শেষ পর্ব ( ৪৬)
"শ্রাবনদা একটু এদিকে আসবেন," আদিত্যর ডাকে হুশ হলো শ্রাবণের। তা না হলে বোধহয় ঘন্টা কেটে যেতো ওর আজ এখানেই।
" অ্যা...?" বিভ্রান্তের মতো এলোমেলো চাহনিতে আদিত্যর দিকে তাকায় শ্রাবণ।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে এখনো ও। সুমনের কথাগুলো ওর সামনের পৃথিবীকে পুরো পাল্টে দিয়ে গেছে। এখন সব জগাখিচুরি হয়ে থাকা ঘটনাগুলো কিভাবে যেন দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যাচ্ছে আপনা আপনি।
"একটু এদিকে আসুন। "
শ্রাবণ উঠে আদিত্যর পিছে পিছে ছোট একটা ঘরে যেতেই এক লোক এসে হাফ সিরিঞ্জ রক্ত নিয়ে ওদের রুমের বাইরের বেঞ্চে গিয়ে বসতে বলে।
" কতো সময় লাগবে আদিত্য? রক্ত নিলে তারপর আপারেশন শুরু হবে তাই না? " নিস্তেজ সুরে প্রশ্ন করে শ্রাবণ। ঠিক সময়ে রক্ত না পেলে ছেলেটা হয়তো ওর বাঁচবে না। অজান্তেই ঢোক গিলে শ্রাবণ। ছেলেটা তার শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তো?
" হ্যাঁ, আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তার আসতে আসতে সব রেডি হয়ে যাবে। "
"আদিত্য..."
"বলুন... শ্রাবনদা।"
" ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবোনা, কিন্তু আপনি কি সত্যি রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি? " শ্রাবণ যেন এই প্রথম আদিত্যকে দেখছে, নতুন করে।
"যে মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন তার পেটে আরেক লোকের সন্তান জেনেও আপনি তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, তার বোনকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ে করছেন... তারপর তার সন্তানকেও নিজের পিতৃপরিচয় দিয়েছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? "
আদিত্য বেশ অনেকটা সময় নেয়। মৃদু হেসে নিজেকেই কিছু বলে তারপর মাথা নাড়ে," না শ্রাবনদা... আপনি যতো সহজে কথাগুলো বলছেন ব্যাপারটা এতো সহজও ছিলো না। সুমনদি প্রেগনেন্ট এই জিনিসটা আমি প্রথম জানতে পারি বিয়ের মন্ডপে উঠে। আসলে সুমনদি না চাইলেও বিয়েটা হতো কিন্তু ওই উপরে আছে না একজন... যে সব কলকাঠি নাড়ে সে আসলে চায়নি আর এখানেই আপনি সিক্সারটা মেরেছেন। ওনাকে আগে থেকেই নিজের দলে সেট করে রেখেছেন। একেবারে মন্দিরে যেয়ে বিয়ে সেরে ফেলেছেন শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে আর কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তো যেই কিনা আমার চোখ আপনার স্ত্রীর উপর পড়লো আমি তাতে ঘন কালো এক মেঘ দেখলাম আর তার খানিক পরেই উনি জায়গায় জ্ঞান হারালেন। বিয়ের কনে অজ্ঞান হলে এমনিতেই কথার ঝড় উঠে তারমধ্যে আমার আবার যৌথ পরিবার।"
"সুমো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো? " শ্রাবণ বিচলিত কন্ঠে জানতে চায়।
" হ্যাঁ, বেচারি এতো স্ট্রেস আর নিতে পারেনি। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলো।"
" তারপর?" শ্রাবণ উদ্বেগের সাথে জানতে চায়।
"তারপর আর কি? ডাক্তার এসে আমাকে আড়ালে ডেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চান। আমি শুনে সুমনকে জিজ্ঞেস করতেই উনি সব আমাকে খুলে বলেন। বিয়েতে যে তার মত নেই, কোনকালেই ছিলো না, কেবলমাত্র আমার শ্বশুরবাড়ির মান সম্মানের কথা ভেবে রাজি হয়েছিলেন সেটাও বলেন, তারপর আমাকে পারলে পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকেন আমি যেন প্রীতিকে বিয়ে করি। প্রীতি ওনার মতো খারাপ মেয়ে না, প্রীতিকে বিয়ে করলে আমি সুখে থাকবো। আমার তখন কি ভীষন এক মানসিক অবস্থা। "
কথাগুলো বলে আদিত্য একা একাই হাসতে থাকে অপ্রকৃতস্থর মতো।
" আদিত্য আমি.. আমি বুঝতে পারছি।"
" না শ্রাবনদা আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনি কোনদিন বুঝতে পারবেনও না আর আমি সেটা চাইও না। আসলে আপনি খুব কপাল করে এসেছেন পৃথিবীতে, সেটা জানেন তো? তা না হলে এতো ভুলভাল করেও সোনার ছড়িটা আপনার হাতেই আবার কিভাবে ফেরত গেলো? "
"আদিত্য.. আমি.. "
" দেখুন শ্রাবনদা... ভুলচুক যা করার আপনারা দুজন মিলে করলেন আর ছেলে আমি হারাচ্ছি।"
আদিত্যর কথায় অসন্তোষের স্পষ্ট ঝংকার ফুটে ওঠে, ছেলেকে সত্যিই খুব ভালোবাসে সে।
"আদিত্য... আমি.. আমি...আমার," শ্রাবণ খেই হারিয়ে ফেলে, সত্যিই তো ওদের ছেলেমানুষির খেসারত বাচ্চাটাকে দিতে হতো যদি আদিত্য সেই সময় বাবার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করতো।
" আমি জানি আপনি করবেন শ্রাবনদা, আপনি ওর বাবা.. আপনি করবেন না তো কে করবে বলুন? " বলতে বলতে আদিত্যর কন্ঠটা বুজে আসে।
শ্রাবণ অশ্রুসজল চোখে আদিত্যকে দেখতে থাকে। সত্যি কি ও আষাঢ়ের বাবা হওয়ার যোগ্য? কেবল রক্তের সম্পর্কের জোরেই কি কারো বাবা হওয়া যায়?
সুমন পাগলের মতো প্রীতির কোলের উপর মাথা রেখে বেডের একপাশে শুয়েছিলো। ওকে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা, অপারেশন থিয়েটারের সামনে থাকতে দেয়নি,অথচ ছেলেটা কখন বের হবে... সুমন অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে অঞ্জনা দেবী আর নির্মলাও চলে আসলেন। অনিন্দিতা এতেটা সময় বাবা- মা কাউকে দেখতে না পেয়ে কান্না জুড়ে দিচ্ছিলো বারবার। কিন্তু হাসপাতালে এসে বড়ো ছেলের কাছে যে কাহিনী শুনলেন, তাতে সেখানেই নির্মলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। আষাঢ় তাহলে তার বংশধর, চৌধুরী বাড়ির ছেলে!
আর সে নিজের বাড়ি ছেড়ে কতোদূরে মানুষ হচ্ছিলো!
যদিও প্রীতি আর আদিত্য আষাঢ়ের কোন অনাদর করেনি, ভালোবাসারও কমতি রাখেনি তারপরও নিজের রক্তের টান আলাদা কিছু... দুশ্চিন্তা চারগুন হয়ে গেলো নির্মলার মুহূর্তের মধ্যে।
পুরো অপারেশনের সময়টায় আদিত্য আর শ্রাবণ দুজনের কেউই এক সেকেন্ডের জন্য অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে নড়লো না। ছোট একটা স্টীলের হাতলওয়ালা একটা চেয়ার রাখা তাতে নির্মলাকে বসতে দেয়া হলো। পুরো অপারেশন শেষ করতে দুই ঘন্টা লেগে গেল প্রায়। ডাক্তার যখন ওটি থেকে বেরিয়ে এলেো শ্রাবণের পা দুটো ততক্ষণে বিশ্রাম চাইছে কিন্তু ওর মনের অপরাধের ভার যে আরো বেশি।
...........................
" প্রীতি, ও আমাকে আজ মেরে ফেলবে দেখিস কিন্তু তুইতো জানিস আমার আর কোন উপায় ছিলো না," সুমন, প্রীতির কোলে মুখ গুঁজে দেয়।
" বালাই ষাট, শ্রাবনদা অমন কিচ্ছু করবেনা আর করলে আমি এখনো আছি সুমনদি। শ্রাবনদা তোমার গায়ে একবার হাত তুলে দেখুক, তারপর যদি শ্রাবনদাকে আমি বড়োমার হাতে মার না খাওয়াই তো আমার নামও প্রীতি না। সব কিছু কে পুতুল খেলা মনে করে সে, বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে অথচ বাবার কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই। "
প্রীতির কথায় সুমনের মনের অবস্থার কোন উন্নতি হয়না। শ্রাবণের হাতে মার খাওয়া বড়ো বিষয় না কিন্তু ছেলের খবর এভাবে সুমনকে দিতে হবে এটাই এখন একটা ভীষন বিপর্যয়ের ব্যাপার ওর কাছে। সাথে এখন হুট করে আষাঢ়ের জন্ম নিয়ে কে কি বলবে সেটা নিয়েও শ্রাবণের মানসিক অবস্থা সব মিলিয়ে আশেপাশের পরিবেশ সুমনকে একদম পারলে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলো।
শ্রাবণ কেবিনে ঢুকতেই সুমন বেডের মাঝখান থেকে দেয়ালের দিকে সিটিয়ে যায়।
" কিচ্ছু হবেনা আমি বলছি তো, তুমি শক্ত থাকো," প্রীতি ফিসফিস করে সুমনের কানে কথাগুলো বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
.
.
.
"আমি.. আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে বলতে বিশ্বাস করো," সুমন ফুঁপিয়ে উঠে। শ্রাবন ওকে ঠিক ভুল বুঝবে।
"সশশশ...," শ্রাবন মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে সুমনকে থামাতে চায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুমন তারমতো কেঁদেই চলেছে।
" সুমো আমি," শ্রাবন অনেকটা সময় নিজেকে আটকে রেখেছিলো কিন্তু আর পারেনা। সুমনকে সজোরে আকড়ে ধরে। আর তার পরক্ষনেই সুনামির আভাস দেখা যায়।
" তুমি আমাকে না বলেই জাপানে চলে গেলে, আমি মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছি," সুমনের কান্নার তুফান ততক্ষণে বিপদসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে, প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তটের বিশালতার মাঝে। শ্রাবণ নিজেও ততক্ষণে ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়েছে নোঙর ছেড়া মাস্তুলের মতো।
দুজনেরই অব্যাক্ত অনুভূতিগুলো লাভার মতো স্রোত তুলে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকে। আসলে অনুভূতিগুলোর আর দোষ কি? খাঁচায় বন্দী থেকে থেকে ওদের বাঁচার রঙ আর সাধ দুটোই লোপ পেয়ে যাচ্ছিল যে।
" আমি জানো সেই বিয়ের দিন একবার মনে করেছিলাম বিষ খাই, কিন্তু ছেলেটা তখন পেটে আর আমি বিষ খেলে মামার অনেক বদনাম হতো, প্রীতিকে নিয়ে মানুষ নানা কথা বলতো, ওর সহজে বিয়ে হতো না। আমি আর অকৃতজ্ঞ হতে পারছিলাম না জানো , তাই বউ সেজে মন্ডপে উঠেছিলাম কিন্তু সত্যি বিয়ে হলে আমি বোধহয় এমনি মরে যেতাম।"
সুমনের কথায় আমূলে কেঁপে উঠে শ্রাবণ। ওর একটু ভুল ওদের জীবনকে কতোটা পালটে দিয়েছে। ওর একটু ভুল বোঝা ওর নিজের সন্তানকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে। ঠিক ওই সময়ে আদিত্য যদি ওদের আশ্রয়টা না দিতো? সুমো আর আষাঢ় তাহলে কোথায় থাকতো? ভাবতেই আবার হোঁচট খায় শ্রাবণ, নিজেকে বড্ডো ঘৃণা হয়।
" সুমো আমি... আমার আসলে কথা বলার কোন জায়গা নেই। আমার ইগো আমাকে এতোটা অন্ধ করে দিয়েছিলো যে আমি জাপানে যেয়ে মোবাইল ই খুলিনি যেটায় মেসেঞ্জার ছিলো। আর যখন খুলেছি তখন তুই মেসেজ গুলো সব মুছে দিয়ে আমায় ভালো থাকতে বলেছিলি। আমার মাথায় আগুন চড়ে গিয়েছিলো।"
" আর কি লিখতাম বলো, তুমি তো আমার মুখই দেখতে চাইছিলে না।"
কথাগুলো তিতো হলেও প্রচন্ড সত্যি।
" কিন্তু তুই আমায় মাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসার পর এড়াচ্ছিলি কেন? আমার তো সেইজন্য খুব অভিমান হয়েছিলো তোর উপর। আর.. আর আমি তোর স্বামী আমি তোকে ছুঁতে পারবোনা কেন... কতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছিলাম জানিস? "
" আমি.. , "সুমন চুপ হয়ে যায়। নিজের শ্বশুরকে এতোকাল বাদে তার ছেলের চোখে ছোট করে কি হবে? কারনটা আজ যদি শ্রাবণ বিশ্বাসও করে, শাশুড়ির কান অব্দি পৌছালে তিনি কতো দুঃখই না পাবেন। সুমনের বুকটা মুচড়ে ওঠে। না ওদের দুঃখ দিয়ে ওর কোনদিন সুখে থাকা হবেনা। বড়োমা ওকে অসম্ভব ভালোবাসেন, তার স্বামীকে ছোট করার দুঃসাহস ওর নেই। তারচেয়ে অন্যকিছু বলা ভালো। কিন্তু সেই অন্যকিছুটা কি বলবে ও যা শ্রাবণ বিশ্বাস করে নিবে, সুমন হাতড়ে মরতে থাকে।
"তুই আমাকে তখন ওরকম না এড়ালে আমি হয়তো তোকে ভুল বুঝতামনা সুমো,তুই.. তুই আর কোনদিন আমাকে ওভাবে এড়াবি না। দরকার হলে সামনে বলবি, ঝগড়া করবি নিজের অধিকার আদায়ের জন্য... আগের মতো কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখবি না, কক্ষোনা না।"
"না আর গুটিয়ে রাখবো না তো, সেই প্রয়োজন মিটে গেছে" সুমন যেন নিজেই নিজেকে কথাগুলো শোনায়। কিন্তু গত ছয়টা বছর ওর দিনগুলো কি নিদারুন অন্ধকারে ছেয়ে ছিলো, তার হিসেব ওকে কে দেবে?
......................................
অনিন্দিতাকে বুকে নিয়ে সুমনের অস্থিরতা যেনো আরো বাড়ে। ছেলেটা এখনো ওষুধের কারনে ঘুমে, সুমনের কেমন সবসময় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। আগে ও আষাঢ়ের মাসি সেজে থাকলেও কাছে থাকতো কিন্তু এখন থাকেই দূরে। নিজের স্বার্থে আষাঢ়কে এভাবে প্রীতি আর আদিত্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে স্বার্থপরের মতো, আষাঢ় জানতে পারলে কখনোই হয়তো ওকে ক্ষমা করবেনা।
শ্রাবন যতোই আষাঢ়কে দেখছিলো ততো বুকের উপর চাপটা বাড়ছিলো। কাল আর আজের মধ্যে কি ভীষন পার্থক্য। কাল যেখানে আষাঢ়কে, সুমনের বেশি প্রাধান্য দেয়া দেখে শ্রাবণের ভীষন বিরক্ত লাগছিলো আজ তার কয়েকশ গুন বেশি টেনশন হচ্ছে ছেলেটাকে এমন ভাবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে। ছেলে ঘুমের মধ্যে একটু নড়লেই ওর মনে হচ্ছে স্যালাইনের লাইনটা খুলে পড়বে না তো? ডাক্তার হাড়টা ভালো করে জুড়েছে তো, আষাঢ় আবার আগের মতো দৌড়াবে তো? এই বুকের কাছে গুমড়ে ওঠা অনুভূতি নিয়ে শ্রাবণ কোন কিছু করেই শান্তি পাচ্ছিলো না।
থেকে থেকে খারাপ চিন্তা গুলোও পাগলের মতো ঘিরে ধরছিলো শ্রাবনকে। ওদের পাড়াতেই শম্ভু বলে এক ভিখিরি আছে, ও বেচারা ছোট থেকেই এমন ল্যাংড়া। শ্রাবণ ওকে কোনদিন হাটতে দেখেনি, রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।
তাই সুমন যখন ওর দিকে অসহায় হয়ে তাকাচ্ছিলো, শ্রাবণ আরো অসহায় বোধ করছিলো। এমন মুহুর্তের মুখোমুখি শ্রাবণ হয়নি এর আগে, অনিন্দিতাকে নিয়ে শ্রাবণের একলার দুশ্চিন্তাটাই বরাবর বেশি ছিলো।
আষাঢ়ের মৃদু মা ডাকটা ওদের কানে আসে পরের দিন ভোর বেলা। আনন্দ আর কান্নার হিড়িক একসাথে পড়ে যায় কেবিনের ভিতরে। পরে নার্স এসে জোর করে কেবিন খালি করতে বলে। শেষ পর্যন্ত একদম অল্প দু,একজন থাকার অনুমতি দেয় ডাক্তার।
পুরো দেড়টা মাস শ্রাবণের দৌড়ঝাঁপ করতে করতে কেটে যায়। বৌ, ছেলে- মেয়ে এক জায়গায়, ওকে কাজের জন্য ছুটতে হয়েছে আরেক জায়গায়। শেষ পর্যন্ত যখন সুমনদের বাড়ি নিয়ে আসতে গেলো শ্রাবণ তখন অলিখিতোভাবেই আদিত্যর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না।
অবস্থা এমন শ্রাবণ নিজেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলো না। কিন্তু আষাঢ়কে ছেড়ে থাকাও এখন আর ওর পক্ষে সম্ভব না, সুমনতো পারবেই না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আশ্চর্য জিনিসটা সুমনই করলো। সবার সামনে বলে বসলো, আষাঢ়কে ওরা সাথে করে নিয়ে আসবে না। আষাঢ় যেমন এতোদিন আদিত্যর ছেলে হয়ে ছিলো তেমনি থাকবে। কেবল ওরা মাঝেমাঝে আষাঢ়কে এসে দেখে যাবে।
শ্রাবণ কি বলবে ভেবে পেলোনা। কস্ট হচ্ছিলো খুব কিন্তু সুমনের কথার উপর এখানে বোধহয় ওর আর কথা চলেনা। ওই যে কেবল জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না তেমন। সত্যিই তো আদিত্য আর প্রীতি প্রকৃত অর্থেই আষাঢ়ের বাবা-মা।
ট্রেনে ওরা যখন চড়লো তখনো সুমন হাসিমুখেই আষাঢ়কে বিদায় জানায়, শ্রাবণ তখনও স্বার্থপরের মতো আষাঢ়কে সাথে নিয়েই আসতে চাইছিলো। কিন্তু সুমনের মুখের হাসি অটল হয়ে ছিলো পর্বত চূড়ার শ্বেতশুভ্র বরফের মতো, তাতে একফোঁটা মলিনতার ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
.
.
.
" তোমার আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে নাগো ? " সুমন ট্রেনের বার্থে বসে শ্রাবণের কাঁধে মাথা রাখে।
"নাহ, তুই যা ভালো মনে করেছিস তাই করেছিস। তবে হ্যাঁ, আমি আমার ছেলেকে সাথে করেই নিয়ে আসতে চেয়ে ছিলাম। "
"আদিত্য আর আষাঢ় দুজনেই কষ্ট পেতো, প্রীতিও।"
" আর তুই? তোর কষ্ট হচ্ছে না? "
" হচ্ছে, কিন্তু এখন আমার আষাঢ় আর অসহায় বলে কারো আশ্রয়ে নেই, এখন ও আর কারো দয়ায় মানুষ হচ্ছে না। এখন ও আদিত্যদের কাছে আছে কারন আদিত্য আর প্রীতি নিজে থেকে ওকে চেয়েছে আর সবচেয়ে বড়ো কথা এখন ওর জন্ম পরিচয় আছে।"
" হমম " শ্রাবণ আলতো করে সুমনের হাতটা নিজের বুকের কাছে চেপে ধরে। সব পাওয়ায় যেমন সুখ থাকেনা, তেমনি সব হারানোতেও দুঃখ থাকতে নেই৷ মানুষ এক জনমে সব পায়না আর এটাই বাস্তব, এটাই নিয়তি।
.
.
.
" সুমো? "
" কি? "
" তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না.. যা তুই থাক তোর ছেলে-মেয়ে নিয়ে, আমি যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।"
" এ আবার কেমন কথা? "
"এটাই কথা, তোর তো এখন আর ভয় নেই। ছেলের মা.... সম্পত্তি বেহাত হওয়ার আর কায়দা নেই। বাড়ি ঘরের অবস্থাও মন্দ না। ব্যাংকে আমার নামে যা আছে তা আর কেউ দাবীও করতে আসবেনা, কেবল আমি যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন ওখান থেকে থাকা খাওয়ার খরচটা একটু চলবে। বাকিটা নিশ্চিন্তে তোর ছেলে- মেয়ের জন্য থাকবে।"
কথা শেষ হতে না হতেই আহ্ করে শব্দ করে উঠে শ্রাবণ।
" উহ কি অবস্থা... ডাইনী নাকি তুই? এতো জোরে কেউ খামচি মারে? "
" তুমি এরকম বাজে কথা বললে এরপর আমি কামড়ে দিবো," সুমন ঠোঁট ফোলায়। ওর বুকটা কেমন মোচড় খাচ্ছে আর আরেকজন সেই নিয়ে মশকরা করছে।
" বাহ বাজে কথা কোথায় বললাম, তুই আমাকে ভালোও বাসবি না আবার মারবি এতো বড়ো অন্যায়। ছেলের মা হয়েছিস বলে কি দেমাগী বেশি হয়ে গেছিস নাকি? মনে রাখিস ছেলের বাবা কিন্তু আমি।"
" আমি কখন ছেলে নিয়ে দেমাগ করলাম বরঞ্চ তুমি বারবার ছেলে নিয়ে খোটা দিচ্ছে বার বার, যেন সব দোষ আমার একলার ছিলো।"
" তোরই তো দোষ, এই ছেলে নিয়েই না বিয়ের পর দুই বছর আর আগে চার বছর আমার সাথে কোন কথাই বলিস নি, ময়না পাখি কোথাকার।"
" তুত.. তুমি একটা শয়তান আর অসভ্য লোক। "
" বারে ময়না পাখি ডাকলাম তাও বলিস শয়তান!"
" তুমি কি ভালোবেসে বলো? বলোতো আমি কালো বলে আর.. আর, " সুমন তোতলাতে থাকে।
" আর.. কি? "
" হুহ.. আমি একটু বেশি কথা বলি তাই ওরকম করে বলো," সুমন মুখ ঝামটা দেয়। " অসভ্য বাদুর কোথাকার।"
"তার পরও তো তোর এই অসভ্য বাদুরের সাথেই থাকা চাই।"
সুমন রেগেমেগে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু কাজের মেয়ের ডাকে তাতে ইস্তফা দেয়।
"ছোট বৌদি, বড়োমা তোমাদের ডাকছেন।"
"কেন? "
"তা জানিনা বৌদি, বড়োমা শুধু বললেন তোমাদের দুজনকে ডাকতে। এক্ষুনি যেতে বলেছেন।"
সুমন আর শ্রাবন একরাশ কৌতুহল নিয়েই নির্মলার ঘরের দিকে ছোটে।
" আসুন শ্রাবনদা।"
ঘরের মধ্যে আদিত্য আর প্রীতিকে দেখতে পেয়ে যারপরনাই অবাক হয় শ্রাবন, আর তার পরিমান এতোটাই বেশী যে মুখের সামনে বোকার মতো বলে বসে, "আদিত্য আপনারা? "
" হ্যাঁ, অনেক অবাক হয়েছেন জানি তারপরও আসতে হলো। আপনার ছেলেকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে এলাম।"
শ্রাবণ আর সুমন একজন আরেকজনের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়।
" সেকি? "
" জানি অনেক অবাক হচ্ছেন, কিন্তু আপনি যেদিন গেলেন তখনও সত্যিকার অর্থে আপনাকে আমার ছিনতাইকারী মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আপনারা যখন চলে আসলেন তখন থেকে আমার কেবলি মনে হতো, আপনি ওর প্রকৃত বাবা হয়ে যদি সন্তানের ভালোর জন্য ওকে ছেড়ে আসতে পারেন তবে আমি কেন না? আমিও আষাঢ়কে ভালোবাসি আর আমি ওর বাবা। আর সেজন্যই আষাঢ়কে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে এলাম। "
"কিন্তু আদিত্য আমরা জানি আষাঢ় আপনার কাছে অনেক ভালো থাকবে," শ্রাবন ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে বসে। সত্যিই আদিত্য আষাঢ়কে ওকে দিয়ে দিবে! শ্রাবণের কেমন বিশ্বাস হতে চায়না। আষাঢ়কে দেখেই শ্রাবণের বুকের মধ্যে নিয়ে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে৷
"হয়তো বাট এক সময় ওর মনে হীনমন্যতা তৈরি হবে। ও মনে করবে আপনারা ওকে ভালোবাসেন না বলে ওকে আমি মানুষ করছি। আর আজ ও ছোট কিন্তু এক সময় আষাঢ় বড়ো হবে। তখন এইসব ইমোশনের চেয়েও উত্তরাধিকার বড়ো সংশয় হয়ে দেখা দিবে। আর তখন কোন কারনে ভুল ভাবে কোন কথা ওর সামনে এলে সেটা প্রলয় ঘটাবে। আমি চাইনা এরকম কিছু হোক, আষাঢ়, " আদিত্য দম নেয়, " ও আপনাদের কাছেই ভালো থাকবে।"
শ্রাবণ নিঃশব্দে মাথা নাড়ে,চোখ দুটো ওর জলে ভরে গিয়েছে। কিন্তু আজ তাতে সুখেরা বড্ডো বাড়াবাড়ি করছিলো। আদিত্য যখন দু'হাতে ঠেলে আষাঢ়কে শ্রাবণের কোলে তুলে দেয়, তখন শ্রাবণ সবকিছু ঝাপসা দেখছিলো। আষাঢ়ের আনাড়ি হাতের ছোঁয়ায় সেই জলের ভার মোটেও কমছিলো না।
.
.
.
"কেমন অদ্ভুত একটা ঘ্রান না গো? "
" হমম," শ্রাবণ সায় দেয়।
চারদিকটা রূপালী চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো। আজ অনিন্দিতার প্রথম জন্মদিন ছিলো। সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি শেষে এখন অবসর মিলেছে ওদের। তাই পিছনের টানা বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে ওরা। ছেলে-মেয়ে দুটোও বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ওদের পিছে পিছে এসে বসেছিলো। কিন্তু নিচের দোলনচাঁপার ঝার থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে, তাতে মৃদুমন্দ বাতাস, দুটো বাচ্চাই কোলের উপর শুয়ে ঘুমে কাঁদা হয়ে গেছে।
শ্রাবণ নিচু হয়ে ছেলের চুল গুলো আবার একটু এলেমেলো করে দেয়। তারপর বুক ভরে শ্বাস নেয়। রক্তের টান কতটা সত্যি জানেনা ও তবে শ্রাবণ জীবনে এখন শান্তি খুঁজে পেয়েছে আর কোন আক্ষেপ নেই। ওর ছোট্ট মেয়েটা তখনও ঘুমের মধ্যেই ওর শার্টের বোতাম মুঠিতে পুড়ে রেখেছে।
সুমন ঘুমঘুম চোখে শ্রাবণকে দেখে। শ্রাবন আজকাল রাগেই না বলতে গেলে। সুমনের মনে হয় ওর মেয়ে হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে তার বাবা রাগতেও পারে। আনমনেই হেসে ফেলে সুমন, সেই রাগী পরপুরুষ শ্রাবনদা এতোদিনে সত্যিকার অর্থে ওর নিজের পুরুষ হয়েছে।
" কিরে হাসছিস যে, " শ্রাবণ ঘোর লাগা চোখে জানতে চায়। আজ সুমনকে দেখে রক্তে দামামা বাজছে। কানের দুল, এলো খোঁপা, চুড়ির টুংটাং, লেপ্টানো কাজল সব অন্য কিছু বলতে চাইছে। শরীর চঞ্চল হয়।
" কিছু না, রাত অনেক হয়েছে শোবে চলো... ওদের মশা কামড়াচ্ছে। "
"হমম.. তুই অনিকে নে, আমি আষাঢ়কে নিচ্ছি।"
মশারী গুঁজতে গুঁজতে সুমন টের পায় ওর খোঁপাটা একটানে খুলে গিয়ে পিঠে লুটিয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে সুমনের চুলের ভাঁজে ভাঁজে বকুলের গন্ধ ভেসে আসে।
" এটা কোথায় পেলে? " সুমন দুই হাতের তোলায় নিয়ে বকুলের মালা শুঁকে, বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠে।
শ্রাবণ চাঁদের হালকা আলোতেও সেই সৌন্দর্যের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পায়।
" যখন কেক নিয়ে ফিরছিলাম তখন কিনেছি," শ্রাবণ ফিসফিস করে বলে উঠে। সুমন টের পায় শ্রাবণের ভারী স্বরের সাথে সাথে ক্রমশ ওর চুলের ভার বাড়ছে.... হাতের চুড়ি, কানের দুল একটা একটা করে গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
এরপর অন্ধকারে নক্ষত্রের দেখা মেলে... একটু একটু করে টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়ে সুমনের শরীরের প্রতিটি বাঁকে।
সুমন অন্ধকারেও হাসে। রাত আরও উত্তাল হয়।
ভালোবাসা আসলে এমনই, খুব বেহায়া। হাজার ঝড়ের পরেও যেই আগের চেনা জানা পরিবেশ খুঁজে পায় অমনি বসন্তের ঝরে পড়া পাতার স্তুপের ভিতর থেকে লুকিয়ে মাথা তোলে। তারপর সেই নরম ভিতের উপর কচি কচি পাতা মেলে আবার নতুন করে লতিয়ে লতিয়ে পথ চলা শুরু করে।
সমাপ্ত ★
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro