ভালোবাসা ভালো নেই
#ভালোবাসা_ভালো_নেই।
আমার কাজিনরা সব শহরবাসী। তাঁর মাঝে আবার #ঢাকা শহরবাসী। বাপরে বাপ! কি সুন্দর সিদ্ধ করে শুদ্ধ কথা বলে। আমি গাঁয়ের মেয়ে। আমার সর্বক্ষণ চেষ্টা থাকতো, আমিও ওদের মত সুন্দর করে কথা বলবো। আমি যতবারই গরমের ছুটিতে ঢাকা বেড়াতে যেতাম, কোনো না কোনো কাজিনের উপর ক্রাশ খেয়ে আসতাম। শুধু তাদের সুন্দর কথা বলার জন্য (আহা কি ব্যথা😣)
তো একবার এরকম (তখন আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি) কাজিনরা সবাই একসাথে হয়েছি ছোটমামার বাসায়। তুমুল আড্ডা বসছে। ঝালমুড়ি, পিঁয়াজু, জিলাপি, কোকের বোতল সব ফানা ফানা৷ (আমির খানের ফানা মুভিটাও তখন রিলিজ করেছে)! সেই আড্ডায় আমার একজন তাৎক্ষণিক ক্রাশ তৈরি হলো (কে জানতো সে'ই একদিন আমার জীবনের শেষ ভালোলাগা হবে)। নাম #রাকিব। সিফাত নামক এক কাজিনের কলেজমেট। দারুণ করে কথা বলে সে। চমৎকার সব বিষয়জ্ঞান। যে কোনো টপিকে ফ্লুয়েন্টলি ইন্টারেস্টিং করে অনেকক্ষণ বলতে পারতো। আড্ডার মধ্যমণি সে।(এসব আড্ডায় প্রতি সেকেন্ডে আশি-নব্বইডা কইরা বিষয় পয়দা হইতো)। একসময় আড্ডায় হুট করে বিষয় এলো, সবার এক্সট্রা কারিকুলার স্কিল নিয়ে কথা হবে। যেমন, পড়াশোনার বাইরে কে কি পারে? কেউ বলছিলো গান পারে, কেউ নাচ, কেউ ছবি আঁকা, কেউ ডিবেট, কেউ ভালো বাগান করতে পারে, কেউ খুব ভালো গিটার বাজায় এটসেট্রা এটসেট্রা..। একসময় আমার বলার পালা এলো, আমি গাঁইয়া মেয়ে। আমার ক্রাশকে মুগ্ধ করার জন্য শুদ্ধ করে বললাম,
"আমি তো হাতুর পারি, ডুব হাতুর, চিৎ হাতুর"
সবাই ইচ্ছামত হাসলো, হা হা.. হিহি। নীলা সাঁতাররে হাতুর বলছে৷#রাকিব হাসলো সবথেকে বেশি। আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে ভালোবাসা নামক অনুভূতিটার মত নিষ্ঠুর কিছু হয় না। এবং এরপর থেকে সেই #রাকিবই আমার কথাবার্তা নিয়ে মজা করতে লাগলো সবচেয়ে বেশি।
আরেকবার এক অনুষ্ঠানে খাবার টেবিলে আমি শুদ্ধ বলতে গিয়ে বলেছিলাম,
"এক পিস আলুর টোমা দেন" (টোমা মানে টুকরা, তাইলে পিস কি?)। তাও আবার #রাকিবের সামনে।
এরপর মোটামুটি যতবার তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে, সে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে খুব গম্ভীরভাবে বলেছে,
- তোমার হাতুর কেমন চলছে নীলা? আলুর পিস কি টোমা হয়েছে?
প্রথম প্রথম আমার রাগ লাগতো, পরবর্তীতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হতো সেও আর সবার মতোই সামনেরটা দেখে, আমার তাঁকে মুগ্ধ করার চেষ্টাটা দেখে না। তারপর অনেকদিন... যোগাযোগ নেই। যে যার যার মত দূরেই আছি। বড় হয়ে গেছি সবাই। কারো কারো বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ দেশের বাইরে কাজ করছে, কেউ দেশেই অনেক দূরে চাকরি করছে। একসাথে হওয়াও হয়না এখন।
এই হোম কোয়ারেন্টিনে একটা পুরোনো ব্যাপার নতুন করে ফিরে এসেছে। দূরের কাজিনরা, বন্ধু-বান্ধবরা সবাই খোঁজ খবর নিচ্ছে। ফোন করছে, হোয়াটস এপ করছে। বাচ্চার দাঁত উঠার ছবি দিচ্ছে। বাচ্চা হামাগুড়ি দিতে গিয়ে সাবান খেয়ে ফেলছে, সেই ছবি দিচ্ছে। বর রান্না করতে গিয়ে কড়াই পুড়িয়ে ফেলছে সেই ছবি দিচ্ছে। এক কাজিন ছবি দিলো, হাই কমোডের উপরের বসার ভাঙা ফ্রেমটা সে মোমের আগুনে গলিয়ে কিভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জোড়া দিয়ে ফেলেছে।
অনেক কাজিনদের ভীড়ে আমার রিসেন্ট একটা হোয়াটস এপ এলো,
- নীলা তোমার হাতুর কি এখন সাঁতার হয়েছে?
আমি মহাবিস্মিত, রাকিব!!!
- তোমার এখনো মনে অাছে এসব?
- হাতুর কেউ একবার শিখলে ভুলে না নীলা।
অনেক কথা হলো, সে দেশের বাইরে আছে। একটা কার কোম্পানিতে জব করছে। নিজের অফিসের ছবি দিলো, নিজের ছবি দিলো।
এক পর্যায়ে বললাম,
- তোমাকে মুগ্ধ করার কত চেষ্টা ছিলো আমার! সেজন্যই বলেছিলাম।
শুনে সে বেশ কিছুক্ষণ হাসলো।
- হবু দুলাভাইকে কি করে মুগ্ধ করলে?
- সে মুগ্ধ নয়। আমিও চেষ্টা করছি না। সম্বন্ধ করে বিয়ে হচ্ছে। কেউ কাউকে আগে থেকে চিনি না।
- সাঁতার দেখিয়েছো তোমার?
- আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি, সাঁতার পারি না এখন।
এক পর্যায়ে সে বললো,
- পছন্দ করতে বলোনি কেনো কখনো?
- কি হত? তুমিই তো সবচেয়ে বেশি মজা করতে? এত হাসতে আমাকে নিয়ে। সবসময় ক্ষেপিয়েছো?
- কেনো করতাম? সেটা ভেবে দেখেছো? শুধু তো তোমাকে নিয়েই করতাম! সিফাতদের বাসায় তুমি এলেই আমার যাওয়া হতো.. আমি কিন্তু এখনো বিয়ে করিনি! অথচ তুমি বিয়ে করে ফেলছো?
আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
- এখন কি করছো?
- এই যে তোমাকে খুঁজে বের করলাম।
- এতদিনে?
- আমি তো কিছু করতাম না। বেকার ছিলাম বলে খুঁজিনি। তাছাড়া আমাদের ইউনিভার্সিটি আলাদা হবার পর তো #সিফাতের সাথেও তেমন যোগাযোগ ছিলো না, তোমার খোঁজ কি করে নিই?। আর তুমি তো ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেলে নীলা?
- ইচ্ছে করে কেউ হারায় না! সুযোগই ছিলো না যোগাযোগের! কত দূরে থাকতাম আমরা।
আমার সাহস হলো না, তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এতদিনে কেনো খুঁজে বের করেছো?
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
সে আবার হোয়াটস এপ করলো,
- জানো নীলা? সবাই ভাবে, বলেও, ভালোবাসা ব্যাপারটা খুব সহজ; হলেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় খুব কঠিন। বলা যায় না। এই যে আমি এখনো তোমাকে বলতে পারছি না।অথচ জানি, এখন বললে কিছুই বদলাবে না। তুমি ঠিক বিয়ে করে নেবে!
ফোনের এ পাশে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাম্বারটা ব্লক করে দেয়া দরকার। ভাইয়া অফিস ফিরেই আমার ফোনে গেমস খেলে। যদি দেখে নেয়, মেরে ফেলবে আমাকে। দুদিন পর আমার বিয়ে, হাতে আংটি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার হবু, #সে দু-বেলা করে ফোন করছে, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কথা বলছি। আমরা ভালোবাসায় স্বার্থপর হতে পারি, বিয়েতে নয়। আমার পরিবার কথা দিয়ে দিয়েছে। বাবার মুখের কথার অনেক দাম। আমার মত সাধারণ মেয়ের পক্ষে সব ঠিকঠাকের পর বিয়ে করবো না বলা অসম্ভব।
তাছাড়া এত পুরাতন ভালোবাসায় এত জোর কই? থাকলে সে আগে আসেনি কেনো?
আমি #রাকিবের নাম্বারটা ব্লক করলাম। তাও স্বস্তি পেলাম না। হোয়াটসঅ্যাপ আনইনস্টল করলাম।
এবং উইশ করলাম পৃথিবীতে এমন ভালোবাসা কারো না হোক, যেটা বলার জন্য অপূর্ণ রয়ে যায়।
এখন এই এত বছরে এসে বুঝতে পারছি, আপনাদের ভাষায় যেটা #ক্রাশ আমার মত আদিনিবাসীনীর জন্য যেটা #ভালোলাগা সেটাতে মুগ্ধ করা বলে কিছু হয়না, নেই ও। প্রেম মানে দুজনের স্ট্যাটাস শেয়ার করা নয়, প্রোফাইল শেয়ার করা নয়, স্টারডম শেয়ার করা নয়, স্কিল শেয়ার করা নয়। প্রেম মানে হলো, দুজনের অনুভূতি শেয়ার করা। তোমার দুঃসময়, দুর্গন্ধ, দুশ্চিন্তা সব মিলিয়েই সে তোমাকে ভালোবাসবে। তুমিও তাঁকে। নাহলে এতগুলো বছর পর #রাকিব খুঁজে বের করতো না আমায়। ভালোবাসা একটা আলাদা টানের নাম। অনেক বছর না দেখেও, অনেক বছর কাছে না থেকেও যেটা টানে সবসময়। সবসময়।
হয়তো কখনো কখনো কাছে আসা হয়, কখনো কখনো দূরে থেকেও যেটা নিজের ভালো থাকা, না থাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার ক্ষেত্রে হয়তো ভালোবাসা দূরে থেকেই সব নাড়িয়ে দিয়ে গেলো আবার।
পরিশিষ্ট: আমার বিয়ের মাসখানেক বাকি। ইদানীং আমার হবু #সে ফোন করলে আমার রিসিভ করতে ইচ্ছে করে না। মা ধমক দেয়। আমি ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকি। সে দুনিয়ার কথা বলে। আমি চুপ করে একটা মিরাকেলের জন্য অপেক্ষা করছি। ভালোবাসার মিরাকেল। হয়তো #রাকিব আসবে। বিয়ে ভাঙবে আমার। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, নীলার সাথে আমার সারাজীবনের হাতুর শেষ করতে চাই।
কে জানে হয়তো কোনো মিরাকেলই হবে না। হয়তো এরকম দূরে থেকেই আমি আর সে জানবো কিছু একটা ছিলো, কিংবা আছে। উঁহু আমাদের দুজনের চুপচাপের মাঝেই রয়ে গেছে। থেকে গেছে ভালো না থাকা "ভালোবাসা"!
#তৃধা_আনিকা
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro