পাঠ- ২: লুসি
আম্মু বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আমরা ঝোলাটা হাতে নিয়ে পুরোটা উল্টে দিলাম। আর ব্যাগ থেকে যা বের হলো তার দেখে আমাদের দুই ভাই-বোনের চোখ তো ছানাবড়া। আম্মু ব্যাগে করে খোরগোশ নিয়ে আসছে। ও মাই গড! আমাদের খোরগোশ!!!!
আমার বোন খোরগোশটা উল্টে পাল্টে দেখে বললো,
_ভাইয়া, আমাদের খোরগোশের মাত্র একটা চোখ নাকি? কি আশ্চর্য!
আমি অবাক হয়ে বললাম,
_কিরে!! তুই খোরগোশের পাছার মধ্যে চোখ খুঁজতেছিস কেন?
_হ্যাঁ?? এইটা খোরগোশের উল্টো পিঠ নাকি! ধুরো!
এরকম একটা কথোপকথনের পরে কে না হেসে থাকতে পারে। আমরা হাসছি আর হঠাৎ পাশের বাড়ির আন্টি বললো, আরে তোমার আম্মা তো দেখি বুইড়া একটা খোরগোশ কিনে আনছে! জায়গায় বেজায়গায় খাবলা খাবলা লোম উইঠ্যা গেছে।
কথাটা শুনে ভীষণ আহত হলাম। লোম নাই তো আমিও দেখছি। আমাদের খোরগোশ বুইড়া নাকি জোয়ান আপনারে কেউ জিজ্ঞেস করছে?
বাচ্চাও তো হইতে পারে। যদিও জানি বুড়ো হওয়ার চাঞ্চই বেশি। কারণ খোরগোশটা সাইজে অনেক বড়।
খোরগোশের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি একদম মোহিত হয়ে গেলাম। কি অসাধারণ চোখ। চেরি ফলের মত একদম লাল কালারের চোখ। কি অদ্ভুত সুন্দর। মনটা একদম ভীষণ খুশি হয়ে উঠলো। পৃথিবীতে কি আছে আর খোরগোশের চেয়ে মায়াবী?
যদিও বেশিক্ষণ খুশিটা ধরে রাখতে পারলাম না! আরেক প্রতিবেশী কোথ থেকে জানি এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের এই ছাগলটা কত নিলো? বিকালে একটু দিয়ো তো আমারে, পোলাপানগুলারে দেখাই।
মনে মনে গজগজ করতে লাগলাম, আসেন! নিয়া যান, হাত পাতেন, এক চামচ ছাগলের বিষ্টা দেই, বাড়িতে নিয়া পোলাপাইনরে জিগাইবেন ছাগলের বিষ্টা আর খোরগোশের বিষ্টার মধ্যে পার্থক্য কি!
যাই হোক, খোরগোশটার নাম দরকার। আচ্ছা, লুসি নাম দিলে কেমন হয়? বিকালে যখন আব্বু এলো, খোরগোশের নাম কি দেয়া যায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, লুসি নাম হোক! আমি চমকে উঠলাম, এই নামটা তো আমিও ঠিক করছি। তো লুসিই হলো তার নাম।
মাত্র কয়েকদিন পার না হতেই, লুসির নতুন লোম উঠে পুরো গা শুভ্র বরফের মতো ঢেকে গেলো। আমাদের লুসি হয়ে গেলো আরো অনেক বড়, আরো সুন্দর, আরো সুদর্শন আর অনেক অনেক হ্যান্ডসাম।
আমাদের লুসি সবার চোখে আঙুল (পায়ের আঙুল) দিয়ে দেখিয়ে দিলো সে মোটেও বুড়ো নয়, বরং সে আর্লি এইজের অমিতাভ বচ্চন। ইয়া লাম্বা!
তবে আমার আম্মা যখন গামলায় বসিয়ে লুসি কে গোসল করাতেন, তখন তাকে যে কি অদ্ভুত লাগতো তা বলার মত না! ভিজে লোম টোম গায়ের সাথে চ্যাবগায়া একদম চিকনা চাকনা মিশরের মমির মত লাগতো। লুসি গামলা থেকে উঠার জন্য নাচানাচি শুরু করে দিতো। আর আমার আম্মা তাকে চেপে ধরে বলতো, আরে বয় বয় ছুন্তু, হাগি হাগি তো গুন্তুর গুন্তুর করে রাখছোস! বয়, তোর পাছা মাছা সব ঘষি পরিষ্কার করি দেই।
এখানেই শেষ না, ঘোসল শেষে আম্মু লুসিকে তোয়ালের মধ্যে পেঁচিয়ে কাপড় শুকানোর তারে লটকিয়ে দিতো যতক্ষণ না শুকায়। বাইরের মানুষের কাছে এসব উদ্ভট লাগলেও আসলে আম্মুর চেয়ে বেশি তাকে কেউ ভালোবাসতে পারতো না!
তবে লুসির কিছু গুণ এবং কিছু বদগুন ছিলো। গুন হলো, আমার জীবনে দেখা সে একমাত্র খোরগোশ যে বাথরুম করতে টয়লেটে চলে যেতো। ওকে এটা কেউ শেখায় নি, সে নিজে নিজে শিখেছে।
আর বদগুন হলো সে, বেশ রাগী ছিলো। অতিরিক্ত কথা তার অপছন্দ। কোলে নিয়ে দুইটার বেশি তিনটা কথা বললে, গায়ে আঁচড়ে দিত। আমাদের বেশিরভাগ জামা সে ছিঁড়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেস বানিয়ে দিয়েছে। আমরা দুই ভাই বোনের আবার পশুপাখির সাথে একটু বেশি কথা বলা পছন্দ!
তার দ্বিতীয় বদগুন হলো, যখন আমি ঘুমাই সে খাটের উপর উঠে, আমার লোম খেয়ে ফেলতো, কিংবা আমার চান্দির চুল কিছু খেয়ে জায়গায় জায়গায় টাক বানায়া রাখতো! আমার চুল আউলা বলে সে যে সেটাকে ঘাস মনে করবে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না!
সেই খোরগোশটা যেদিন হারিয়ে গেলো আমি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। আমার মা ভুলে তাকে বাড়ির বাইরে রেখে গেট লাগিয়ে দিয়েছিলো। প্রচন্ড ঝড় হয়েছিলো সেদিন, আমি নিশ্চিত সে অনেক সময় চুপচাপ গেটের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। তারপর ঝড় সইতে না পেরে বেড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়।
কুকুর তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে সে ভয় আমার নেই। কেউ বিশ্বাস করবে না তবু বলি, আমি নিজের চোখে দেখেছি একদিন সে উঠোনে খেলতে বের হয়ে এক কুকুরকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে! কুকুর ভয়ে তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে!
তবে নিশ্চিত ছিলাম অন্য কোনো মানুষ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে বাসায়!
তখন আমি অনেক ছোটো। আর লুসি হারিয়ে যাওয়ার আগে আমি প্রায়ই তাকে কোলে নিয়ে কাঁদতাম। আমার মনের কষ্টগুলি তাকে অনায়াসে বলতাম, তারপর থেকে তো বলতে আর পারি না, বরং তাকে হারানোর কষ্টটাই যেন বুকের উপর পাথরের মত চেপে বসে থাকতো।
:')
_ সেই আমার জীবনে সম্ভবত দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বা চতুর্থ ক্ষনিকের অতিথি।
কিন্তু আমার হৃদয়ে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী আঁচড়ের দাগটা হয়তো কেবল তারই ছিলো!
:')
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro