শিরোনামহীন গল্প ৫
২য় ও শেষ পর্বঃ
স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়িতে কেমন যেন কানাঘুষা ভাব। সবাই আমার দিকে কেমন আড়চোখে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই সামনে থেকে সরে যাচ্ছে আর নাহয় খুব ব্যস্ত এমন একটা ভাব। মাকে চুলার ধারে, কলপারে কোথাও খুজে পেলাম না।
শুধু চাচীকে দেখলাম নারকেলের পুর তৈরি করতে। ভাজা নারকেলের মিষ্টি একটা ঘ্রান নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। ইশ হাতের তালুতে নিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। চাইলে দেবে বলে মনে হয় না।
-এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? বাড়িসুদ্ধ লোকের পেট খারাপ করানোর মতলব, না?
-আমি তো-
-তোর চাচা সেই কখন থেকে ডাকছে। জবাব না দিয়ে এখানে হাবার মত দাঁড়িয়ে রয়েছিস। গেলি রে হারামজাদা?
চাচী বেলন ছুড়ে মারার আগেই মানে মানে কেটে পড়লাম। দোতলার সবচেয়ে বড় ঘরটায় চাচা থাকেন। আগে অই ঘরে দাদা আর দাদি থাকতেন। চাচার অবশ্য ঘরটা একার না। শুধু একপাশে বইয়ের আলমিরা আর একটা টেবিলই উনার অধিকারে আছে। বাকি অংশ অন্যরা যে যার প্রয়োজনমত ব্যবহার করে।
-মাহিন, এলি?
-জি, চাচা।
আয় বোস।
চাচার টেবিলের সামনে কোন চেয়ার নেই। উনি আমাকে ঠিক কোথায় বসতে বললেন বুঝতে না পেরে আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। বাড়িতে একমাত্র চাচাই আমার সাথে মানুষের মত ব্যবহার করে। আমিও উনার মত বই পড়তে ভালোবাসি। মাঝে মধ্যে উনার বইয়ের শেল্ফ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বই নিয়ে যাই। পড়া শেষ হলে আবার জায়গামত রেখে দেই। দুই একদিন বই নেবার বা রাখার সময় হাতেনাতে ধরাও খেয়েছি। কিন্ত বড় চাচা কখনোই অন্যদের মত বাজে ব্যবহার করেন নি। উনার মত আমার ও বইপ্রীতি আছে সেটা হয়ত উনার ভালো লেগেছে। আমার মনে হয় এজন্যই উনি আমার সাথে এখন পর্যন্ত ভালো ব্যবহার করছেন। অবশ্য বাড়িতে উনার অবস্থান আমার চেয়ে খুব একটা উপরে আছে তাও নয়।
-দুই ঘন্টা আগে চা খেতে চাইলাম। এখনো কেউ এক কাপ চা করে দিতে পারল না! এরা সবাই সারাদিন করে টা কি?
-সবাই কিছু একটা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে মনে হয়।
-অহ কেউ তাহলে তোকে কিছু বলে নি?
-কি বলবে চাচা?
-নাহ, কিছু না। চাচার চশমার ভারী ফ্রেম তার চোখকে লুকাতে পারছে না। কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন মনে হচ্ছে।
-তোর মার সাথে কথা হয়েছে?
-স্কুল থেকে আসার পর মাকে খুঁজেই পাচ্ছিনা।
-অহ।
চাচা আবার চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন। স্কুল থেকে ফেরার পরপরই ডাক পড়ায় ভাবলাম হয়তো নতুন কোন বই পড়তে দেবেন। কিন্ত কিসের কি। উনি তো অদ্ভুত আচরণ করছেন।
আমি নিচে চলে এলাম। ক্ষিদে পেটে নিয়ে চাচার ধ্যান ভাংগার অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না। সিড়ির পাশের দোলনায় জবা আপু, শেবা আপু দোল খাচ্ছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
-বলি তোদের খেয়ে কোনো কাজ নেই নাকি? হয় দোলনায় বসে দোল খাস নয়তো হাসাহাসি আর ফুচুর ফাচুর। বর এক্ষুনি চলে আসবে। গিয়ে দেখে আয় মহারানী রেডি হয়েছেন নাকি এখনো নাকের পানি চোখের পানি এক করে চলেছেন।
বড় চাচী তার দুই মেয়েকে আচ্ছামত বকে দিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলেন। বর আসবে? কার বর? জবা আপুর নয়তো? জবা আপু তো মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। এখনি বিয়ে?
- বড় আপু, কার বর?
-তোর মায়ের বর। তোর মা তো আবার বিয়ে বসছে রে মাহিন। জবা আপু ভ্রু নাচিয়ে বলতে বলতে আবার শেবা আপুর গায়ে ঢলে পড়লো।
- ম-মানে?
- অত কৈফিয়ত দিতে পারবো না। গিয়ে তোর মাকে জিজ্ঞেস করগে।
বড় চাচা কি তাহলে এই কথাই বলতে চাইছিলেন? আমার মায়ের বিয়ে? কিন্ত কেন? আমি মার কাছে না গিয়ে দৌড়ে আবার বড় চাচার কাছে গেলাম। উনি এখনো চেয়ারে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন।
-তুই কি সব জেনে গিয়েছিস?
চাচা দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। আবছা আলোয় উনার চেহারা দেখতে পারছি না। কি বলবো বুঝতে পারছি না।
- তোর বাবার বন্ধু এনায়েত এর কথা কি তোর মনে আছে?
- না।
- অবশ্য মনে থাকার কথাও না। তোর যখন তিন বছর বয়স, তখন তোর বাবা মারা গেল। এনায়েত তোর বাবার সাথে শহরে ব্যবসা করত। তোর বাবা রোড এক্সিডেন্ট করার পর এনায়েতই হাসপাতালে নেয়া, চিকিৎসা করানো সব করেছিল। কিন্ত শেষরক্ষা হলো না।
- এনায়েত চাচার কথা উঠছে কেন?
- কারণ এই এনায়েতই তোর মাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
- মা এনায়েত চাচাকে বিয়ে করবে বলেছে?
- না, বলে নি। শুনেছি তোর মা তোর চাচীর পায়ে পর্যন্ত ধরেছে। বলেছে আমার কিচ্ছু লাগবে না। খালি আমাকে আর আমার ছেলেকে এই ভিটায় একটু থাকতে দেন। কিন্ত তোর চাচী আর ফুপু তোর মাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে।
একবার ইচ্ছা হলো চাচাকে বলি, আপনি একটা ভীতুর ডিম। আপনি সারাজীবন তাদের অন্যায় সহ্য করে গেছেন। আজকেও চুপ আছেন। কিন্ত বলতে পারলাম না। বাড়ির সবার মধ্যে এই একটা মানুষই আমাকে আদর করেন। যদিও প্রকাশ্যে আদর করার ক্ষমতা তার নেই। চাচিকে যমের মত ভয় পান। বেচারার জন্য আমার মাঝে মধ্যে বড় মায়া হয়।
- তুই কিচ্ছু ভাবিস না। আজকে বিয়েটা হয়ে গেলে আমি কালই তোকে কোন বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেবো।
- আমি মায়ের সাথে থাকতে পারবো না?
আমি আম্মুকে ছাড়া কিভাবে থাকব? আমি তো কখনো আম্মুকে ছাড়া ঘুমাই না। রাতে আম্মু আমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে আমার তো ঘুমই আসতে চায় না।
-এনায়েত চায় না তুই তোর মার সাথে অই বাড়িতে গিয়ে থাক। তবে সে বলেছে মাঝে মধ্যে গিয়ে মাকে দেখে আসতে পারবি।
- আম্মু আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? মাঝে মধ্যে আম্মুর পায়ে ব্যথা হলে কে পা টিপে দিবে? আম্মুর মাথা ব্যথা করলে কে মাথা টিপে দিবে?
-মাহিন.. . বাবা, তুই অনেক ছোট। সবকিছু বুঝে উঠতে পারবি না। পৃথিবীটা অনেক কঠিন। তোর মার বয়স মাত্র একত্রিশ। এখনো জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এই লম্বা সফর একা পার করা অনেক কঠিন রে বাপ। আমার যদি সামর্থ্য থাকত, তাহলে তোকে আর তোর মাকে এই ভিটা ছেড়ে যেতে হত না।
চাচা হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। তার চেহারা দেখার আগেই আমি রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম।
--------------++---------++-------------------+++-----
আমি আমাদের রুমে চলে গেলাম। মায়ের ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। আমার আম্মু কাঁদলে আর রাগ করলে নাক আর গাল পাকা টমেটো হয়ে যায়।
-কই ছিলি বাপ? সারাটা দিন গেলো তোকে দেখলাম না।
-স্কুল থেকে এসে চাচার রুমে গিয়েছিলাম। এনায়েত চাচা কি ভালো মানুষ, আম্মু?
- আমি জানি না। জানার দরকার ও নাই। তোর স্কুল ব্যাগ থেকে বইখাতা গুলো বের করে ওর মধ্যে তোর কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় কিছু থাকলে নিয়ে নে।
- কেন আম্মু?
- এত কথা বলার তো দরকার নাই। যা বলছি তাই কর। মাগরিবের আজান হলে আমি তোকে ডাকব, তখন আস্তে করে গেইটের বাইরে চলে যাবি। আমি গেইটের বাইরে থাকবো। আমরা মা ছেলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
আম্মু চলে যাবার পর আমি ব্যাগ রেডি করলাম। একটা চিঠি লিখলাম আম্মুকে। পড়ার টেবিলের ওপর রেখে আমি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কই যাব আমি জানি না। শুনেছি ঢাকা শহরে আমার মত অনেক ছেলে থাকে। তারা কাজ করে খায়। আমিও কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবো। আমার চাচা ভুল বলেছেন। আমি ছোট হলেও সব বুঝি। মনে হয় বড়দের বই পড়ার কারনে আমার সমবয়সীদের তুলনায় আমি একটু বেশিই বুঝতে পারি।
আমি বুঝি, আমার মায়ের একটা স্থায়ী মাথা গোঁজার আশ্রয় প্রয়োজন। আমি যদি আম্মুর সাথে বাসা ছেড়ে চলে যেতাম, আম্মু হয়ত আমাকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারত, কিন্ত আমি কি তাকে সেই নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারতাম? তাই চলে যাচ্ছি। এনায়েত চাচাকে বিয়ে করলে আম্মু আবার আগের মত সব ফিরে পাবে। এই বাড়িতে থেকে তার আর কষ্ট করতে হবে না। যদি যোগ্য হয়ে ফিরে আসতে পারি, তাহলে হয়ত আবার আম্মুর সামনে দাঁড়াতে পারবো।
আমাকে পারতেই হবে।
---------------------- সমাপ্ত-----------------
এ/এন - জানুয়ারি ২০২০ এ এই পর্বের প্রথম চারশো শব্দ লিখেছিলাম। এতটা দিন পর আজ আবার কলম থুড়ি কিবোর্ড হাতে নিলাম। এতদিন নিজেকে যেনো কোথায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। যার জন্য আমার আমিকে ভুলে থেকেছিলাম, সেই মানুষের অবহেলাই আমাকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। এখন থেকে আবার নিয়মিত হবার চেষ্টা করবো। যারা গত কয়েকটি গল্প পড়েছেন, এবং গত পর্বে কমেন্ট করেছেন, ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে।
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro