নিনীকা ১৮
হলুদের রাতে নিনীকা এক ফোঁটা ঘুমানোর সুযোগ পেলো না। শেষরাতে ঘরে একটু একা থাকবার সুযোগ পেয়েছিলো অবশ্য; বড়ফুফু এসে বাগড়া দিলেন। নিনীকার বিছানায় শুয়েই বললেন, নিনীকা দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে তুই অন্য ঘরে যাতো। অামি তোর ফুফার সাথে একটু কথা বলবো ফোনে।
------কথা বলবে তো, অামার সামনেই বলোনা। অামি ডিস্টার্ব করবোনা।
নিনীকা শুয়ে পড়লো পাশেই, রাত জাগনা তাঁকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। পেট পাকাচ্ছে, ক্ষুদা নষ্ট হয়ে গেলে যেমন লাগে। মাথা বিশ্রী জ্বালা করছে।নিনীকা উঠে গিয়ে একটা ৭.৫ মিলিগ্রামের মিরটাজ গিলে নিলো। ব্যস এখন দু-ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলেই, সারাদিনের ধকল নেয়ার জন্য শরীর রেডী হয়ে যাবে।
নিনীকা ঘুমোনোর চেষ্টা করলো।
কিন্তু বড়ফুফু এত হাই টোনে কথা শুরু করলেন যে ঘুমানো ইম্পসিবল। নিনীকা উঠে বাথরুমে গেলো।মুখে-চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিজের দিকে তা্ঁকালো একটু! ক্লান্ত, দুঃখী চেহারা। নিনীকা হাসার চেষ্টা করলো।
অাচ্ছা সব মেয়েরই কি বিয়ের সময় এমন ক্লান্ত লাগে??
অবসাদ ভাংতে নিনীকা গুণগুণিয়ে উঠলো,
"পুরোনো এক প্রেমের গল্প সত্য কিংবা মিছে,
"সম্পর্কের এই ভাংগা গড়া অাতস কাঁচের নিচে......
না গান ভালো লাগছে না। ওষুধের একশান শুরু হয়ে গেছে.... চোখের পাতা ভারী লাগছে।
কমোডের ঢাকনা
ফেলে তাঁর উপর ফ্লাশে হেলান দিয়ে বসলো সে, এভাবে একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়? এরকম তো সে অনেক ঘুমিয়েছে অাগে!!
নিনীকার ঘুম ভাংলো, বড় ফুফুর চেঁচামেচিতে। তিনি দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ করে ধাক্কাচ্ছেন। নিনীকা দরজা খুলতেই বললেন,
-------কিরে নিনী? পেট খারাপ করেছে নাকি? পেট খারাপ কি করে হলো? ওষুধপাতি খেয়েছিস কিছু?
নিনীকা জবাব দিলোনা, গাঢ় ঘুমটা ভেঙ্গেছে তাঁর।শরীর টলছে।টালমাটাল শরীর টেনে নিয়ে সে কোনোক্রমে বিছানায় এসে ধপাশ করে শুয়ে পড়লো!
বড়ফুফু অাৎকে উঠলেন। প্রায় চিৎকার করেই বললেন,
------ ও মাই গড! তোর তো সিরিয়াস অবস্থারে নিনী।শরীর তো পুরো ছেড়ে দিয়েছে। ক'বার হলো? বেশি পাতলা??
নিনীকা জবাব দিলোনা। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তাঁর! এক রাজ্যের ঘুম!
দশমিনিটের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বড় ফুফু ব্যাপারটা মোটামোটি সারা দুনিয়া করে ফেললেন। নিনীর পেট খারাপ! শরীরের পানি শুকিয়ে গেছে। সে শোয়া থেকে উঠতেই পারছেনা।
মাহবুবা এবং নিনীকার পাপা চিন্তিত হয়ে নিনীকার ঘরে গেলেন।
এর ফাঁকে ফুফু, বুদ্ধি করে রওনককেও একটা ফোন করে দিয়েছেন।হাজার হোক হবু বৌ বলে কথা। ছেলেটার তো জানা দরকার!
রওনক এই খবর শোনবার পর দিশেহারা! নিনীকার ফোন বন্ধ।সে কি একবার দেখতে যাবে? অনেক ভেবে সোহেলকে পাঠালো।
সোহেল এসেই বলল,
-------স্যার ম্যামের সাথে ২মিনিট কথা বলতে চান।এখন মেডামের কি কন্ডিশন?
বড়ফুফু রেগে বললেন,
-------মেয়েটা লাশ হয়ে পড়ে অাছে, তুমি এসেছো ফোন করাতে! গাঁধাছেলে!
সোহেল কাচুমাচু মুখে দাড়িয়ে থাকলো।
এই রওনক স্যারের বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে সে সমানে ধমক খেয়ে যাচ্ছে।
নিনীকার পাপা'ই গেলেন দেখতে। নিনীকা ঘুমিয়ে অাছে। তিনি পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। নিনীকা নড়ে উঠলো হালকা।বিড়বিড় করে বলল,
------পাপা ১০মিনিট ঘুমাবো, অামি।এরপর তুৃমি বিয়ের কনেকে ডাকতে অাসবে।
-------তোমার কি শরীর খারাপ মামণি? ওষুধ খেয়েছো? স্যালাইন..
নিনীকা ধরফর করে উঠে বসলো।সবাই তার ঘরে। সে বিস্মিত।
লজ্জিত মুখে বলল,
-------অামার খুব ঘুম পেয়েছিলো মা! পরীক্ষার অাগের রাতের মত....বড়ফুফু ভেবে নিলো.....
দাদীমা বড়ফুফুর দিকে রাগী চোখে তাঁকালেন,
------বুইরা গাধী।এ হলো বিয়ের 'কালঘুম'! যার বিয়েতে এমন কালঘুম পায়, সে সারাজীবন স্বামী সোহাগী হয়!
এদিকে তোর জামাই তো তাঁর ম্যানেজারকে পাঠিয়েছে খোঁজ নিতে!
মাহবুবা সোহেলকে ভেতরে ডাকলেন।
সোহেল বিনীত ভাবে মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
------ম্যাম, স্যার লাইনে অাছেন। নিনীকা ফোনটা হাতে নিয়ে বড়ফুফুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকালো।বড়ফুফু চট করে বেড়িয়ে গেলেন।
নিনীকা হ্যালো বলতেই,
ওপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠে রওনক বলল,
-----অাপনি এখন কেমন অাছেন ডক্টর?
------অাপনাকে কে খবরটা দিলো?
রওনক জবাব দিলোনা। নিনীকা হতাশ গলায় বলল,
-------এত চিন্তা করবেন না নায়ক সাহেব। বিয়ের টাইমের কোনো নড়চড় হবে না।প্রেসের কাছে লজ্জা পাবেন না; অাপনি! দরকার হলে ডায়াপার পরে অাসবো, তাও ডিউটাইমে বিয়ে হবে অামাদের।
পাপা হেসে ফেললেন।সোহেলের হাসি পেলেও সে সামলালো নিজেকে।
রওনকের চিন্তা অারো বেড়ে গেলো।ডায়াপার পরে মানে? এত খারাপ অবস্থা হলো কি করে মেয়েটার! ডাক্তার হয়েও নিজের শরীর নিয়ে এত লা-পরোয়া কেউ হতে পারে? নিজের বিয়ের দিনে অসুস্থ! রওনক কি একবার দেখতে যাবে?
যাওয়া কি ঠিক হবে?
সকাল ৮টা নাগাদ রওনক এসে হাজির হলো।নাসিদা খালা এসে অত্যন্ত অানন্দিত মুখে খবর দিলেন,
-------ও ছুডু মেডাম। স্যার অাসছেন, অাপনারে দেখতে! সাথে দুনিয়ার মিষ্টি! অামারে দিলেন এক গাড়ি কালো মিষ্টি।এত মিষ্টি খাইবার টাইম কই অামার?
খবরটা শুনে বিরক্তিতে নিনীকার মুখ তেতো হয়ে গেছে।পেট খারাপ শুনলেই অাসতে হবে? এত বড় নায়কের বুদ্ধির এই হাল! বাড়িভর্তি গেস্টরা কি ভাবছে?স্লিভলেসের উপর কুর্তিটা চাপিয়ে নিয়ে নিনীকা চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ করে নিচে নামলো। নিচের হলে সবাই রওনককে ঘিরে বসে অাছে! রওনক অাজ এ বাড়িতেই সকালের নাশতা করবে।
রওনক এসে পড়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। সবাই তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। এরকম জানলে সে অাসতোই না।
রওনক এসেই শুনছে, নিনীকার অসুস্থতার খবরটা ভুয়া। লজ্জায় তারঁ মাথা কাটা যাচ্ছে এখন! সে চিন্তাই করতে পারছে না, ফুফুশাশুড়ি শ্রেণির কেউ তাঁর সাথে এমন ধরনের মজা করতে পারে?
এখানে তাঁকে সকালের নাশতা খেয়েই যেতে হবে। রওনক একটা জরুরি ফোনকলের কথা বলে, সবার সামনে থেকে সড়ে একটা নিরিবিলি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য ঝটপট একটা সিগারেট খেয়ে নিতে হবে।তাহলেই মাথা ঠান্ডা।পরিস্থিতি সামলানো যাবে ঠান্ডাভাবে।
নিনীকার এখনিই রওনকের সাথে কথা বলা দরকার। লোকটার কি বুদ্ধি কিছু নেই?? অাসবার অাগে নিনীকাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো একবার?? রওনককে পাওয়া গেলো, পাপার স্টাডিরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অাছে।হাতে কফিমগ! ধোঁয়া কেনো? সিগারেট ফুঁকছে নাকি?
নিনীকা যেতেই রওনক থতমত খেয়ে গেলো, অাঁধখাওয়া জ্বলন্ত সিগারেটটা ডুবিয়ে দিলো কফিমগে। নিনীকা যেনো দেখতেই পায়নি, এমনভাবে বলল,
-------বিয়ের দিনে শুশুড়বাড়িতে সকালের নাশতা করতে এসেছে, এমন বর বোধহয় ইতিহাসে অাপনি প্রথম!!
নোবেল দেয়া দরকার অাপনাকে।মেডেল কি স্বর্ণের চাই????
রওনক মাথা চুলকালো। নিনীকা রওনকের অারো একটু কাছে দাড়ালো , চোখের দিকে স্ট্রেট তাকিয়ে বলল,
------অামায় বলে অাসলে কি হত??সবাই কি ভাবলো??
------অাপনার ফোন বন্ধ ছিলো ডক্টর! অামি ভাবলাম বেশি অসুস্থ!
-------এই জন্য পুরো এক দোকান মিষ্টি নিয়ে চলে এসেছেন। এত বুদ্ধি অাপনার!
রওনক চুপ করে থাকলো! এই মেয়েটা এমন কেনো? বিয়ের দিন বরকে কেউ এমনভাবে ধমকায়? ডক্টর নিনীকার মাথা কি ঠিক অাছে? সেদিন দেখা গেলো, কাঁথা মুড়িয়ে ছিলেন, অাজ ২পায়ে ২রকম জুতো,পড়নের কুর্তিও তো উল্টো মনে হচ্ছে, পেছনগলা সামনে।
রওনক যথাসম্ভব সিরিয়াস ভাব করে বলল,
----- অামায় বলা হয়েছে, অাপনার এক্সট্রিম কন্ডিশন। মিনিমাম কার্টেসি রক্ষার্থে এসেছি।
------অার এসে অামার সাথে দেখা না করে, এখানে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছেন??কফি খাওয়া শেষ করে সোজা বাসায় যাবেন।নাশতা বাদ! বাড়িময় গেস্ট! সবাই হাসছে
------কফি শেষ তো অামার!
নিনীকা মুখ বাড়িয়ে বলল,
------কই দেখি?
রওনক এক চুমুকে সিগারেট সুদ্ধু কফি গিলে নিলো। নিনীকা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
-------এরকম কপাল কুঁচকে অাছেন কেনো? কফি ভালো হয়নি?
রওনক চোখ গরম করে তাঁকাতে গিয়েও তাঁকালো না। এই মেয়েটার এখন অনেক অধিকার, ভুল বুঝার অধিকার, রাগ করার অধিকার!ফট করে অাবার ঝামেলা বাঁধাবে।
নিনীকা বিরক্তি ঝরা গলায় বলল,
--------অাপনার বুদ্ধি যে ভালো না অামি জানতাম। কিন্তু এই লেভেলের, তা জানতাম না!
রওনক অাহত গলায় বলল,
------অামার অন্যসব নিয়ে কথা বলুন ঠিক অাছে, কিন্তু অামার অাইকিউ লেভেল নিয়ে কথা বলবেন না, প্লিজ ডক্টর! ছাত্র হিসেবে অামি কিন্তু খারাপ ছিলাম না।হিস্ট্রিতে এম.এ ফার্স্ট ক্লাস অামার।
নিনীকা ভ্রু কুঁচকে তাঁকালো। অামার সাথে তর্ক করা।এখনি অাই কিউ শেখাচ্ছি তোমাকে! ওয়েট!
খুব শান্ত গলায় নিনীকা বলল,
------ হিস্ট্রিতে এত ভালো!! ওহ অাই সি! তাহলে ইতিহাসের একটা ছোট্ট টেস্ট নিই অাপনার নায়ক সাহেব!
রওনক মাথা নাড়লো।
নিনীকা রওনকের হাত থেকে কফিমগটা নিয়ে এর ভেতর দেখতে দেখতে বলল,
-------একটা সহজ প্রশ্নের উওর দিন তো। বাংলা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে এমন একটি বর্ণ অাছে, যেটিতে অামাদের প্রাচীন ইতিহাসের একজন রাজা এবং রাণীর নাম হয়। বর্ণ একটাই! দেখি বলুন।
রওনক হতভম্ব গলায় বলল,
--------এখনি বলতে হবে?
-------অাচ্ছা অাপনাকে ভাববার সময় দেয়া হলো।
যখন বলতে পারবেন তখনি বিয়ে হবে। শর্ত হলো, নো গুগলসার্চ, নো হেল্পলাইন! নিজে ভেবে উত্তর দিবেন। না পরলে 'পাস' বলবেন! প্রশ্ন বদলে দিবো।
-------এনি ক্লু?
-------প্রশ্নটা অারো সহজ করে দিলাম, এই বর্ণে একটা ছেলের ও একটা মেয়ের নাম চাইলে রাখা যেতে পারে!!!এবার ভাবুন....
রওনকের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই প্রথম তাঁর মাথা বুদ্ধি শূন্য হয়ে লাগছে...ইতিহাসে তো এসব পড়েনি সে? তাহলে??
.
নিনীকা হাই তুলতে তুলতে চলে যেতে গিয়ে ফিরে তাঁকালো, রওনক একটা সবুজ টি-শার্ট পড়ে এসেছে।ক্লিন শেভড! মনে হয় যাস্ট শাওয়ার নিয়ে এসেছে।ফ্রেশ লুকিং! পায়ে ঘরে পড়ার দিন-রাত্তিরের নরমাল স্লিপার।ফর্সা পাশের নখগুলো পর্যন্ত ঝকঝকে। কি সুন্দর সমান শেপে কাটা! নিনীকা নিজের পায়ের দিকে তাঁকালো, তাঁর ২পায়ের নখ দুরকম ভাবে কাটা। ডানপায়েরটা বাঁকা হয়ে কোণা উপরে উঠে অাছে।পায়ের নখদুটো এখনি সমান করে কাটতে হবে। তাঁর পায়েও দুটো ভিন্ন জুতো, একটা পাপার, অার একটা কার? বিয়ে বাড়িতে জুতোরও হদিস নেই। উফ!
নিনীকা দ্রুত বেড়িয়ে এলো, এত গুছানো নায়কের বৌ উল্টো জামা গায়ে। অহো.......
রওনকের জোড়া ভ্রু অারো কুঁচকে গেলো।বিয়ের দিনে ছেলেরা নাকি একদিনের বাদশা বনে! সে বনেছে ছাগল। মহা ছাগল! একটু অাগে সে খেলো, সিগারেট মেশানো কফি! এখন তাঁকে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে হচ্ছে। কি এমন বর্ণ! যাতে রাজা রাণীর নাম লুকানো? রওনক বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো,
অ অা ই ঈ.........
ও মাই গড! ক খ গ ঘ তো সে সব ভুলেই গেছে!!!!
সর্বনাশ...........
বর্ণ পরিচয় কিনতে হবে একটা!
(চলবে)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro