৪২
" সুমো আনসার মি? আদিত্যর সাথে বিয়েটা তোর জায়গায় প্রীতির সাথে কেনো হয়েছে? "
তাজ্জব প্রশ্ন, মনে হচ্ছিলো আদিত্যর সাথে বিয়ে কেন হয়নি সুমনের, এটা উদ্ধার করাই আপাতত মুখ্য উদ্দেশ্য শ্রাবনের। সুমন উত্তর না দিয়ে পাশের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলো। আগে ওরকম জায়গা দেখলে ও ভয়ে মরে যেতো আর এখন জীবনটাই এমন লাগে ওর।
সুমনের এরকম নিরুত্তাপ আচরনে শ্রাবন ভিতরে ভিতরে আবারো চটছিলো, এই অসভ্য মেয়েটা ওকে নরকের আগুনে পোড়াবে, তারপর সেই পোড়া ছাই নিয়ে সিঁদুর পরবে... এক নাম্বারের মিচমিচে শয়তান।
" সুমো উত্তর দে বলছি, নাহলে কিন্তু আমি ঠিক এখন কুরুক্ষেত্র বাঁধাবো। তুই আদিত্যকে বিয়ে করিসনি তাহলে আমার সাথে এতোদিন যোগাযোগ করিসনি কেন?" শ্রাবণের আঙ্গুলের চাপে সুমনের চোয়াল প্রায় ভাঙ্গে।
কেন জানায়নি! সুমনের জিদ বাড়লো। কেন জানাবে ও? শ্রাবণ কেন একবার ওর খোঁজ করেনি? বিয়ে করা বউ ও তারপরও একবার ওর খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, দরকার হয় ওকে মেরে ফেলতেই না হয় আদিত্যদের বাড়ি হাজির হতো সে। কিন্তু এখন এসব অবান্তর কথার কোন মানে খুঁজে পায়না সুমন, তাই কথা ঘোড়াল।
" কারন আমার পরকালে ভয় আছে আর আমার স্বামী জীবিত আছে। স্বামী থাকতে আর একটা বিয়ে কি করে করবো? " এবার স্বরটা একটু উচু শোনায় সুমনের, তবে তাতেও করুন সুরটা যেন ওর পিছন ছাড়ে না।
কথাতো নয়, মনে হলো থাপ্পরের মতো কিছু একটা শ্রাবণের কানের উপর এসে পড়লো। হাতটা খসে পড়ে সুমনের মুখ থেকে। ভীষন অসহায় লাগে, তাই তো.. সুমো তো দিব্যি রয়েছে তেমনি ওর হয়ে। ওই মাঝখান থেকে শুধু শুধু লাবণ্যকে... আর ভাবতে চায়না শ্রাবণ। এখন কি করে ও এই বিয়ে ঠেকাবে?
হতাশ ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে পড়ে শ্রাবণ। একটু পরেই সব কিছু শুরু হবে, কি রেখে কি করবে ও?
সমাধান হাতড়ে ফেরে সে।
এতোদিন শ্রাবণের মনে জ্বালা ছিলো, ধর্ম- অধর্মর বালাই ঘুচে গিয়েছিলো কিন্তু এখন সুমন স্বমহিমায় নিজের জায়গায় এসে হাজির হয়েছে, ও থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে তো আর কোনভাবেই সম্ভব হবে না এখন শ্রাবণের পক্ষে।
একবার মনে হলো সুমোকে নিয়ে পালায় কিন্তু পর মুহুর্তেই সেটা বাতিল করে দেয় শ্রাবণ। এখন আর সুমোকে এই প্রস্তাব দেওয়া যায় না, নিজেকে সুমোর সামনে আর ছোট করা যায়না। নিজেকে একদম পাতালের কীট মনে হয় শ্রাবণের।
" নিচে চলো, তোমায় না পেলে সবাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে, " সুমন উঠে দাড়াল। শ্রাবণের বিয়ের লগ্ন হয়ে আসছে, এখন বর মন্ডপে না পৌঁছালে অনর্থ ঘটবে।
শ্রাবণ আজ সত্যিই ভাঙ্গছিলো। সুমো কতো দূরে সরে গেছে ওর থেকে , কি নির্দ্বিধায় এসব কথা বলছে, এক ফোঁটা পানিও সুমোর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছেনা। এতো পাথর হয়ে গেছে ওর আদরের মানুষটা!
" ছেলেকে একটু রাখো, আমি দেখি দুই পাগল একসাথে কি করছে, "আষাঢ়কে, আদিত্যর হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রীতি দরজায় টোকা দিতে লাগলো। হাতে আর খুব বেশি সময় নেই আর , যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
" শ্রাবনদা, সুমনদি তোমাদের আলোচনা শেষ হলো? এক্ষুনি কিছু করো, নাহলে একটু পরে লোকের মধ্যে জানাজানি হলে, ভীষন কেলেংকারি হবে কিন্তু।"
প্রীতির কথাগুলো দরজার ওপাশ থেকে দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেলো, কিন্তু শ্রাবণের মধ্যে নাড়াচাড়ার কোন লক্ষন সুমন দেখতে পেলো না।
.
.
.
নির্মলা ছেলের কথা শুনে বাজপড়া মানুষের মতো নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন শ্রাবণ বুঝি দুষ্টামি করছে, কিন্তু একটু পরে সেটাকে তার আর নিছক ফাজলামো বলে মনে হলো না। মাথা ঘুড়তে লাগলো নির্মলার বনবন করে। শ্রাবন, সুমনকে বিয়ে করে ফেলেছে, চার বছর আগে! ছেলে তার এতো বেয়ারা হলো কবে?
শ্রাবণকে প্রশ্ন না করে নির্মলা সোজা সুমনকে নিয়ে পড়লেন। কিন্তু সুমনকে প্রশ্ন করেও তিনি বিশেষ কিছু জানতে পারলেন না বিয়ের কথা ছাড়া। সুমন মোটে উত্তরই করতে চাচ্ছে না, আঁচলের কোনা দিয়ে কেবল চোখ মুঝছে বার বার আর ক্ষমা চাচ্ছে।
শান্তনু পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। ছোটকে জুতোপেটা করাই বোধ হয় এখন সবচেয়ে উচিত কাজ ছিলো, কিন্তু সমাজে শ্রাবন চৌধুরীর সুনামও একদম ফেলে দেয়ার মতো নয়, উকিল হিসেবে সে এই ক'বছরে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছে, তাছাড়া শান্তনু তার বাবা রামনাথের মতো নাক উঁচু আর কঠিন স্বভাবের নয়, বরঞ্চ এই স্বভাবটা উত্তরসূরী হিসেবে শ্রাবণের চরিত্রেই কিছুটা বেশি দেখা যায়। শান্তনু তাই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো, পাত্রীপক্ষকে এখন সে পাত্রের ভাই হিসেবে কি জবাব দিবেন?
সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনার এক ঘরে লাবণ্যর পরিবারকে ডেকে আনা হলো, বিষয়টি পরিস্কার ভাবে তাদের জানানোর জন্য। এখন কোন অবস্থাতেই আর কথা লুকোনো সমীচীন মনে হলো না কারো।
লাবণ্যর বাবার এমন ভয়নক কথা শুনে জায়গায় প্রেশার বেড়ে গেল। শ্রাবণ বিবাহিত একথা শুনে মেয়ের কি হবে সেটা ভাবতেই বুকে ব্যাথা উঠলো তার। পুরো চৌধুরী পরিবার অনুতপ্ত হয়ে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলো লাবণ্যর পরিবারের কাছে।
কিন্তু লাবন্য আর তার পরিবার কিছুতেই শ্রাবণের এমন অদ্ভুত আচরন মেনে নিতে পারছিল না। শ্রাবণ যদিও এরকম একটা অবস্থায় লাবণ্যকে ফেলার জন্য ভীষন অনুতপ্ত এটাই বার বার বলার চেষ্টা করলো কিন্তু উত্তেজিত জনতার ভীড়ে সেই কথা তখন আর ভালোমতো শোনা যাচ্ছিলো না। সবাই তখন পাত্রর আস্পর্ধা আর স্বভাবের স্খলন এই নিয়ে উত্তাল আলোচনায় মেতে উঠেছে। কেউ কেউ আবার এই ফাঁকে পাত্রের পরিবারকে চুপিচুপি সাধুবাদও জানালেন, এই ঘটনা বিয়ের পরে জানা গেলে মেয়ের সতীন নিয়ে ঘর করতে হতো, তেমন আশঙ্কা থেকে।
নির্মলা আর শান্তনুও, শ্রাবণের এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য বলে লাবণ্যর পরিবারের কাছে বার বার ক্ষমা চাইলেন। লাবণ্য কাঠ হয়ে বসে সমস্তটা শুনলো কেবল, হ্যাঁ অথবা না কিছুই বললোনা।
বিয়ের আসর মুহূর্তেই শোকের আসর হয়ে গেছে, লাবণ্য বুঝতেই পারছিলনা শ্রাবণকে চাওয়াটা ওর জন্য এতো বড়ো অপরাধ কেন হলো? ওর ভালোবাসায় কি কোন ঘাটতি ছিলো যে
ও সুমনের মতো দু টাকার রোগা পটকা মেয়েটার কাছে হেরে গেলো? এতো বৈভব আর সৌন্দর্য থেকে তাহলে লাবন্যর কি লাভ হলো?
লাবন্যর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো এই ভেবে যে সুমনকে, শ্রাবণ চার বছর আগেই পেয়ে গিয়েছে। তারপরও সুমনের সাথেই শ্রাবণের থাকার ইচ্ছেটা বহাল থাকলো... লাবণ্যকে সে চায় না। শ্রাবণের মনে ওর জন্য এক ফোঁটা জায়গাও নেই, এই কথা ঘুরেফিরে লাবণ্যকে পাগল করে তুলতে লাগলো।
........................................
সবার সামনে যখন শ্রাবণ, সুমনের সিঁথিতে সিঁদুর পরালো ঘড়ির কাটা তখন রাত তিনটার ঘরকে ছুঁই ছুঁই করছে । শ্রাবণের বিপরীতে সুমনের আচরন তখনও পাথরের মতো নিশ্চল আর অভিব্যাক্তিহীন। বাড়ির কেউ কারো সাথে বাড়তি কোন কথা বলছে না, এটা বিয়ে বাড়ি না ভূতুড়ে বাড়ি সেটা নিয়েই কেমন একটা সন্দেহ ঠেকছিলো প্রীতির। কিন্তু মঞ্জুকে বলতেই চোখ বড়ো বড়ো করে চোখ রাঙ্গালেন তিনি। মেয়েকে বললেন, "একদম চুপ করে থাক, এতোবড়ো একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেলো, এর মাঝে তুই আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছিস, নির্মলাদি শুনতে পেলে কিরকম রাগ করবে একবার ভেবে দেখেছিস! "
হোক দুর্ঘটনা তবু আজ ওর সুমনদির পাওনার দিন, গত চার বছরে নিজেকে কতোটা কষ্ট দেয়া যায় সেটা সুমনকে নিজের চোখে পেতে দেখেছে প্রীতি, আদিত্যকে বলে তাই অল্প বিস্তর মিষ্টিমুখ করার আয়োজন করলো ও কানা রাতে।
সুমন যখন চৌধুরী বাড়িতে পা দিলো সূর্য তখন উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছে নব উদ্যমে। নির্মলা গতরাতে মুখ কালো করে রাখলেও আজ সুমনকে দেখে সেই রাগ ধুয়ে মুছে ফেললেন। প্রকৃত পক্ষে রাগ তার ছেলের এমন উদ্ভট আচরনে হয়েছিলো। এতোবড়ো উকিল হয়ে শ্রাবণ কি করে এমন বাচ্চাদের মতো খামখেয়ালিপনা করলো? এতোগুলো মানুষের সামনে কি নাস্তানাবুদই না হলেন পরিবারের সবাই মিলে। ছেলেকে কেমন শিক্ষা দিয়েছেন, ছেলের রুচিই বা কেমন... অসংখ্য কটুবাক্যে কান কাল ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিলো নির্মলার। ভাগ্যিস সুজয় এসে শেষ মুহুর্তে, লাবণ্যকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো বলে রক্ষে। তা না হলে হয়তো ছেলেকে আজ হাসপাতালের বেডেই পেতেন তিনি।
শ্রাবণ কাল সব অপরাধ একা নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছিলো, তবু কটুকথা সুমনের পিছন ছাড়ে নি। বড়লোকের ছেলের মাথা কেমন করে ও ঘুড়িয়েছে আর কি তার উদ্দেশ্যে, সেগুলো সবই সুমনের কানে এসেছে। জানা কথা টিপ্পনী কাটার লোকের কোনদিন অভাব হয়না কিন্তু এগুলো ছাপিয়ে যা ওর মনের মধ্যে তোলপাড় করছিলো সেটা কেন যেন চাইলেই সুমন বলতে পারছিলনা আর সেটাই কেমন গুমোট একটা আবহ তৈরি করছিলো ওর মনের চারপাশে।
শ্রাবণেরও এতোকাল বাদে কেমন একটা সংকোচ হচ্ছিলো, সুমনকে গম্ভীর থাকতে দেখে। কি বললে, কি করলে সুমো পাগলীটা আবার আগের মতো লক্ষী বউ হয়ে যাবে উপায় হাতড়ে বেড়াতে লাগলো সে।
চলবে........
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro