শিরোনামহীন গল্প - ৪
প্রথম পর্ব:
বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি মিনিট দুয়েক হলো। গত চার বছরে একবারও এদিকটায় আসা হয়নি। সময় করে উঠতে পারি নি বলাই ভালো হবে। একতোড়া সাদা অর্কিড মাথার কাছটায় রেখে আমি হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলাম। একটা মিটিং আছে বিদেশী বায়ারদের সাথে। পাছে বাবার মন খারাপ হয় তাই আরো পাঁচ মিনিট থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বাবার চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করলাম। হাল্কা বাদামী চোখ আর লালচে চুল চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আরমানিটোলার ওদিকে কোথায় যেন আমাদের বাসা ছিল তখন। মনে পড়লো প্রতি রবিবার বাবার হাত ধরে চার্চে যেতাম। কিছুদূর হাটার পর আমার পায়ে ব্যথা করত,তাই বাবা আমায় তার কাধে তুলে নিত। একমাত্র সন্তান হবার কারনে ন্যায় অন্যায় সব আবদারই বাবা পূরণ করেছে। বাবার অনেক সাধ ছিল আমাকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ানোর। কিন্তু মনমত সাবজেক্ট না পেয়ে আমি যখন প্রাইভেটে ভর্তি হলাম, বাবা খুব কষ্ট পেলেও সেটা আমাকে মুখ ফুটে বলে নি। যখনই টাকার দরকার হত, বাবাকে বললেই দিয়ে দিত। কখনো ভেবে দেখিনি এত টাকা আমার সামান্য বেতনের কর্মচারী বাবা কোথা থেকে যোগাড় করছে।
এপিটাফের দিকে চোখ পড়তেই প্রচন্ড কান্না পেলো। শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে শুনলাম পাশ থেকে কেউ একজন ভাঙা বাংলায় কিছু একটা বলছে।
আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম।
-আর ইয়্যু টকিং টু মি?
ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশি হলে ত্রিশ হবে।এখনো চেহারায় ছোকরা ছোকরা ভাব আছে। এক পলক দেখেই বুঝতে পারলাম তিনি বাঙালি নন।
-জি। আমি হেনরি কুপার। পেশায় সাংবাদিক।
-অলিভার। নাইস টু মিট ইয়্যু।
আমি হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই হেনরি হাতটা লুফে নিলেন।
-প্লেজার ইজ অল মাইন।
-সো আপনি যেন কি বলছিলেন?
-বাদ দিন। বাংলাদেশে আসার পর এই প্রথম সমবয়সী কারো সাথে পরিচিত হলাম। এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করতে চাই না।
-আহা! বলেই ফেলুন না।
-নো ব্রাদার। ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ এভ্রিথিং। আমি চাই না আপনি আমাকে পাগল ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিন।
-কথা দিচ্ছি সেরকম কিছুই হবে না।
-বলছিলাম যে, আপনার বাবা খুবই রেগে আছেন। আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছেন।
-কি যা তা বলছেন মিষ্টার? পাগল হলেন নাকি?
-আমি জানতাম আপনি এটাই ভাববেন। সেজন্যই বলতে চাই নি।
-না ভাবার কি কোনও কারণ আছে?
-বিলিভ মি। আমি সত্যি বলছি। যদি আমি মিথ্যুক হতাম তাহলে মিঃ জনাথন যে আপনার বাবা সেটা কিভাবে জানতাম বলেন?
-খুবই সহজ। একটা যুবক কবরের কাছে বসে কাঁদছে। কবরটা তার খুব নিকটাত্মীয় কারো হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। আর কবরের এপিটাফে লিখাই আছে 'আ লাভিং ফাদার', সুতরাং সেটা তার বাবার কবর তা বলে দিতে কোনো চৌকষ গোয়েন্দার প্রয়োজন নেই।
-আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমিও মিথ্যা বলছি না। আমার গ্রানি মারা যাবার পর এই ব্যাপারটা আমি প্রথম ধরতে পারি।বুঝতে পারি যে কবরের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা বিধাতা আমায় দিয়েছেন।
-বাহ! বেশ ভালোই তো গল্প ফেঁদেছেন দেখছি। এখন নিশ্চয়ই বলবেন মৃতদের আত্মা আপনার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় তাদের মুক্তি পাইয়ে দেবার জন্য?
বেশ রাগই হতে লাগল লোকটার উপর। সরল সোজা বাঙালি ভেবে মজা নেবার পায়তারা করছে। নিশ্চয়ই সাংবাদিক ব্যাটা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে এটা নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে লিখবে।ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে তবেই ছাড়ছি।
-ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। কবর দেবার পর মৃতদের আত্মাও কবরে আটকা পড়ে। নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করে। তবে কেউ যদি পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে মনোকষ্টে ভুগে, তাহলে মৃত্যুর পর সে সর্গবাসী হলেও তাকে সেই কষ্ট পীড়া দেয়।যেমন কষ্ট পাচ্ছেন আপনার বাবা।
এইবার লোকটার আসল ফন্দি বুঝতে পারলাম।এই ব্যাটা সাংবাদিক টাংবাদিক কিছুই না।একটা ঠগ, জোচ্চোর। এবারে নিশ্চয় বাবাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেবার কথা বলে টাকা চাইবে।
-একদম বাজে কথা বলবেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবা খুব সুখে দিন কাটিয়েছেন।
গর্জে উঠলাম আমি।
-তাই? তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনি কোথায়, কার সাথে ছিলেন?
-কেন উনার আরমানীটোলার বাসায়, মায়ের সাথে।
-আর আপনি? হেনরির ঠোটের কোণা যেন একটু উপরে উঠে গেলো।
-বনানীর বাসায়, আমার স্ত্রীর সাথে। আচ্ছা আপনি এতসব জানতে চাইছেন কেন বলুন তো? এসবে তো কিছুই প্রমাণ হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন।
-প্রমাণ হবে। একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ।
হেনরি দ্য ফ্রড ধুম করে বাবার কবরের পাশে বসে পড়ল। অগত্যা আমাকেও বসতে হল। আমার মোটেও আর ওই লোকের ভেলকিবাজি দেখার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সত্যি বলতে লোকটার কার্যকলাপ আমার মজা লাগতে শুরু করলো যখন সে কবরের খুব কাছে ঝুকে মাথা নাড়তে শুরু করলো।
-মি.অলিভার, আপনার বাবা জীবিত থাকাকালীন সময়ে খুবই অসুখী ছিলেন। তার একমাস কারণ হলেন আপনি।
**********************
ভালো বা মন্দলাগা জানাতে কমেন্ট করুন। সেই সাথে গঠনমূলক সমালোচনা আনন্দের সাথে গ্রহন করা হবে। ♥
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro