বেহিসেবী ল্যাভেন্ডার
একটা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে ল্যাভেন্ডার ফুলের সমাবেশ, মাঠের ঠিক মাঝামাঝি একটা মাঝারি গড়নের বাগান বাড়ি, আর সকালের নরম রোদ্দুর... সব মিলিয়ে একটা বেশ মায়ায় মোড়া জায়গায় সরু আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে অনি। চারপাশ ম ম করছে সদ্য ফোটা ফুলের গন্ধে। ওর শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে সোনামাখা রোদ্দুরের আলতো আদর।
অনির এখনো এই সবটাকেই ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন মনে হয়। ওর ভাবতে ভারী অবাক লাগে, ওর এই পৃথিবীতেই অস্তিত্ব রয়েছে অথচ কারোর ওর শরীর নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, সংকীর্ণতার দাঁড়িপাল্লায় মেপে ওর পরিচয় নির্ণয় করার প্রয়োজন নেই, ওকে ভেঙেচুরে নিজেদের চেনাজানা গুটিকয়েক 'সামাজিক' ছাঁচে বসিয়ে দেওয়ারও অবকাশ নেই... এও কি বাস্তবে সম্ভব?
প্রাতঃভ্রমন শেষে, ও ফিরে চলে ওর ক'দিন আগে কেনা এই ফার্ম হাউসটার দিকে। পাশের ঝিলের ধারে ছিপ হাতে ওর বড্ড প্রিয় মানুষটাকে বসে থাকতে দুর থেকে দেখে, ওর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি ফুটে ওঠে। অনি জানে যে এই মানুষটাকে যদি উপহার হিসেবে ও একটা আস্ত আকাশও এনে দেয়, তাও হয়তো কম হবে... তবে সে নিজে মুখ ফুটে অনির কাছে একটা ফুলের পাপড়িও চাইবেনা কখনো।
♡
অনি যখন আর্ট কলেজে ফাইন আর্টস-এ গ্রাজুয়েশন করছে, তখনই ওর দেখা হয় তিতাসের সঙ্গে, ওরা ছিল একই ডিপার্টমেন্টে সহপাঠী। অনির কোনো দিনই খুব বেশি বন্ধু ছিল না। অনি বেশিরভাগ জীবনটা কাটিয়েছে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, রক্তের সম্পর্ক হোক বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সবক্ষেত্রে দিনের শেষে ওই আঘাত পেয়েছে। এমনকি স্কুলে পড়ার সময় টমবয় বলে যথেষ্ট বুলির শিকারও হতে হয়েছে ওকে।
তাই কোনো সম্পর্কই যে নিঃশর্ত হতে পারে না, এই ধারণা ওর মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। সেই জন্যই তিতাস আগ বাড়িয়ে একদিন বন্ধুত্ব করতে এলেও অনি সেই ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি। পরে একটা গ্রুপ প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করার সময় ধীরে ধীরে তিতাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় অনির। ওদের ভাবনা, চিন্তা, ব্যক্তিত্ব, ব্যবহার-আচার সবকিছুই অদ্ভুতভাবে মিল গিয়েছিল। পার্থক্যের মধ্যে শুধু ছিল অনির চুপচাপ থাকা আর তিতাসের সেই নিস্তব্ধতার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বকে চলা। ওদের এই সম্পর্কে সত্যিই কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেব ছিল না।
কলেজের শেষ সেমিস্টারের সময় তিতাসই প্রপোজ করেছিলো অনিকে। অনি কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে হোস্টেলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তিতাসও চুপচাপ ফিরে গিয়েছিল নিজের হোস্টেলে।
ওই দিনই বিকালে তিতাসের রুমের কলিংবেলটা বেজে ওঠে, দরজা খুলতেই মুহুর্তের মধ্যে অনি ঘরে ঢুকে এসে তিতাসের ঠোঁটে একটা চুম্বন এঁকে দেয়। প্রাথমিক চমকটুকু কাটিয়ে তিতাসও ওর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে প্রবেশ করে ওর ঠোঁটের গভিরে। ওদের হাতগুলো একে অপরের শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ স্পর্শ করতে থাকে। সেই ওদের প্রথম আদর। আদর শেষে ওরা একে অপরকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ শুয়েছিল হোস্টেল-এ তিতাসের রুমের ক্যাম্প খাটটায়। নিজেদের কথা দিয়েছিলো কোনোদিন ওদের এই ভালোবাসায় কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেব রাখবে না।
তারপর কেটে গেছে প্রায় পনেরোটা বছর। অনি আজ বিখ্যাত রিয়েলিস্টিক পেন্টার, আর তিতাস হলো একজন নামী কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। অনি মনে মনে ভেবে দেখে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের গ্যাঁরাকলটা আজও ওদের নাগাল পায়নি।
♡
অনির সম্বিৎ ফেরে ওই মানুষটার অর্থাৎ ওর তিতাসের উৎফুল্ল আহ্বানে ...
"অনি ! কি রে, তোর মর্নিং ওয়াক হল? এবার আয় তো একটু, বস না আমার পাশে।" আদুরে গলায় তিতাস ডেকে ওঠে।
"আসছি", একগাল হেসে অনি ছুট্টে গিয়ে বসে তিতাসের পাশে। তিতাসকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখে... "উঠলি কখন ঘুম থেকে? ভোরবেলা আমি মর্নিং ওয়াকে আসার আগে তো দেখে এলাম, বেশ ঘুমের ঘোরে নাক ডাকছিলি", জিজ্ঞেস করে ওঠে অনি।
"ওই তারপরেই উঠে পরলাম... ভাবলাম এমন একটা সুন্দর সকালের মিষ্টি আলোয় আমার সুহৃদকে কেমন লাগছে, সেটা না দেখলে তো গোটা দিনটাই পানসে হয়ে যাবে।" চোখ পিটপিট করে কৌতুকের স্বরে উত্তর দেয় তিতাস।
ঠোঁটের কোণে একটা চঞ্চল হাসি খেলে যায় অনির। হঠাৎ তিতাসের শার্টের কলার ধরে ওকে কাছে টেনে নেয় ও, "তাহলে আমাকেও বল...ঠিক কি দেখলি তুই?" প্রশ্ন করে অনি। ততক্ষণে ওরা দু'জনেই অনুভব করতে পারছিল একে অপরের ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস, উত্তেজিত হৃদস্পন্দন, শরীরের মৃদু কম্পন।
অনির এই হঠাৎ আক্রমণে বেশ খানিকটা চমকে উঠলেও, একেবারেই অবাক হয়নি তিতাস। দু'জনে এর থেকে অনেক বেশি কাছাকাছি ওরা এর আগেও বহুবার এসেছে, কিন্তু এই সুন্দর সকাল, ল্যাভেন্ডার ফুলের মাঠ, ঝিলের ধারের খোলা হাওয়া... সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা নেশা আছে আজ। অনির আর কিছু বলে ওঠার আগেই ওর ঠোঁটে আলতো করে আঙুল রাখে তিতাস, আর কয়েক মুহূর্তেই একে অপরের ঠোঁটের মায়ায় হারিয়ে যায় ওরা দুজন।
মাছ ধরার ছিপটা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে থাকে ঝিলের ধারে। ল্যাভেন্ডারের ক্ষেত থেকে ভেসে আসা মাতাল করা গন্ধ জানান দেয়, বসন্ত এসেছে।
© ঈপ্সিতা মিত্র পুপু
* এই গল্পে ব্যবহৃত সমস্ত ছবিগুলি Pinterest থেকে সংগৃহীত *
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro