ছবি
"কি রে? রুমি নাকি? "চেনা পরিবেশে একটা অতি পরিচিত নাম ধরে ডাক টা শুনে রমার বুক টা ধড়াক করে উঠলো | এ নামে তো তাকে আর কেউ ডাকেনি কোনো দিন, তবে কি সেই ! কি জানি কানের ভুল বা মনের ভুলও হতে পারে | বা হয়তো অন্য কেউ.... " ওই রুমি ! বুড়ি হয়ে গেছিস ! কানেও কম শুনছিস দেখছি !! " কথা টা শেষ করেই শুভ একদম ঠিক রমার সামনে এসে দাঁড়ালো | নিমেষের জন্যে রমার মনে হলো একই সত্যি নাকি ভুল দেখছে সে ! এ কাকে দেখছে ! একি সেই শুভদীপ !! সেই তো... কিন্তু
" দূর শালা, ও রকম হাঁ করে কি দেখছিস? মুখে মাছি ঢুকে যাবে তো | " বলেই চোখ টা টিপে সেই চির পরিচিত দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসলো শুভদীপ |
রমা কিছু টা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল " তু্ই ! এখানে এলি কবে? বাব্বা, এতো দিনে আমাদের মনে পড়লো মিস্টার ইঞ্জনিয়ার এর? ! "
" ধুস, তোদের কথা মনে করে এসেছি নাকি? অফিস এর একটা কাজে আসতে হলো | একমাসের জন্যে এসেছি | অফিস থেকে যখন কাজ টা আমায় দিলো ভাবলাম ভালোই হলো, সেই ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত জায়গা, যাই একবার ঘুরেই আসি | প্রায় পনেরো বছর পর আবার ঢুঁ মারার সুযোগ পেলাম, টাই আর সুযোগ টা হাত ছাড়া করলাম না বুঝলি | "
"হুম , বুঝলাম "| রমা মুখে হালকা হাসির রেশ টেনে বলল |
"তু্ই তো দেখছি রীতিমতো গিন্নি হয়ে গেছে ছিস... সক্কালবেলা বাজারের ব্যাগ হাতে ! তা কি কি কিনলি? রান্না বান্না করতে শিখেছিস নাকি? বর বাবাজি আর ছানাদের কপালে কি যে জোটে কেন জানে !! " কথা শেষ করেই আবার সেই হাসি | এবার রমাও হেসে ফেললো "এতটুকুও বদলালি না বল? সেই যে ছোটবেলা থেকে সবার পেছনে লাগা তোর স্বভাব, এখনো একি রয়ে গেছিস | বিয়ে করেছিস, নাকি এখনো একাই? "
কি যে বলিস? রীতিমতো সংসারী হয়ে গেছি | সুন্দরী বৌ আর একমাত্র ছেলে | বাবা মাও তো আমার কাছেই আছে |"
" বাহ, খুব ভালো | "
"তু্ই কিন্তু একই রকম আছিস | তবে একটু যেন বুড়ি বুড়ি ভাব এসেছে | "
শুভর কোথায় রমা হেসে ফেললো " মেঘে মেঘে কত বেলা হলো ? বিয়াল্লিশ তা বসন্ত যে পেরিয়ে গেছে বন্ধু ! "
"এই তো তোদের রোগ | বয়স বয়স করেই মরলি | আমায় দেখ , এভার ইয়ং ম্যান "| আবার সেই হাসি... রমা তাকিয়ে আছে সেই হাসির দিকে | এযে তার বড়ো পরিচিত |
"ওই দেখো ! আবার হাঁ করে ! মুখে মাছি না ঢুকিয়ে তু্ই ছাড়বি না দেখছি | এই শোন, তোর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা টা দে তো | "
রমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল " কেন রে? আসবি? "
" কি করবো? কখন থেকে এই বাজারে দাঁড়িয়ে বকে মরছি, তু্ই একবারও বললি না ' চল আমার বাড়ি '... নিদেন পক্ষে না হয় এক কাপ চা খাইয়েই তাড়িয়ে দিতিস ! কিপ্টে শালা ! " শুভর কোথায় রমা লজ্জা পেয়ে গেলো | ছিঃ | শুভ তো ঠিকই বলেছে, কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে, একবারও বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা তার মাথায় আসেনি | কি করবে! এতে রমার ই বা দোষ কোথায়? এমন হঠাৎ দেখা যে তার কপালে কোনো দিন ও জুটবে, টা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি |
"এমা, সত্যিই রে | আমি যে কি হয়েছি !! চল "
"নাহ, এখন যাবো না | মুড নেই | আমার যখন মন চাইবে চলে যাবো | তু্ই ঠিকানা টা তো দে | এখানকার সব অলি গলি তো আমার চেনা| "
"ওরে, কোনো অলিগলি তে খোঁজ করতে হবে না, এই তো, এই মুদিখানার দোকান তার পরেই গলি তেই আমার শ্বশুর বাড়ি | স্বপন মাস্টার এর বাড়ি বললেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে |"
"এই, স্বপন মাস্টার কেন রে? তোর বর? "
"হ্যাঁ" বলেই রমা হেসে ফেললো |
"ও বাবা, মাস্টার মশাই ! আমি যাবো না... খুব রাগী নাকি রে? হয়তো তোর বাড়ি গেলাম আর আমায় বলল 'নীল ডাউন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো '...আমার তো কম্মো সারা ! তখন আমায় কেন বাঁচাবে? তুমি তো নক্ষি বৌ... চুপটি করে বসে থাকবে... না রে... তোর বাড়ি যাওয়া ক্যানসেল | "
"শুভ বুড়ো বয়েসে রাস্তার মধ্যে মার খাবি?"
"কে বুড়ো রে শালা! তবে যাই বলে এতো দিন পর তোর মুখ থেকে শুভ নাম টা শুনে প্রাণ টা জুড়িয়ে গেল | "
" আবার শয়তানি করছিস? "
"ওই শালা, বাড়ি যা | কখন বেরিয়ে ছিস.... বর এতক্ষনে বর হয়তো পুলিশে খবর দিয়েছে দেখ গে যা | ভাবছে হয়তো তাঁর সুন্দরী বৌ কেন কেউ কিডন্যাপ করে নিয়েছে |"
"আবার !! " বলেই রমা ভুরু দুটো কুঁচকে শুভর দিকে তাকালো | শুভ হেসে ফেলে বলল " এবার পালাই বুঝলি... জেঠুদের ওখানে এ কদিন থাকবো | চলি রে "
"আসবি তো? "রমা জিজ্ঞেস না করে আর থাকতে পারলো না |
"দেখি " বলে আবার সেই ভাবেই মুচকি হেসে শুভদীপ উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো | রমা চুপ করে চেয়ে রইলো সেই দিকে | আজ তাকে যেন স্থবিরতা পেয়ে বসে ছে | দৃষ্টি পরে আছেন শুভদীপ এর ফিরে যাওয়ার পথে | রমাও ফিরে চললো ফেলে আসা স্মৃতির পথ ধরে | সে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরলো | কত কথা মাথায় ভীড় করে আসছে... মনে হচ্ছে এই তো সে দিনের কথা.... হঠাৎ করেই যেন আবার সব বদলে গেছে বলে মনে হতে লাগলো | মনে পড়তে লাগলো সেই ছোটবেলায় একসাথে খেলা, স্কুলের পরে টিউশন যাওয়া, স্কুল পেরিয়ে কলেজে... যদিও শুভ সাইন্স নিয়ে ভর্তি হলো আর রমা আর্ট এ... তবুও বাড়ি ফিরত একসাথে | ফেরার সময় একজন অন্য জনের জন্য অপেক্ষাও করতো |
রমাদের বাড়ির পাঁচ ছ টা বাড়ির পর ই শুভ দের বাড়ি ছিল | কৃষ্ণগঞ্জ এ রায় বাড়ি সবাই একডাকে চিনতো | এই রায় বাড়ির ছোট ছেলে বিশ্বনাথ রায় এর একমাত্র ছেলে শুভদীপ রায় | ছোটবেলায় শুভ সারাপাড়া মাথায় করে রাখতো | খেলা ধুলো, গান বাজনা, কবিতা, নাটক, কোনো কিছুতেই তাঁর আগ্রহের সীমা ছিল না | পারুক না -পারুক, কোনো কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র সে নয় | বিশেষ করে কোনো তর্ক উপস্থিত হলে তো কোথায় নেই.... কথায় তাকে হারাবে এমন সাধ্য কারো ছিল না | এই শুভদীপ এর সব চেয়ে ভালো বন্ধু ছিল রমা চৌধুরী | শান্ত শি স্ট, মুখচোরা রমা | ওরফে রুমি | রুমি নাম তা অবশ্য শুভর ই দেওয়া | অন্য কেউ ওই নামে ডাকলে রমা রেগে যেত | যেন ওই নামে শুধু মাত্র শুভর ই অধিকার ছিল | টাই হয়তো দীর্ঘ দশ বছর পরেও "রুমি " ডাক টা শুনে রমার বুকের ভেতরে কেঁপে উঠেছিল |
রমা খুব সুন্দর আঁকতে পারতো | শুভর যাবতীয় আঁকার কাজ রমা ই করে দিতো | শুভ বলতো " শোন রুমি, আমি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো , তখন তোকে সাথে করে কলকাতা নিয়ে যাবো | "
"সে আবার কি? কেন রে আমি তোর সাথে কলকাতায় কি করতে যাবো শুনি? আমার নিজের পড়াশোনা নেই নাকি? "
"ওমা, তু্ই না গেলে আমার সব আঁকার কাজ করবে কে? সব তো তু্ই করে দিবি | " বলেই শুভ মুখ টা বেশ গদগদ করে হাসতো |
"সেই তো... আমার আর কাজ কি !!? "
"কেন? তোর আবার কিসের কাজ ! শোন না, তু্ই একটা আঁকার স্কুল খুলবি... দারুন হবে |"
আজ প্রায় তেরো চোদ্দো বছর হয়ে গেলো রমা আর আঁকে না, ভালোই লাগে না | বর, সন্তান, সংসার সব কিছুর মাঝে আঁকা টা এখন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে | স্বপন ও এসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয় | আজ পর্যন্ত রমা আকার খাতা টা হাতে নিয়েও দেখেনি... বরঞ্চ বলেছে " না না, ওসব আর্ট আমি বুঝি না... আমি বিজ্ঞান জগতের মানুষ | ফিসিক্স এর 'ল' বুঝি , ওসব আঁকি বুকি করে পেট চলবে? "
বিয়ের প্রথম প্রথম রমা খুব আগ্রহ ভরে নিজের একটা আকার ক্লাস খুলবে বলে ছিল | শুনে স্বপন বলে " তুমিও দিদিমনি হবে? তাহলে ঘর সামলাবে কে? আর আমাদের দেশে আঁকা শিখে কারো কবে ফিউচার তৈরী হয়েছে বলো? ওসব বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয় | ওসব বাদ দাও |"
বাজারের ব্যাগ টা রান্নাঘরে রেখে মেঝেতে রাখা ছোট টুল টা টেনে নিয়ে বসলো সে | স্বপন এখনো টিউশন পড়াচ্ছে | সকালটাই ব্যস্ত থাকে বলে রমা কেই বাজারে যেতে হয় | রমা ভাবতে থাকে... পনের টা বছর কথা দিয়ে কেটে গেলো... কিন্তু আজ যেন আবার সব কিছুই নতুন বলে মনে হচ্ছে তাঁর.... সেই একজন যে পনেরো বছর আগে কাছে ছিল, আজ আবার ফিরে এসে সব কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট করে দিলো | এক মিশ্র অনুভূতি তে রমার মন টা ভরে গেলো | বড্ড অভিমান হলো শুভর ওপর | শুভ কি পারতো না এই পনেরো বছরে একটা বারের জন্যেও কলকাতা থেকে এসে রমার সাথে দেখা করতে? সেই যে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে এই কৃষ্ণগঞ্জ ছেড়ে চলে গেলো, আর এলোই না!
শুভ যে সপ্তাহে কলকাতা চলে গেলো, ঠিক তাঁর পরের সপ্তাহেই স্বপন রা এলো এই পাড়ার বাসিন্দা হয়ে | স্বপনের বাবা ছিলেন রমার বাবার বাল্যবন্ধু | সেই বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত করতে আত্মীয়তার প্রস্তাব উঠল | দুই বন্ধুই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন শুভস্য শীঘ্রম... ব্যাস আর কি!একমাসের মধ্যেই অতি সাধারণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সাতপাকে বাধা পড়লো রমা আর স্বপন | কিন্তু কেউ একবারও জানতেও চাইলো না রমার মনের ইচ্ছের কথা টুকু, কারণ বাড়িতে বাবার কোথায় শেষ কথা ছিল | তখনো রমা বার বার ভেবেছে , শুভ যদি একবার আসতো ! কিন্তু এলো না | বিয়ের পরেও বেশ কয়েক মাস রমার মনে হতো শুভ আসবে... কিন্তু না, সে আর আসেনি | বিয়ের বছরখানেক পর রমা খবর পায় শুভর বাবা তাঁদের বসত বাটী বিক্রি করে ছেলের কাছে কলকাতায় চলে গেছেন | কৃষ্ণগঞ্জের শেষ টান টুকুও তো শেষ হয়ে গেছিলো... তাহলে শুভর তো এখানে আসার কোনো কারণ ও ছিল না | যদিও সব আত্মীয় স্বজন ই এখানে থাকেন, তা তে কি? অভিমানে রমার চোখে জল এলো কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো, এতে শুভর ই বা দোষ কোথায়? সেই তো কোনো দিন শুভ কেন তার মনের কথা বিফলে উঠতে পারেনি |
"এক কাপ চা পাওয়া যাবে? "স্বপনের আওয়াজে রমা চমকে উঠল | নিজেকে সামলে নিয়ে বলল "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই | " চোখের জল লুকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল " জানতো , আজ বাজারে এক মজার ব্যাপার হয়েছে? "
"তাই ! কি রকম? "
"আমার এক ছোট্টবেলার বন্ধুর সাথে দেখা | ওরা এখানেই থাকতো জানো, প্রায় পনেরো বছর আগে এখন থেকে চলে গেছে |"
"তাই নাকি ! তাহলে এখানে আবার দেখা হলো কি ভাবে? "
"কি একটা অফিস এর কাজে এখানে এসেছে | "
"বাহ, তা বন্ধু কেন বাড়ি নিয়ে এলে না কেন? আমিও একটু আলাপ করতাম "|
"আরে, তাকে তো চেনো না... বাবুর মুড না হলে তিনি কিছুই করেন না | দেখি কি করে ! " গ্যাস এ চা এর জল টায় ফুট ধরেছে.... ধোয়া বেরোচ্ছে.... উড়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে.... "কোই গো! হলো? "
সকালবেলায় রমার বড্ডো তাড়াহুড়ো থাকে | ছেলে কেন স্কুলে পাঠিয়েই বরের জন্যে রান্না সারতে হয় | তারপর বরের স্কুলের সময় হলে তাকে খেতে দেওয়া.... টিফিন গোছানো সব সেরে সবাই রওনা হলে রমার কিছুক্ষনের জন্যে ছুটি মেলে | তারপর আবার শুরু হয় পরবর্তী পর্যায়ের কাজ |স্বপনের জন্যে খাবারের থালা সাজিয়ে টেবিলে রাখতেই যাবে, ক্যালিংবেল টা বেজে উঠল |" কে"? জানতে চাইলে সাড়া পেলো " আমি শুভদীপ " | রমা যেন চমকে উঠল | সে আশা করেনি শুভ আসবে | যা খামখেয়ালি ছেলে ! হয়তো ইচ্ছে হয়নি বলে এলোই না !
রমা দরজা টা খুলে দিয়ে বলল... " এতো দিনে তাহলে মুড হলো বাবুর !!"
"আরে ধুস, ভেবেছিলাম আর হয়তো আসা ই হবে না | অফিস এ খুব কাজের চাপ | একদিনও সময় করতে পারলাম না | রাতে ফিরে জেঠু আর কোথাও বেরোতেই দিতো না | জানিস ই তো গল্প করতে ভীষণ ভালোবাসে |"
"রবিবার এলি না কেন? "
"বাব্বা, আমার ঘরে কটা মাথায় বল? জেঠু তো রবিবারে কোথাও বেরোতেই দিতেই না... সারাদিন বসে বসে কত্ত সব গল্প !! অবশ্য এই তহয়েই গেলো.... কাল ই চলে যাচ্ছি... ব্যাস, কৃষ্ণগঞ্জ টা টা... আবার কবে আসবো কেন জানে !!ওনাদের তো বয়স হয়েছে |" কথা বলতে বলতে শুভ ঢুকলো রমাদের বসার ঘরে |
" ওই রুমি, আমি কি ভুল সময়ে এসে পড়লাম? তু্ই বোধহয় ব্যস্ত রে |" টেবিলের ওপর রাখা ভাতের থালার দিকে চোখ যেতেই বলে উঠল শুভ |
"ওরে না না, বর স্কুলে বেরোবে তাই ভাত বাড়ছিলাম | "
"এমা, তাহলে আমি এখন পালাই "
"শুভ, চুপচাপ বস | খুব মার খাবি "|
ওদের কথার মাঝেই স্বপন এসে ঘরে ঢুকলো |
" কেগো রমা? কেন এসেছে? "
"এই যে, সেই শুভদীপ এর কথা তোমায় বলেছিলাম না? আমার ছোট্টবেলার বন্ধু...."
"হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ভাই, এতো দিনে তোমার আসার সময় হলো? "
"না, আসলে অফিসের কাজে এসেছি তো, তাই ঠিকই সময় করে উঠতে পারিনি | কিন্তু আজও যে খুব অসময়ে এসে পড়েছি, সেটা বুঝতে পারছি "|এরপর শুভদীপ ও স্বপনের মধ্যে সৌহার্দ বিনিময় হয়
"আরে, তুমি বসত | বন্ধুর বাড়ি এসেছো, ওতো সংকোচ কিসের? তবে একটাই মুশকিল আমাকে এখনই স্কুলের জন্যে বেরোতে হবে " স্বপন চেয়ার টেনে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে পরে |
"তা শুভদীপ, এখন আছো তো কদিন? "
"না তো, আমি তো কাল সকালে ই চলে যাচ্ছি| এখানে কাজ সারা | রুমি কে বলেছিলাম, তাই একবার এলাম |" শুভ হেসে রমার দিকে তাকালো | রমা স্বপন কে ভাত দিতে দিতে বার বার শুভ কে দেখছিল | শুভর সাথে চোখচুখি হয়ে যেতেই বলল " জেঠুরা কেমন আছেন রে? কতদিন ওদিকে যাওয়ায় হয়না | বাবা মা চলে যাওয়ার পর ওবাড়ি যাওয়ায় কমে গেছে | পাড়া টাও কেমন যেন হয়ে গেছে ! কত নতুন মানুষ এসেছে !"
"নতুন মানুষ আসলে কি পুরোনো মানুষ অচেনা হয়ে যায়? কি বলেন স্বপনবাবু? " হাসি হাসি মুখে শুভ রমার দিকে তাকিয়ে স্বপন কে প্রশ্ন করে | শুভর কোথায় রমার প্রতিমুহূর্তেই যেন চমক লাগছে |
" ঠিকই তো | আমিও কতবার বলি যাও, ঘুরে এসো | কিছুতেই যাবে না... বলে নাকি ও পাড়া আর ভালো লাগে না... কি বলবো বলো? এবার উঠি ভায়া, না হলে এবার দেরি হয়ে যাবে | তুমি কিন্তু দুপুরে এখানে খেয়ে যাবে | "
"মাফ করবেন স্বপন বাবু, ওটা পারবো না | ঘন্টা খানেক পর একজনের সাথে আমায় দেখা করতে হবে... খুব ই আর্জেন্ট | তাছাড়া আজ দুপুরে অন্যত্র খাওয়ার অনুমুতি নেই... জেঠুই আদেশ.... কাজেই... "
"বেশ, তাহলে আর কিবলবো? আমিও তো নিমন্ত্রণ করার সুযোগ পেলাম না | 'বেটার লাক ফর নেক্সট টাইম ' নিজের জন্যে এটাই বলি আর কি !!" বলেই স্বপন হেসে উঠল | শুভ ও সঙ্গ দিলো | দুজনের মধ্যে সৌহার্দ বিনিময় সাড়া হলে স্বপন স্কুলের জন্যে রওনা হলো |
স্বপন কে রওনা করে দিয়ে রমা ঘরে ঢুকে বলল.. "শুভ একটু বস, চা করি "|
"নাহ, চা খাবো না | তু্ই এখানে এসে বস, আমার তোর সাথে কথা আছে |"
"বাব্বা, এতো দিন পর এসে আবার বেশি কথা ! কাল ই তো চলে যাবি !"বলেই কেমন যেন থমকে গেলো |
"বকবক না করে এদিকে আয় |"বলে রমার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো | রমা কিছু টা অবাক হয়ে গেলো। কারণ শুভকে তার একটু যেন বেশি ই সিরিয়াস মনে হলো। যে ছেলে সব সময় মজা করে, তার হঠাৎ কি হলো?!
"রুমি, তু্ই আর আঁকিস না, না রে? "
রমা চুপ করে গেলো।
" কেন রুমি? কেন নিজেকে এভাবে নষ্ট করে ফেললি? "
রমার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। "উত্তর দে রুমি। কত সুন্দর আঁকতিস তু্ই। তোর স্বপ্ন ছিল আঁকার ক্লাস খুলবি। "
" কলকাতা যাবার পর তোর একবারও আমার কথা মনে পড়লো না? কেন আর একটা বারের জন্যেও তু্ই ফিরে এলি না এখানে? " রমা কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়তে লাগলো, যেন আজ আর কোনো বাধা মানবে না সে। শুভ রমার মুখটা দু হাতের মধ্যে নিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে দিতে দিতে বলল "এসেছিলাম রে, সাত বছর আগে পর্যন্ত এসেছি। "
অবাক হয়ে গেলো রমা
"মানে? "
"যেবার কলকাতায় গেলাম প্রথমবারের জন্য, সেবার তিন মাস পরে পুজোর ছুটি পেয়ে বাড়ি এলাম। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে তোর বিয়ের খবর পেলাম। খুব অভিমান হয়েছিল জানিস ! মনে হল এতদিনের বন্ধুত্ব, তাও একটা খবর পেলাম না !! পরে বন্ধুদের কাছে খবর পেলাম, তুই বাধ্য হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলিস। বুঝলাম দেরি করে ফেলেছি।"
আজ রমা আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। হয়তো বা চাইছেও না। এতদিনের জমে থাকা অভিমান আজ সহস্রধারা ঝরে পড়তে চাইছে।
" কতবার বাড়ি এসে ভাবতাম, একবার যদি তোর দেখা পাই। দু একবার ভেবেছিলাম তোর এই বাড়িতেই চলে আসি। কিন্তু আসতে সাহস হয়নি, জানিস। তুই এখন অন্যের স্ত্রী, তোর এখন অন্য পরিচয় আছে। আমার উপস্থিতি যদি তোর সুখী জীবনে অশান্তি নিয়ে আসে, সেই ভয় পেয়েছি। মন চাইলেও তোর সামনে আসেনি। অনেক আগেই তোর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা আমি পেয়ে গেছিলাম।" রমা যেন হতবাক হয়ে শুভর মুখের দিকে তাকালো।
শুভ মুখে সেই হাসি টেনে বলল -"ভাবছিস তাহলে সেদিন বাজারে ঠিকানা চাইলাম কেন? প্রয়োজন ছিল, কারণ এবার আমি মনস্থির করে নিয়েছিলাম একবার হলেও তোর সাথে কথা বলতেই হবে। জানতাম অনেক অভিমান নিয়ে বসে আছিস। "
" শুভ !! তুই এখনো আমায় এত বুঝিস? "রমা যেন তার সেই শৈশবের সাথী কে আবার খুঁজে পেল।
" বুঝবো না? হাড়ে হাড়ে বুঝি।" বলেই শুভ আবার চোখটা টিপে হাসলো।
"শুভ, আমি তোকে কিছু বলতে চাই - যা হয়তো আর কোনদিন বলা হবে না। "
" থাক না রুমি, সবকিছু নাইবা বলা হলো।
' রাতের সব তারাই আছে, দিনের আলোর গভীরে। '
মনে আছে কবিতাটা? "
"আছে।"
"জানিনা রে রুমি, আর কোনদিন হঠাৎ দেখা হবে কিনা। হয়তো আর কোনদিনই এখানে আসা হবে না, বা উপায় থাকলেও আমি আর আসব না। "
"কেন শুভ, তোর আর আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করবে না? "
শুভ নিজের মনে গুনগুন করে উঠলো, 'তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম। ' "কি অদ্ভুত না রে রুমি.... আমাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে এই মানুষটা জড়িয়ে। জীবনের এমন কোন অনুভূতি নেই যাতে রবীন্দ্রনাথ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন তিনি, কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তেই তার উপস্থিতি। এটাই তো বেঁচে থাকা.. তাই না? " রমা শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। তার যেন কথা বলতে মন চাইছে না, শুধু শুনতে চাইছে সে।
" একটা জিনিস চাইবো, দিবি? শুভ রমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
"দেব"
"বাব্বা, তোর ভয় করল না? বড্ড সাহস বেড়েছে দেখছি.... যদি খারাপ কিছু চাই? "
"নাহ, কারণ আমি তোকে চিনি, জানি....বল কি চাস? "
"নিজের অস্তিত্ব টা হারিয়ে ফেলিস না রুমি.... দায়িত্ব কর্তব্য থাকবেই, কিন্তু নিজের মতো করে বছর জন্যে সময় টুকু রাখিস। "
" বুঝলাম না তু্ই কি বলতে চাইছিস... "
"রুমি তোর মনে আছে? ক্লাস সিক্সে তু্ই আমায় জন্মদিনে একটা কার্ড দিয়েছিলিস... সেটা আজও আমার কাছে রাখা আছে। তারপর তো কত কিছুই দেওয়া নেওয়া করেছি আমরা। সব কিছু তো রাখতে পারিনি.... তবে তোর আঁকা সব ছবি কার্ড আজও আমার সঙ্গ ছাড়েনি... আমার কাছে ওগুলোই তু্ই। "
"শুভ!! " রমা তাকিয়ে রইলো শুভর দিকে, গলা আড়স্ট হয়ে আসছে... আর কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো না সে । বার বার তার শুধু এটাই মনে হতে লাগলো যে, এভাবে তো সেও শুভ কে ভালোবাসতে পারেনি... শুভ আজও তার সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। রমার মনে হলো তার মতো সুখী মানুষ বোধহয় আর নেই। যাকে নিয়ে এতদিন তার মনে অপরিসীম অভিমান দানা বেঁধে ছিল, তা আজ একনিমেষে সমস্ত অনুরাগে পরিণত হলো। এ ভালোবাসা অব্যক্ত, অবর্ণনীয় ... শুধু অনুভব করা যায়... যার বিস্তৃতি শুধু হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
" রুমি, আঁকা টা ছাড়িস না রে... " শুভ রমার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিলো। "নিজের জন্যে এক টুকরো আকাশ খুঁজে নে... একটু ডানা মেল... প্রাণ ভরে নিজের ভালো লাগার নিঃশ্বাস টুকু নে.... বদ্ধতার মাঝেই মুক্তি খুঁজে বের কর । "
শুভর স্পর্শে রমা শীতলতা অনুভব করলো। এ ছোঁয়া কামগন্ধহীন... হৃদয়ের স্নিগ্ধতা মাখা। পনেরো টা বছর পর আজ আবার রমার মনে হলো সে ভালো আছে।
"ওই দেখো... দিলি তো দেরি করে? বলে উঠল শুভ। " এই জন্যেই তোর সাথে দেখা করি না... উউফ... আমার সব গোলমাল করে দিলো !!"
শুভর কথায় কান্না জড়ানো গলায় হেসে ফেললো রমা... " ইস, কত যেন আমার সাথে ওনার দেখা হয়ে? পনেরো বছর পর এসে আবার বেশি বকবক করছে। "
শুভ ও হেসে ফেললো " এবার আসি রে। একজনের সাথে জরুরি দরকার আছে। "
"শুভ... "
" না রে রুমি আর হয়তো দেখা হবে না। কারণ আমার মনে হয়ে আর দেখা না হওয়াই ভালো। তাতে তু্ই, আমি, আমরা সবাই ভালো থাকবো। এখন আমার পরিণত, অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আমাদের। এই যে দেখা হলো, এই নিয়েই জাবর কেটে বাকি দিন গুলো কাটিয়ে দিতে পারবি না রুমি? "
"পারবো রে, আমি আজ পূর্ণতা পেয়েছি। আমার সব আফসোস আজ দূর হয়ে গেছে।আমি আর কিচ্ছু চাই না। "
"আর আমি যা চাইলাম সেটা? "
"চেষ্টা করবো রে "
" না, কথা দে। "
"বেশ, কথা দিলাম বদ্ধ জানালা টা এবার খুলে দেবো। " রুমির কথায় শুভর মুখ টা আবার সেই চিরপরিচিত হাসিতে ভরে উঠল।
" ভালো থাকিস রুমি... তু্ই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। "
"একটা কথা বলবো শুভ? তু্ই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস রে। "
"ভাগ্গ্যিস বুড়ো বলিসনি। " বলেই চোখটা টিপে হাসলো। রমার তার সেই এই হাসি মাখা মুখ টা চোখের তারার মধ্যে বন্দি করে নিতে চাইলো।
" এবার পালাই রে রুমি, না হলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। "
"ভালো থাকিস । "
রমা অপলক চেয়ে রইলো শুভর দিকে।
"তুইও ".. বলেই শুভ দরজার দিকে পা বাড়ালো।
শুভ চলে যাওয়ার সময় কোনো দিন ই পিছনে ফিরে তাকায় না, এটা তার বরাবরের অভ্যেস তা রমা জানে। আজও তাকালো না। কিন্তু শুভর চলে যাওয়ায় আজ আর রমা কষ্ট পেলো না। যেন এক অদ্ভুত সুখানুভুতি তাকে পেয়ে বসল। তার মনে হলো কিছু না পেয়েও আজ সে সব পেয়ে গেছে। রমা চেয়ে রইলো যতদূর শুভর ছায়া টুকুও তার দৃষ্টিগোচর হলো।
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro