই রিস্কি কথার জন্য। শেষে একদিন খুব খিঁচুনি শুরু হলো। রিদমের বেঁচে থাকাটাও খুবই অবিশ্বাস্য ঘটনা। কথা শেষ পর্যন্ত সারভাইভ করতে পারেনি। কথার সাথে এই পুরো সময়টায় আমি ছাড়া ওর একমাত্র সঙ্গী ছিল পিউ।"
এটুকু বলে রাহাত থামল।
শ্রাবণ রাহাতের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। এবার পুরো ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ওর মাথায় ঢুকেছে। কিন্তু মেয়েটা মিথ্যা বলল কেনো ওর সাথে? কোনো বিপত্নীক মানুষকে ভালোবাসা বা বিয়ে করা তো আর অপরাধ না। রিদম আর রাহাতের ব্যাপারটা সেদিন খোলাখুলি বললেই হতো ওকে।
" তারমানে কথা মারা যাওয়ার পর
আপনাদের মধ্যে রিলেশন শুরু হয়? আমি আসলে খুবই দুঃখিত। পিউ আমাকে বলেছিল আপনার কথা কিন্তু আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। আমি যদি না এগুতাম তাহলে হয়ত আপনারা এই সমস্যায় পড়তেন না। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব দ্রুত ডিভোর্সের পেপারটা সাইন করে দেয়ার। " শ্রাবণ লজ্জিত স্বরে বলল। খুব বড় একটা ভুল হয়ে গেছে ওর।
"না না শুনুন। আপনি আমার পুরো কথাটা না শুনে কোনো ডিসিশন নিয়েন না। আমাদের মধ্যে এখনও ভালো বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনো রিলেশন নেই আর ভবিষ্যতে হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই।" রাহাত মরিয়া হয়ে বলল।
শ্রাবণ একবার রাহাত, একবার পিউয়ের দিকে তাকাল।
"বুঝলাম না, আপনাদের মধ্যে কোনো রিলেশন না থাকলে পিউ আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? "
"দেখুন বিয়ে আমরা করতে চেয়েছিলাম এটা সত্যি, কিন্তু কারনটা ভিন্ন। আমরা বিয়ে করলেই একমাত্র রিদম, পিউকে লিগালি মা হিসেবে পেত। " রাহাতের স্বরে হতাশা।
"আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? পিউকে লিগালি মা কেন ডাকতে হবে আপনার বাচ্চার?" শ্রাবণ না বলে পারল না। এদের কথার
মাথামুন্ড কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।
রাহাত ভাবল খানিকক্ষণ, তারপর উত্তর দিল, "আসলে দায়টা আমার। পিউ ওর মা হলে, আমি শান্তি করে মরতে পারতাম।"
..............................................
পিউ কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। এরকম প্রশ্নের জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুখে স্বীকার না করলেও এই লোক যে পাগল, পিউ সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু তাই বলে এই?
কেউ কাউকে বুঝি এরকম বেহায়ার মতো ভালোবাসে? অবশ্য এই বিষয়ে ওর এলেম নেই। ও জনম ভর বই ছাড়া অন্যদিকে তেমন একটা তাকায়নি। বান্ধবী বলতে গুটিকতক বান্ধবী। তাও তাদের সাথে পড়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ হতো খুবই কম। আসলে ও সারাক্ষণ পড়ায় ডুবে থাকতে পছন্দ করে। আর অবসর বলতেও গল্পের বইগুলোই ওর সম্বল।বান্ধবীরা বলত ওর পছন্দ নাকি বুড়ো দাদীর মতো। কারন ওর পছন্দের তালিকায় সবার প্রথমে রুমির কবিতা থাকে, যে কিনা তের শতকের একজন বিখ্যাত কবি। অথচ ওরা কোনো দিন পড়েই দেখেনি কবিতাগুলো কি ভীষন ভালোলাগার।
যাই হোক ও না হয় বুড়ো দাদীই, কিন্তু ওর সাথে পাল্লা দিয়ে শ্রাবণ যে বুড়োদাদা হতে চাচ্ছে তার কী হবে?
"কী... আমাকে কি একেবারেই অপছন্দ? এই চরিত্রেও কি মেনে নেওয়া অসম্ভব?"
শ্রাবণের প্রশ্নে চিন্তার জালটা ছুটে গেল পিউর। এই লোক ওকেও রাস্তার পাগল বানিয়ে ছাড়বে। ওদের বাড়ির সামনে আগে একটা পাগলী ঘুরত। শোভা ছিল ওর নাম। কী যে কষ্ট লাগত ওকে দেখলে পিউয়ের। সাথে মায়াও।এই লোকে ওকে তাই বানিয়ে ছাড়বে।
"আমি কিন্তু এত খারাপও না, একটু ঘষে মেজে নিলে দিব্যি যে কোনো ধরনের কাজ করতে পারি। দরকার হলে পরীক্ষাও নিতে পারো।"
শ্রাবণের বলার ঢঙে পিউ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা, ফিক করে হেসে ফেলল।
"কিন্তু আপনি রিদমের বাবা হতে চান কেনো?"
চলবে......
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro