৩২
"কিরে এমন উসখুস করছিস কেন? "
নির্মলার প্রশ্নের শ্রাবণ জুতসই কোন উত্তর দিতে পারলনা। কি বলবে? সুমনকে দেখার জন্য ওর মন দিওয়ানা হয়েছে.... অসম্ভব।
"কি হলো কেনো উত্তর নেই কেনো ?"
"কিছু না মা... আসলে দেশ থেকে তো অনেকদিন হলো এসেছি কেমন যেনো লাগছে। "
"সত্যি বলছিসরে ছোট... আমারো মনটা কেমন যেন পুড়ছে বাড়ির জন্য, দাদুটাকে কতদিন দেখিনা। "
নির্মলার কথাগুলো শ্রাবণের মনমরা বাগানে আলোর ঝঙ্কার তুললো। তবে কি মা এবার বাড়ি যেতে রাজি! দেড়মাস প্রায় হতে চললো ওরা এখানে এসেছে... সুমোর জন্য ওর মনের হাহাকার এখন চরম আকার ধারন করেছে।
"আমরা কি তাহলে সামনের সপ্তাহে দেশে যাবার টিকিট বুক করবো? "
"এক সপ্তাহ! আরো দুদিন আগে করা গেলে ভালো হতোনা?"
"আমি এক্ষুনি দেখছি মা... তাহলে বরং আর দেরী না করে কাল পরশুর ফ্লাইটেই চলো বাড়ি চলে যাই। "
"হ্যাঁ, তাই কর। তোর বাবার সাথে রাগ দেখিয়ে এলাম কিন্তু একমাসের বেশি আর টিকতে পারছিনা।"
শ্রাবন মাথা নিচু করে হাসলো। মা ওর প্রতিবারই রাগ করে বেড়াতে বের হয় আর কিছুদিন যেতেই তার পিছুটানও শুরু হয়।
দুদিন পরের ফ্লাইটে টিকিট বুক হতেই ঘর থেকে সামনের বারান্দায় এসে দাড়ালো শ্রাবণ। এই হোটেলটা নয়তলা। ওদের সুইটটা আটতলার একদম বাম কর্ণারে। এখান থেকে দাড়িয়ে সামনের সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোর হলুদ লাল আলো শ্রাবণের মনে নানা রঙের জন্ম দিলো।
ইশশ.... সুমোটাকে নিয়ে আসলে ওর এই দিনগুলো এরকম পানসে কাটতো না। বরং আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকতো.. কিন্তু ওর অপারগতার কারনে সুমো এতো সুন্দর সুযোগটা হারালো। মনে মনে ঠিক করলো এরপর সুযোগ পেলেই ও সুমোকে নিয়ে এখানে বেড়াতে আসবে, এই দেড়মাসের কষ্টটা একদম কড়ায় গন্ডায় পুষিয়ে দেবে সুমোকে।
শ্রাবণের আসার খবর পেয়ে সুমন যতোটা খুশি হলো, অভিমান আর ভয় হলো তার চেয়ে কয়েশগুন বেশি। গত একটা মাস শ্রাবন ওর কাছে কালে ভদ্রে ফোন করেছে। আবার সুমন নিজে শ্রাবনকে ফোন করার ভরসা পায়নি। বাইরে যেয়ে হয়তো সে কাজে ব্যাস্ত, সাথে আবার শাশুড়ি আছে। আর এখন যেই আসার সময় হয়েছে অমনি তিনদফা ফোন দিয়েছে। রাগে সুমনের গা জ্বলছিলো।
"সুমো তোর কলেজে কাল না গেলে হবে না? "
"কেন? "
"কিছু না.... অনেকদিন দেখিনা, এয়ারপোর্টে আসতি।"
সুমনের গলা দিয়ে শব্দ বের হলোনা। শ্রাবণ ওর বাসার অবস্থা জানেনা বলে এই আবদার হচ্ছে কিন্তু বাড়িতে পা দেবার সাথে সাথেই সে লঙ্কা কান্ড বাঁধাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই ওর।
"সুমো? "
"বলো "
"তুই এরকম থম মেরে আছিস কেন? আমি আসবো সেটা শুনে মনে হচ্ছে মোটে খুশি হোসনি? "
"আমার খুশি অখুশিতে কার কি?"
"কার কি মানে? "
"ঠিকই তো কার কি? "
"বড্ডো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বের হচ্ছে... দেশে এসেনি, একদম টুঁটি চেপে ধরবো তোর। আবার বলে কার কি?"
সুমনের অভিমান এবার রূপ পাল্টালো... টুঁটি চেপে ধরবে, এই একটাই তো পারে কিছু হলে। ঝুটি টেনে ধরা আর টুঁটি চেপে ধরা। কাল বাড়ি এসে যদি ওদের বিয়ের কথা সবার সামনে না বলে তাহলে শ্রাবণের সাথে জন্মের মতো কাট্টি নিবে ও।
শ্রাবণ একটু রাগ দেখালেও আসলে ভিতরে ভিতরে পুড়ছিলো... কতটা দিন সুমোকে দেখে না সামনা সামনি আর সুমোটা ভিডিও কলেও আসতে চায়না। শ্রাবনের যে কি অস্থির লাগছে ওকে দেখার জন্য মেয়েটা যদি একটু বুঝতো।
সুমোর যে ওর উপর অভিমান হয়েছে সেটা শ্রাবণ জানে কিন্তু শ্রাবণের আসলে কিছু করার ছিলো না। মাকে নিয়ে ওকে অনেকবার দৌড়াতে হয়েছে পরীক্ষার জন্য, সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে ওর বন্ধু প্রতাপ। প্রতাপ এখানে একটা রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে। শ্রাবণ আসার খবর পেতেই সে তার পরিবার নিয়ে শ্রাবণদের হোটেলে হাজির। এক রকম জোর করেই শ্রাবন আর নির্মলাকে ওরা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো ওদের সাথে ভ্যাকেশনে। সেখানে গিয়ে এতো ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে শ্রাবণের যে শরীরের অর্ধেক শক্তি ওর ওতেই শেষ হয়ে যেতো। সাথে সুমো যদি ওর এই বাড়তি ঘোরাঘুরির খবর পায় তবে পিঁপড়া থেকে ভীমরুল হতে এক সেকেন্ডও সময় নিবে না। মূলতো এই ভয়টা থেকেই ও মাঝখানে কিছুদিন একটু কম ফোন দিতো সুমোকে, নয়তো মাঝরাতে। ওদিকে প্রতাপের ছোট মেয়েটা দু একদিন যেতেই শ্রাবণের খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো, সারাদিন আঠার মতো ওর পিছনে লেগে থাকতো। সব মিলিয়ে গত মাসটা একদম হযবরল হয়ে গিয়েছিলো শ্রাবণের জীবন, কোনকিছুই তার স্বাভাবিক পথে এগুচ্ছিলো না।
সুমো নাক টানতেই শ্রাবণের রাগ পানি হয়ে গেলো, নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। এরকম পরিস্থিতিতে সুমোর জায়গায় শ্রাবণ নিজে কি করতো? অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
"আচ্ছা যা কিছুই করবো না, কিন্তু আমার কাল তোকে বাসায় চাই।"
"আমি কাল বাসায় থাকতে পারবোনা,জরুরি ক্লাস আছে। "
"আরে একদিন ক্লাস না করলে কিচ্ছু হবেনা, পড়াবে তো তোদের সেই আলাভোলা রমেশ মিত্তির।"
সুমনের এবার খুব রাগ হলো," আবার তুমি বাজে কথা বলছো স্যারকে নিয়ে। "
"বাজে কথা... কিসের বাজে কথা? আমি তো তাকে আলাভোলা বলছি, ঠগ, জোচ্চোর, বাটপার আর লম্পট তো বলি নাই। "
" তুমি প্লিজ এসব বাজে বাজে কথা বন্ধ করো, না হলে আমি কিন্তু ফোন রেখে রান্নাঘরে চলে যাবো। "
"আচ্ছা কিন্তু তাহলে তুই কাল এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে আসছিস মনে থাকবে? আমি দাদাকে বলে দিবো তোকে সাথে করে নিয়ে আসতে। "
সুমন সাথে সাথে প্রমাদ গুনলো। শান্তনুদাকে এ বিষয়ে বললে শ্রাবন যদি সবটা জানতে পারে। এতো বড়ো দুর্ঘটনার খবর বিদেশে বসে পেলে শ্রাবণ সুস্থ থাকবে তো?
" না শান্তনুদাকে কিছু বলোনা... আমার সত্যি কাল আসা হবেনা। তুমি বাড়ি আসো, আমি সময় করে তোমার সাথে দেখা করবো "
সুমনের আচরনে শ্রাবণের এতো ভয়নক রাগ হচ্ছিলো যে কোন উত্তর না দিয়েই হাতের ফোনটা প্রায় ছুড়ে মারলো ও বালিশের উপর," নিকুচি করি তোর দেখা করার, কোন দরকার নেই.. একেবারেই আসার কোন দরকার নেই। এই দেড়মাস যখন থাকতে পেরেছি তখন আরও দশ বছরও পারবো।"
রাগে গরগর করতে করতে ঘরের এ মাথা ও মাথা টহল দিতে লাগলো শ্রাবণ।
ফোনের লাইনটা কেটে যেতেই ওড়নার কোন চোখের উপর চেপে ধরলো সুমন। বুকের ভিতরে কি সব ভাঙ্গা চোরার শব্দ... ভয়নক এক তৃষ্ণা অথচ ও কাঁদতে চাচ্ছিলো না, আনন্দ করতে চাচ্ছিলো। প্রিয় মুখটা ছুঁতে পারার আনন্দ কিন্তু কথায় আছে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। ওর ভাগ্যে বোধহয় শ্রাবণের কোলে মাথা রেখে মরার কপাল নেই, নাহলে ওর সাথেই বা এমন হবে কেন?
একেতো সকাল থেকে আজ কিছুই খায়নি ও... সাথে শ্রাবণের সাথে অযথা তর্ক বির্তক। মাথা ভীষন ভাবে ঘুরতে লাগলো সুমনের, সাথে গাটা গুলিয়ে বমির অনুভূতিও হতে লাগলো।
শ্রাবণ এয়ারপোর্টে নামার পরও বিশ্বাস করে বসে ছিলো যে সুমন যতোই মুখে না না বলুক না কেন শেষ পর্যন্ত ওকে না দেখে সে থাকতে পারবেনা। কিন্তু লাগেজ নিয়ে ডিপারচার লেখা গেটের কাছে আসার পরও যখন শুধু শান্তনু আর রামনাথের মুখটাই নজরে আসলো ওর তখন মনটা এবার সত্যিই ভাঙ্গলো। সুমো তাহলে সত্যি সত্যি আসেনি! বেজায় রাগ করতে যেয়েও কেনো যেনো শুধু একদলা অভিমান এসে ভীড় জমাল শ্রাবণের মনের জানালায়, সুমনকে দেখার ইচ্ছেটা তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হতে লাগলো সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে।
......….....….....
সুমন ইচ্ছে করেই আজ ক্লাসের পরেও কলেজের গ্যালারীতে বসে আছে । এইখানে বসে ক্লাস করতে ওর দারুন লাগে কিন্তু আজ কোন ক্লাস ছাড়াই ও এখানে বসা... শ্রাবণের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে ও প্রতিমূহুর্তে।
শ্রাবণ বুঝতে পারছিলনা এটা কিভাবে সম্ভব! এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর এই মেয়ে ওকে সেটা বলারও প্রয়োজন বোধ করেনি? কাপড় চোপড় না পাল্টেই প্রীতিদের বাড়িতে ছুটছিলো সে কিন্তু ওর চেহারা দেখেই শান্তনু ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো।
"শ্রাবণ শোন.... এখনি ও বাড়ি যাস না।"
"এখনি যাবো সুমোর এতো বড় সাহস... আর আর ওই.. "
" দেখ এখানে সুমনের দোষটা কোথায়? সব ওর মামার পরিবারের দোষ বলে আমি মনে করি... তারা যদি মেনে না নিতো এই ব্যাপারটা তাহলে তো আর এতো ঝামেলা হতো না।"
" কিন্তু বদ্দা ও আমাকে একটা শব্দও জানায়নি, কেন? আমি কি ওর বিপদ শুনে আসতাম না?"
" আসতি বলেই জানায়নি বেচারি.... জানে যে মায়ের চিকিৎসার জন্যই আসলে বাইরে গিয়েছিস তুই, এই অবস্থায় জানালে তুই সবকাজ ফেলে রেখেই হয়তো চলে আসতি।"
" হমম। "
এটাও সত্যি.... কিন্তু শ্রাবন বুঝতে পারছেনা এটা হলো কেন, কিভাবে। সুমোর কাছ থেকে এটা এখন ওকে জানতেই হবে।
ফোনের পর ফোন আসছে। সুমন তাকিয়ে দেখে কলটা ধরবে কি ধরবে না বুঝতে পারছিলনা। শ্রাবন এতক্ষণে নিশ্চই বাড়ি চলে এসেছে আর ওকে এতোবার ফোন করার কি কারন হতে পারে সেটাও সুমনের অজানা নয়।
কাঁপা হাতে ফোনটা ধরতেই মেঘ ডাকার শব্দ শুনতে পেলো সুমন ফোনের ওপাশ থেকে।
"তুই নিজেকে কি ভাবিস, রানী ক্লিউপেট্রা? "
সুমন নিরুত্তর।
"আমি কিছু জানতে চাইছি সুমো। "
"বলো..."
সুমন আস্তে করে উত্তর দিলো। আজ হয়তো ও মার খাবে শ্রাবণের হাতে... মোটামুটি নিশ্চিত সুমন এ ব্যাপারে।
"কি বলো? তোর কি আক্কেল জ্ঞান সব লোপ পেয়েছে? তুই আমার কাছে কি করে এতো বড়ো ঘটনাটা লুকালি? আমি হতবাক হয়ে যাচ্ছি তোর আচরন দেখে। "
"আ... আমি কি বলবো বুঝতে পারিনি। "
"আমি কি বলবো বুঝতে পারিনি।"
"বুঝতে পারিনি মানে! তুই কি ছোট বাচ্চা যে বুঝতে পারিসনি। আর এটা তো পীথাগোরাসের উপপাদ্য নয় যে তার প্রমান তোর মাথায় ঢোকেনি। এটা খুবই সহজ বাংলা ভাষার বলার মতো কোন দুঃসংবাদ। আমার মাথায় আসছে না তুই কি করে এটা আমার কাছ থেকে লুকালি আর কেন? "
সুমন চুপ করে রইলো, জানেই আজ অনেক বকা খাবে।কিন্তু শ্রাবন কেবল মাত্রই বাইরে থেকে আসলো এক্ষুনি তার সবটা জানার প্রয়োজন নেই।
"কি হলো সুমো? "
" বলো শুনছিতো।"
" তুই কই? "
" আমি কলেজে।"
" তোর ছুটি হবে কখন? "
"দেরী হবে। "
"সেটা কতো দেরী?"
"আ... আমি বলতে পারছিনা।"
শ্রাবণের ধৈর্যের বাঁধ আবার ভাঙ্গতে লাগলো।একেতো বহুদিন ও সুমোকে ছোঁয়না... মানসিক আর শারিরীক দুটো চাহিদাই এখন তুঙ্গে আর সুমো ক্রমাগত ওকে এরিয়ে যাচ্ছে অথচ বাতাসের ভেলায় চড়ে যে সুর লহরী শ্রাবণের কানে ভেসে আসছে তাতেই প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে উঠছে সে কামনায়, রিপুকে সংযত করা অসম্ভব ঠেকছে। সুমনের কন্ঠ এখন ওর কানে মদিরার চাইতেও বেশি আবেদনময়ী, নিক্কনের চাইতেও বেশি ঝঙ্কারময়।
" তুই কলেজেই থাক আমি আসছি। "
" তোমার আসা লাগবেনা, ক্লাস শেষ হলে আমিই চলে আসবো।"
" আমি গাড়িতে।"
" কিন্তু"
" কোন কিন্তু নেই... এক্ষুনি কলেজের গেটে আসবি তুই... আমার চোখের সামনে পনের মিনিটের মধ্যে তোকে চাই আমি, ব্যাস।"
চলবে.......
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro