আমাদের বাড়ি-৩
খেলাধুলা দূরে থাক‚ এক সপ্তাহ ধরে কারো সাথে দেখা পর্যন্ত হয়নি। ওদিকে বাবারা আবার বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।
আয়ান কিছুদিন হলো জ্বরে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আকাশ দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেল ছোটচাচা ডাক্তার আংকেলকে নিয়ে এসেছেন। তার মানে আয়ান বা ঝিকমিক কারো কিছু হয়েছে। এটা মনে হতেই আকশের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বিকেলবেলা আকাশ আর ঝলক চুপিচুপি আয়ানদের ঘরে গিয়ে হাজির হল। আয়ান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর ঝিকমিক মাথার কাছে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছোটচাচী এইমাত্র রান্নাঘরের দিকে গেছেন।
আয়ানের কপালে হাত রাখল আকাশ। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!
“জান‚ভাইয়া না কিছু খেতে পারছে না। যাই খাচ্ছে তাই একটু পরে বমি করে ফেলে দিচ্ছে”, চোখ মুছতে মুছতে বলল ঝিকমিক।
“চিন্তা করিস না‚ঝিকমিক। দেখিস আয়ান ঠিক ভালো হয়ে যাবে”,ছোট বোনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল আকাশ।
এমন সময় বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। আকাশ আর ঝলক দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতেই ছোটচাচার ডাক শোনা গেল‚
“দাঁড়াও! তোমরা এখানে কেন?”
ছোটচাচার ধমকে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবাও পাশের বারান্দা থেকে দেখতে পেয়েছে।
আজ আর রক্ষে নেই!!
“আকাশ‚ ঝলক‚ এখানে কি জন্য এসেছ?”, ছোটচাচা জিজ্ঞাসা করলেন।
ঝিকমিক ভয় পেয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালো। আজ কি যে হবে কে জানে!
“আসলে..আয়ান অসুস্থ শুনে...মানে...একটু দেখতে এসেছিলাম ”,আকাশ আমতা আমতা করে উত্তর দিল। ঝলক তো ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে।
“তোমরা জান না ঐ বাড়িতে যাওয়া নিষেধ? ওরা আমাদের কেউ নয়! ওরা আমাদের শত্রু!”,বাবার ধমক শোনা গেল।
“বাবা‚ ভাই কি কখনো শত্রু হয়? ভাই তো ভাইই হয়”,আকাশেরও চোখে পানি চলে এসেছে কিন্তু তাও সে সাহস করে বলল।
ঝিকমিক এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সাহস করে বলল,
“তোমরা যেমন দুই ভাই‚ আমরাওতো তেমনি ভাইবোন। ভাইবোনদের কি কখনো ঝগড়া করতে হয় নাকি?”
ছোটচাচার সাথে ডাক্তার আংকেলও এসেছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন‚
“এই ছোট বাচ্চাগুলো যা বোঝে তোমরা তা বোঝো না‚ শরীফ। এক ভাই অসুস্থ শুনে ওরা দেখতে এসেছে। একজন অন্যজনের জন্য চকলেট নিয়ে যাচ্ছে। আর তোমরা কি করছ? জীবনের এতগুলো বছর পার করেও একটা সহজ কথা তোমরা বুঝলে না। এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে!”
এত কথার মাঝখানে মায়েরাও চলে এসেছে। সকলেরই মুখ গম্ভীর। কিন্তু ছোট্ট তিয়াশ সোনা কোনো এক ফাঁকে আয়ানের ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়দের চিৎকার‚চেঁচামেচি তার ভালো লাগে না। কতদিন সে আয়ান ভাইয়ার সাথে বল নিয়ে খেলে না। আজকে একটু সুযোগ পাওয়া গেছে।
তিয়াশ খাটে ওঠার অনের চেষ্টা করেও পারছে না। খাট যে অনেক উঁচু! আয়ান চোখ খুলে তিয়াশকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গেই মলিন মুখে একটা উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল।
***************************************************
“একটু মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখ‚শরীফ।এভাবে নিজেরা ঝগড়া করে কি পাবে তোমরা? নিজেদের ঝগড়ার যাতাকলে এই বাচ্চাগুলোকে কেন পিষছ?”
ডাক্তার আংকেল কথাগুলো বলে আয়ানের ঘরের দিকে গেলেন। ছেলেটার জ্বরটা মাপা দরকার। এই দুই ভাইয়ের মোটা মাথায় ভালো কথা ঢুকবে না।
আয়ানের ঘরে ঢুকে ডাক্তার আংকেল বেশ আশ্চর্য হলেন। তিনি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হলেন।
“দুই ভাই ভেতরে এস‚ দেখে যাও”
সবাই ভেতরে গিয়ে দেখল‚তিয়াশ নীচে দাঁড়িয়ে আয়ানকে বল ছুড়ে দিচ্ছে। আর আয়ান খাটে শুয়ে শুয়েই বল ক্যাচ ধরছে।
**********************************************
পরদিন সকালে শরীফ আরিফের ঘরে এলেন।সঙ্গে স্ত্রী রেহানা। বড়ভাই আর ভাবীকে সাত সকালে ঘরে দেখে আরিফ অপ্রস্তুত হয়ে দাঁঁড়িয়ে পড়ল।
শারমিন বেগম তখন আয়ানকে খাওয়াচ্ছিলেন। ভাসুর-জাকে পাশের ঘরে যেতে দেখে তিনিও উঠে গেলেন।এদিকে বাবা আর মাকে ওদিকের ঘরে যেতে দেখে আকাশ আর ঝলক আশ্চর্য হয়ে গেছে।আবার সুনামির আশঙ্কায় ওরা বারান্দায় বেরিয়ে এল। ঝিকমিকও দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কে জানে আজ কি হবে!!
কিন্তু কি হলো ব্যাপারটা? কোনো চিৎকার নেই কেন? আকাশ আর ঝলক বিষয়টা কি তা বোঝার জন্য ছোটচাচার ঘরে উঁকি দিল। যা দেখল তাতে তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ!
বাবা‚ ছোটচাচাকে জড়িয়ে ধরেছে ;দুজনেরই চোখে জল। মায়েরাও একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে!!
আর কাউকে কিছু বলতে হল না। সবাই দৌঁড়ে আয়ানের ঘরে চলে এল। তিয়াশও এল গুটিগুটি পায়ে। সবাই তাকে ফেলে কেন ঐদিকের বাড়িতে চলে গেল সে বুঝতে পারছে না। সবাইকে দেখে আয়ানও উঠে বসল।
“কি হয়েছে ‚ভাইয়া?”,তিয়াশ জিজ্ঞাসা করল।
“এখন থেকে আমরা উঠানেও খেলতে পারবো”, হাসিমুখে উত্তর দিল আকাশ।
তিয়াশ খুব খুশি হল।তাকে আর ঘরের মধ্যে বল নিয়ে লাফালাফি করতে হবে না। বড় জায়গায় খেলা যাবে।
সবাই বাচ্চাদের ঘরের দিকে গেল। সেখানে আকাশ‚তিয়াশ‚ঝিকমিক‚ঝলক আর আয়ানকে দেখে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বড়চাচা আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“বড়চাচা‚ একটা কথা বলবো?”,ঝিকমিক বলল।
“হ্যাঁ‚বলো মা”
“উঠানের দেয়ালটা ভাঙা যায় না? আমরা....”
ঝিকমিককে কথা শেষ না করতে দিয়েই তিয়াশ চেঁচিয়ে উঠলো‚“আমরা বল নিয়ে খেলবো”
“নিশ্চয়ই ”
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল।
যাক্ ‚বড়রাও শেষ পর্যন্ত বুঝতে শিখেছে।
এতদিনে তারা সত্যি সত্যি বড় হলো!!
------------------------সমাপ্ত ------------------------
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro