৪৪
হেমন্তের বিকেলটা কেমন যেন মন খারাপের রঙ জড়ানো, গায়ের চাদরটা গলা অব্দি তুলেও শীত শীত ভাবটা এড়ায় না সুমনের। কাল অবেলায় চুল ভিজিয়ে আজ সকাল থেকে শুধু নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ওর। সেই থেকে এ পর্যন্ত নির্মলা ছয়বার চা করে দিয়ে পাঠিয়েছেন কিন্তু শ্রাবণের মনে হচ্ছে মেয়েটার এবার জ্বর আসলো বলে।
" তুই কথা কেন শুনিস না বল দেখি, কাল অত বেলা করে গুষ্টিশুদ্ধ সবার ভাত রাঁধতে কে বলেছিলো, তাও আবার একশ পদ করতে হবে, ভারী এক রান্না শিখেছেন উনি," শ্রাবণ অভিযোগ করতেই থাকে, আসলে সেই সকাল থেকেই করছে।
কিন্তু সেই একই অবস্থা, শ্রাবণ নিজের মতো করে এক পাথরের দেয়ালের সাথে বকে চলেছে, কারো তাতে কিচ্ছুটি এসে যায় না। সুমন শুধু ওর কথা শুনে, কখনো কোন উত্তর দেয় না। বাইরে থেকে মনে হবে সুমন এখন বড়ো হয়েছে, সমঝদার হয়েছে কিন্তু আদতে শ্রাবণ জানে, সুমন ওর উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। মৌন প্রতিশোধ, প্রতি মুহুর্তে তিল তিল করে ওকে কষ্ট দিচ্ছে আর শ্রাবণ জানে এই তিল থেকেই একদিন তাল হবে। কেমন রঙ মিলিয়ে যাওয়া বাষ্পের মতো অনুভূতিহীন হয়ে গেছে ওর আদরের বউটা, মোহনার কথাগুলো মনে হয়...' তুমি তো মন পড়তেই জানো না। '
সত্যিই তো, শ্রাবণ তো মন পড়তেই জানে না। নাহলে এতোবড়ো ভুল ও করলো কি করে? কিন্তু ওর সাজার মেয়াদ কতোদিন, সেই শাস্তি আর কতো ভারী?
সুমনের মনে হয় আজকাল বসে থাকলেও ওর মাথা ঘুরায়, হাতড়ে হাতড়ে ঘরের সাথের লাগোয়া বাথরুমটাতেই গিয়ে দাড়ায় ও। থেকে থেকে বমি পাচ্ছে খুব কদিন থেকে, গলায় চিরবিরে কিছুর অনুভব, তারপরই চারপাশটা একদম অন্ধকার হয়ে আসে সুমনের।
"এতোক্ষন কি করছিস, অ্যাই সুমো? "
ভারী কাঠের দরজাটা ঠকঠক শব্দ করে কেঁপে উঠে।
সুমনের দম মারা ভাবটা কাটে, কেমন এক ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলো ও... খেয়ালই নেই যে কল থেকে জল তখনও গড়িয়েই যাচ্ছে। তোয়ালটা মুখে চেপে ধরে বের হয়ে আসে ও।
লক্ষ্য করে শ্রাবণ চেয়ারে বসেই ওকে তেরছা চোখে দেখছে।
বিয়ের দু'মাস পেরিয়ে গেলেও সুমনের গায়ে মাংসের চেয়ে হাড়র সংখ্যা বেশি দেখায় এখনো। অথচ আগে হালকা পাতলা থাকলেও কখনই এমন রুগ্ন দেখাতোনা সুমোকে। খচ করে যন্ত্রনাটা খোঁচা মেরে জানিয়ে যায় সব ওর দোষ, ওকে যন্ত্রনা দিতে মহারানী কিছু মুখে তুলেন না।
"এতোটা সময় বাথরুমে কি করলি?"
" মুখ ধুলাম, " সুমন অনিচ্ছার সাথে উত্তর দেয়, শ্রাবন শুধু অহেতুক প্রশ্ন করে আজকাল।
" সেতো আমিও দেখছি, কিন্তু শুধু মুখের চামড়া ধুলি না মুখের হাড় মাংস সব আলাদা আলাদা করে খুলে তারপর ধুলি? "
সুমন উত্তর দিলো না, ওর আজকাল অযথা কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়না একদম। শ্রাবন তো জানেই ও কি করে তারপর অযথা কেনো ওকে নিয়ে খোঁচান। ও তো শ্রাবনকে বিয়ে করতে সাধেনি... কেন শ্রাবণ গায়ে পড়ে ওকে নিজের জীবনে টেনে আনলো, বেশ থাকতে পারতো লাবন্যদিকে বিয়ে করে।
" কিরে চুপ করে রইলি কেন?"
কিন্তু সুমনের কিচ্ছু বলতে ইচ্ছে করেনা। এই চার বছরে ও বদলে গেছে না নতুন করে জন্মেছে জানেনা সুমন।
" সুমো আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। এরকম চুপ করে থাকলে আমার মেজাজ গরম হয়, আমি তো বলছি আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। কিন্তু সেই রাগে তুই না খেয়ে খেয়ে নিজের এই হাল কেন করবি? আমাকে শাস্তি দিতে? "
" আমার খেতে ইচ্ছে হয়না...।"
ব্যাস কথা সব যেন ফুরিয়ে গেলো।
সুমনের খেতে ইচ্ছা হয়না.. এটাও এখন শ্রাবনকে মেনে নিতে হবে। যে মেয়ে পিজা, বার্গার, চটপটি শুনলে লাফাতে লাফাতে চলে আসতো তার খাবারের প্রতি এতো অনীহার কারন শুধুমাত্র শ্রাবণের অন্ধ রাগ আর অবিশ্বাস। বুকের মধ্যে একটু টনটন করে বৈকি... শ্রাবণের ভালোবাসায় তবে কি খাদ ছিলো কোন ?
.
.
.
মায়ের কথায় শ্রাবণ আনন্দ করবে না অভিমান ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। শরীর প্রচন্ড রকম খারাপ দেখে নির্মলা সুমনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার অনেকগুলো পরীক্ষা করে বলে দিয়েছে, পেটের বাচ্চা বাঁচাতে হলে সুমনকে খুব ভালো করে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ওজন বাড়াতে হবে, না হলে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
শ্রাবণের এই এত্তো আনন্দ হচ্ছিলো খবরটা শুনে কিন্তু সুমোটার উপর খুব রাগও হচ্ছিলো। এতো রাগ কেন এই মেয়েটার মনে ?
কিন্তু বাড়ি এসে সুমনের চেহারা দেখে শ্রাবণের সব আনন্দ কেমন মিইয়ে যায়। সুমনের চোখেমুখে কোন উত্তেজনা, কোন চমক নেই। পাথরের মতোই দুর্ভেদ্য এক দেয়াল দু'জনের মাঝে। শ্রাবণের ইচ্ছেতে এই পাথরের গায়ে কোনদিন ফুল ফুটবে কি?
.......................................
প্রেগনেন্সির পুরো সময়টা কেমন এক ইঁদুর- বেড়াল খেলার মতো করে পার হয়। শ্রাবন পাহারা দিয়ে যতোই খাওয়ানোর চেষ্টায় লেগে থাকুক সুমন তার অভিমান নিয়ে অনড়, সুযোগ ফেলেই খাবার খায় না, ভিটামিন নেয় না, নিজের উপর অত্যাচার চলে তার পুরো দমে।
শ্রাবণের এক এক সময় অসহ্য লাগতো। ইচ্ছে হতো খুব করে ঝগড়া বাঁধায় আগের দিনের মতো। কিন্তু সুমো তো তার ধার কাছ দিয়েই যায় না।
.
.
ভোর থেকেই আজ চৌধুরী বাড়ির সবার মাঝে বেশ একটা টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বেলা আটটায় আজ সুমনকে হসপিটালে ভর্তি করা হবে । নির্মলা তাই আজ বড়ো বৌয়ের হাতে রান্নার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
শ্রাবণকে ঠিক আটটায় সুমনকে ভর্তি করিয়ে কোর্টে ছুটতে হলো। বেছে বেছে আজই একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসের ডেট পড়েছে, আজ এটা কোর্টে না উঠলে কেসটা আবার অনেকদিনের জন্য ঝুলে যাবে আর শ্রাবণ সেটা একদম চাচ্ছে না।
বাচ্চাটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে শ্রাবণের ইচ্ছা, পিচকু একটু হাত পা নাড়তে শিখলেই শ্রাবন ওদের নিয়ে বেড়াতে যাবে অনেকদিনের জন্য। এবার হয়তো সুমো আর মন খারাপ বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেনা ওর উপরে।
কোর্টে ফোন সাইলেন্ট করার আগেও ডাক্তারের সাথে কথা হয় শ্রাবণের, ডাক্তার অভয় দেন কোন সমস্যা হলে অবশ্যই ওকে সব জানাবেন তিনি।
....…...........
শান্তনু ফোন দেয়ার আগেই শ্রাবণ এসে হসপিটালে ঢুকলো হুড়মুড় করে। ছেলেকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে একগাল হাসেন নির্মলা, তবে দুষ্টুমির লোভ সামলাতে পারেন না।
" ছোটকে আজ একদম ভিতরে আসতে দিবিনা শান্তনু... পাঁজি ছেলে, এতোক্ষণ পরে ওর দাদুমনিকে দেখতে আসার সময় হলো।"
" মা... আমি মোটেই দেরী করতে চাইনি, কিন্তু আজকের কেসটায় আমার উপস্থিত থাকা খুব জরুরি ছিলো, শেষ করে আসতে তাই দেরী হয়ে গেলো," শ্রাবন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে জানায়। ওর চোখদুটো তখন মায়ের কোলের গোল প্যাঁচানো তোয়ালটার দিকে। আহ! ওখানে ওর রাজকণ্যা ঘুমিয়ে আছে।
" থাক বসে তোর কেস ধরে, আমার দাদুমনির কাছে একদম আসবি না। থাক যেয়ে তোর ওই সব কি বলে মামলার আসামী নিয়ে।"
" মা... সবাই শুধু আসামী হয়েই আসেনা,
আরো অনেক প্রবলেম নিয়ে আসে। প্লিজ, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও আর কোনদিন এমন হবে না।"
" ঠিক তো.. আর কক্ষনো এমন করবিনা।"
" আর কক্ষনো হবে না, কথা দিলাম।"
" আয় তবে, নিজের মেয়েটাকে দেখ," নির্মলা এতোক্ষনে ছেলেকে কেবিনে ঢোকার ছাড়পত্র দেন।
শ্রাবণ কোর্টে থাকতেই খবর পেয়েছিলো সুমোর ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে, সিজার করতে হয়নি। কাজ শেষ হতেই ও তাই প্রায় পাগলা ঘোড়ার মতো হাসপাতালের দিকে ছুটেছে।
মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্রাবণ যখন সুমনের পাশে এসে বসে, সুমন তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। শ্রাবন ঝুকে আলতো করে সুমনের কপালে ঠোঁটটা চেপে ধরতেই সুমন নড়ে উঠে, চোখদুটিতে সুমনের রাজ্যের ক্লান্তি।
"না, না তুই ঘুমো.. উঠিস না।"
সুমন এক ঝলক দেখেই আবার চোখ বুজে।
শ্রাবণ তখন মায়াভরা চোখে ওর পুতুল টাকে দেখছে। কি আজব, আজ থেকে ও কারো বাবা.. কেমন একটা অনুভূতি। এতোকাল বড়ো হয়েও বাড়ির ছোট নামটা ওর দখলেই ছিলো যদিও দিব্যকে শ্রাবন এখন ছোটু ডাকে। কিন্তু আজ থেকে সেই দিব্যও বড়োদাদা হয়ে গেলো।
"কিরে বোকার মতো হাসছিস কেন ছোট, তোর মেয়ের চেহারা তো পুরো মায়ের মতো লাগছে।"
" মায়ের নাতুবুড়ি মার মতো হবে নাতো কার মতো হবে... বলো," শ্রাবন মেয়েকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। ওর সন্তান, কেমন একটা মায়ার ঢেউ ওঠে।
" হ্যাঁ, তাও ঠিক। বড়ো হয়ে দিদুনকে আচ্ছামতো সাইজ করবি ঠিক আছে মামনি? " শান্তনু আলতো করে নবজাতকের গালটা ছুঁয়ে দেয়। বড়ো করে একটা সোনার চেইন বানাতে দেয়া হয়েছে চৌধুরী বাড়ির এই নতুন অতিথির জন্য।
নির্মলা একটু দূর থেকে পুরো দশ্যগুলো মনের অ্যালবামে ধারন করতে থাকেন। রামনাথ হুট করে একদম না বলে কয়ে ওপারে চলে গেলেন। শ্রাবণের বিয়ের কোন কিছুও দেখে যেতে পারলেন না,অবশ্য ছেলের তার যে উৎপটাং কাজ কারবার। এরকম চুরি করে বিয়ে করেছে জানলে কি করতেন রামনাথ সেটাও ভাবার বিষয় ছিলো।
.
.
.
" এই নে "
কাগজের একটা বড়ো প্যাকেট সুমনের হাতে ধরিয়ে দেয় শ্রাবণ।
"কি এটা? "
"খুলেই দেখ।"
সুমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে হাতের সীল দেয় কাগজটার দিকে , তারপর ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে " এই দলিলে আমার নাম কেনো? "
"কারন বাড়িটা তোর নামে কেনা, এটা আজ থেকে তোর সম্পত্তি। "
" কিন্তু বাড়ি আমার নামে হবে কেনো? "
" আমি চেয়েছি বলে," শ্রাবন ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে।
"এটা ঠিক না, তোমার জিনিস তুমি চাইলে যাকে ইচ্ছে তাকে দিতে পারো কিন্তু আমাকে এসব থেকে দূরে রাখো প্লিজ, আমার এসব কিছু চাইনা।"
শ্রাবণের ভিতরে রাগটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। সুমোর রাগ কি কোনদিনো যাবেনা? মেজাজ দুম করে আজ ওর মাত্রা ছাড়া হলো।
"সুমো বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু এবার। আমি এই এক বছরে তোর কাছে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু তুই নির্বিকার। বিছানায় তুই একটা কাঠের পুতুলের মতো পড়ে থাকিস। আমি তাও মেনে নিয়েছি, যে হয়তো একদিন তোর অভিমান ভাঙ্গবে। কিন্তু এখন এতোদিন হয়ে গেলো, অনিন্দিতা হওয়ার পরও তুই অস্বাভাবিক। কেন? কিসের এতো রাগ তোর।"
" আমার কোন রাগ নেই।"
" সুমো মেরে আজ তোর আমি গাল ফাটাবো আর একটিবার এই কথা বললে। তুই আমাকে কোনটা জেদ আর অভিমান চেনাতে আসিস। মনে রাখবি এই আমার হাতেই বড়ো হয়েছিস তুই, মাঝখানে তিন চার বছর কি গিয়েছে তার জন্য সারাজীবনের জন্য জ্ঞানী হয়ে যাওনি তুমি।"
সুমন কি একটা বলতে যেয়েও থেমে যায়। শ্রাবণকে রাগিয়ে দেয়া ওর উদ্দেশ্য নয়, ওর আসলেই এখন কিছু ভালো লাগে না... তবে বহুদিন পর আজ শ্রাবন ওকে তুমি বলে ডাকলো।
" কি হলো, চুপ করে গেলি কেন? কথা বল, আজ আমি তোর বস্তায় আর কতো অভিযোগ আছে শুনবো।"
"আমার কোন অভিযোগ নেই।"
" আলবাত আছে। সুমো... আমাকে খেপাস না আজ, অনেকদিন ধৈর্য ধরেছি কিন্তু আজ আমার সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে।"
" আমার কিছু বলার নেই।"
" কিন্তু আমার আছে, তোর আমাদের মেয়েকে নিয়ে কি সমস্যা? "
" সমস্যা! মেয়েকে নিয়ে আমার আবার কি সমস্যা? " সুমন অবাক হয়ে জানতে চায়।
" সেটাই তো জানতে চাইছি। তুই অনুকে এমন ভাবে দেখভাল করিস মনে হয় তুই ওর মাইনে করা কাজের লোক। তার বাইরে ওর জন্য তোর কোন ইমোশনই যেন কাজ করেনা।"
সুমন অনেকদিন পর শ্রাবণের কথায় হেসে ফেললো মুখ নামিয়ে, " আমার ইমোশনের আবার দাম আছে নাকি? যা হোক অনুর ভালেবাসার কোন কমতি হবেনা, ওর জন্য ওর পরিবারের লোকের ভালোবাসাই যথেষ্ট। "
সুমনের কথাগুলো এমন যে শ্রাবণ না পারলো সইতে আর না পারলো গিলতে। সুমো এমন হয়ে গেলে কেনো... কোন যাদুমন্ত্রবলে ও ওর আগের সুমোকে ফিরে পাবে?
চলবে......
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro