শিরোনামহীন গল্প - ২
রাতের খাবার বাড়ছিলেন জমিলা বানু। বেখেয়ালে চামচ থেকে বেশ খানিকটা ভাত মেঝেতে পড়ে যেতেই উনার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে হলো নিজেকেই নিজে কষে একটা থাপ্পড় দেন। হাটু গেড়ে বসে অতি সাবধানে হাত দিয়ে খুটে খুটে ভাত কটা তুললেন তিনি। এই অভাবের সময়ে এক চামচ ভাতের মূল্যই অনেক। আঁচলের খুট দিয়ে কপালের ঘাম মুছে উঠে দাঁড়ালেন।
মেঝে থেকে কুড়িয়ে নেয়া ভাত একটা পিরিচে নিয়ে তিনি খাবার ঘরে গেলেন। খাবার ঘরে একটা বেশ বড় চৌকি পাতা আছে। চৌকির একপাশে তোষক গুটিয়ে রাখা আছে। খাবার খাওয়ার সময় চৌকিটাকে ডায়নিং টেবিলের মত ব্যবহার করা হয়। জমিলা বানুর স্বামী হোসেন মিয়া সেই চৌকির সামনে পিড়ি পেতে বসে আছেন।
-এই নাও ভাত। স্বামীর দিকে ভাতের পিরিচ এগিয়ে দিয়ে হাত পাখাটা হাতে নিলেন তিনি। হোসেন মিয়া ভাতের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন পিরিচে ভাত নয় বিষ দেয়া হয়েছে।
-এক চামচ ভাত চেয়েছিলাম বলে তুমি মেপে মেপে একচামচই নিয়ে এলে? বিরক্তির বদলে অভিমানের স্বরই শোনা গেলো ষাট পেরোনো এই লোকের গলা থেকে।
-দুটো রুটি খেয়ে আবার ভাত চাই! ডায়াবেটিকস হয়ে মরতে বসেছ।এখনো খাই খাই আর গেলো নাহ! ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন জমিলা বানু।
পরক্ষণেই অনুশোচনায় ভুগতে লাগলেন। এত কঠিন ভাবে না বললেও হত। রুটি দুটো ছিল, কিন্ত অন্যদিনের একটার সমান। বুড়ো মানুষটার হয়ত খিদে মেটেনি। তিনি নিজের ভাগের ভাতটুকু একটা থালায় করে নিয়ে আসলেন স্বামীর কাছে। আজ জমিলার খিদে নেই একদম।
-তাড়াতাড়ি খেয়ে রবিদের বাড়িতে যাওতো। ঝুমিটা এখনো আসছেনা কেন বুঝলাম না।
ঝুমি হোসেন মিয়া আর জমিলা বানুর তের বছর বয়সী নাতনী। ঝুমির মা মুক্তা যখন মারা গেলো পুকুরে ডুবে, তখন ঝুমির বয়স চার। মুক্তা সাঁতার জানা মেয়ে। কিন্ত কিভাবে পানিতে পড়লো কেউই জানেনা। ঝুমির বাবার দ্বিতীয় বিয়ের খবর শুনে জমিলা বানু তার স্বামীকে অনুরোধ করলেন মেয়ের একমাত্র স্মৃতিকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসার জন্য। নাতনিকে নিতে এসেছেন শুনেও ঝুমির বাবা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে ব্যস্ত রইলো নতুন বউয়ের সাথে চোখ টিপ দেয়া প্রতিযোগিতায়। সেই থেকে ঝুমি নানা নানীর কাছেই মানুষ।
জমিলা বানু নীরবে তার স্বামীর ভাত খাওয়া দেখছেন। লোকটা কি সুন্দর ছোট ছোট নলা মুখে পুরে, কিছুক্ষণ চিবিয়ে গিলে ফেলে। জমিলা বানু মুগ্ধ চোখে স্বামীর কন্ঠার দিকে তাকিয়ে আছেন। খাবার গেলার সময় ঝুমির নানার কন্ঠা উঠানামা করে। তিনি দেখেন আর লজ্জায় মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলেন। এই বয়সে এসে কি সব উলটা পালটা চিন্তা করছেন তিনি।
-হা করো তো দেখি? স্বামীর কথায় সম্ভিত ফিরলো জমিলা বানুর। কোনও প্রশ্ন না করেই হা করলেন তিনি। কারন তার জানা আছে এখন কি ঘটতে যাচ্ছে। প্রতিবারের মত তিনি হা করবেন, আর হোসেন মিয়া তার সেই ছোট ছোট নলার ভাত স্ত্রীর মুখের সামনে তুলে ধরবেন।
হোসেন মিয়ার যেতে হল না। ঝুমি নিজেই চলে আসলো।
-কিরে আজ এত দেরি করলি?
-আজ দুই সাবজেক্ট পড়িয়েছে তাই। স্যার বলেছেন সামনের মাস থেকে আরো এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে।
-সেকি! দুইমাস আগেই তো বেতন বাড়িয়ে পনেরশ করল।
-সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তাই স্যার আধা ঘন্টা বেশি পরাবেন।
-আমিই তো তোকে পড়াতে পারতাম। আমিও তো এককালে স্কুল শিক্ষক ছিলাম। কিন্ত এই ঘরে কেউ আমার কথা শুনলে তো? খামোখা এতগুলো টাকা অন্যকে দিয়ে দেয়া।
মুখ দিয়ে চুক চুক করে আফসুস করলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক।
-খামোখা বলবে না! নাতনীর পড়ালেখা শুধু শুধু নয়। আর তুমি সেই কবে অবসর নিয়েছ। নতুন ধরনের পড়ালেখার তুমি কি বুঝবে?
স্ত্রীর কথায় মৌন সম্মতি জানালেন হোসেন মিয়া। পুরো সিলেবাসই নাকি চেঞ্জ করে দিয়েছে। সেজন্যই তার কাছে কেউ প্রাইভেট পড়তে আসে না আর। পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে ছোট একটা মুদি দোকান দিয়েছেন গলির মাথাতে।
শিহাবের কাছে যাবেন নাকি একবার? ঝুমির ভাত বেড়ে দিতে দিতে ভাবলেন জমিলা বানু। হোসেন মিয়া শুনলে খুব রেগে যাবেন। ছেলের নাম শুনলেই তিনি রাগে ফেটে পড়েন। তার ভাষ্যে, যে ছেলে গত নয় বছরে বাবা মাকে দেখতে এলো না। বোনের মৃত্যুর খবর শুনে শেষ দেখাটাও দেখতে এলো না, সেই ছেলের তার দরকার নেই।
জমিলা বানু জানেন এসব তার অভিমানের কথা। তাই তিনি ঠিক করলেন আগামীকালই ছেলের বাসায় যাবেন। শহরের অন্যপ্রান্তেই তার ছেলে শিহাবের বাসা। আগামীকাল ছুটির দিন। ছেলে আর নাতি দুটোকেও দেখে আসা যাবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রফিকদের বাড়ির বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গোলাপজাম গাছটার নিচে ধপ করে বসে পড়লেন জমিলা বানু। হাটতে হাটতে পায়ের তালুতে খিল ধরে গেছে। ঝুমিটা খুব বায়না ধরেছিলো সাথে যাবার জন্য। সে কখনো মামার বাসায় যায়নি। বাসস্টপ এ নেমে রিকশা নিলে সত্তুর টাকা ভাড়া দিতে হত। তিনি একা থাকায় রিকশা না নিয়ে হেটেই চলে এলেন। সত্তুর টাকায় তিনি একটা সবজি কিনতে পারবেন, অথবা ঝুমির জন্য খাতা-কলম।
শিহাবটা না করে দিলো। জমিলা বানুর করুণ চোখদুটো, তার কেঁপে কেঁপে যাওয়া কন্ঠের আর্তি ছেলের মন গলাতে পারল না। শিহাবের নিজের ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচই অনেক বেশি। তার মধ্য থেকে আরো হাজারখানেক টাকা বের করা অসম্ভব।
-রিয়ার মা গতকাল এসেছিলো।
জমিলা বানু স্বামীর পিঠে তেল মালিশ করতে করতে বললেন।
-কেন? আমাদের হাঁস মুরগি ওদের বাগানে ঢুকে পড়েছিলো?
-আমরাতো হাঁস মোরগ পালিনা এখন আর।
- সে এই সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়েই সবসময় আসত। তাই বললাম আর কি।
হোসেন মিয়ার ঠোটের কোণে হাসির রেখা দেখা গেলো।
-সে এসেছিলো একটা সাহায্য চাইতে। রিয়ার বাচ্চা হবার পর বাপের বাড়িতে এসেছে মাস তিনেকের জন্য। রিয়ার মা বলছিলো অবসর সময়ে আমি যদি ওর নাতনীটাকে দেখে রাখতাম, তাহলে বাচ্চার মা একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ পেত।
-কেন? সে নিজে দেখে রাখতে পারে না নাতনীকে?
-আরে সে নিজেওতো অসুস্থ মানুষ। বলা নেই কওয়া নেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে কয়দিন পর পর।
-হুম। সাহায্য যখন চেয়েছে কি আর করা। যাও সাহায্য করো গিয়ে।
চুপিচুপি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জমিলা বানু। রিয়ার মা অনেক অনুরোধ করেছে একটা কাজের বুয়া খুজে দিতে। কিন্ত তিনি খুজে পেলেন না। আগামীকালই সে সমস্যার সমাধান হবে।
*****************************
ভালো লাগলে ভোট আর মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না। :)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro