অপেক্ষা-০৩
দরজা খুলেই মামাকে দেখতে পেল তিথি।
- " তোমার কি আজকে সন্ধ্যায় কোনো কাজ আছে?"
- "না‚ মামা। তেমন কিছু তো নেই। কেন?"
- " আজকে দেখা করতে যেতে পারবে?"
তিথি ভাবছিল না বলবে। কিন্তু তখনই মিলির কথা মনে এল। এই সুযোগে যদি ওকেও বের করার পারমিশন পাওয়া যায়!
- " আমার কোন সমস্যা নেই। আচ্ছা মামা‚ আমি মিলিকে আমার সাথে নিয়ে যাই? ও থাকলে একটু কমফরটেবল লাগতো।"
মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন‚
- " বেশ‚ নিয়ে যাও। কিন্তু চোখে চোখে রেখ। ও যে কি পরিমাণ ফাযিল তা তো জানই।"
তিথি হেসে ফেলল।
- " আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে চোখে চোখেই রাখবো। "
- " বেশ। তাহলে আমি ছেলেকে জানিয়ে দিচ্ছি।", এই বলে রায়হান সাহেব চলে গেলেন।
নিজের অজান্তেই একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল তিথি।
**********************************************
বিকেলবেলা মামি ঘরে এলেন। মাকে হারানোর পর মামিই তার মায়ের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে।
-" শোনো মা‚ আজকে যখন ছেলেটার সাথে দেখা করতে যাবে তখন এই শাড়িটা পড়ো। বেশ সুন্দর মানাবে।"
মামি হাতে শাড়িটা দিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। শাড়িটা আসলেই সুন্দর। বেশ সুন্দর রঙটা, একেবারে সিঁদুর লাল যাকে বলে।
তিথি শাড়িটা পরলো। ইচ্ছে করেই চোখে কাজল দিল। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাতেই আর চোখ সরানোর উপায় নেই। তিথি এমনিতেই দেখতে ভালো। সাজলে আরও সুন্দর লাগে।
মিলিকে নিয়ে মামার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে ৬টা বেজে গেল। আরও আগেই আসতে পারত। কিন্তু পথে আবার মিলি তার বিখ্যাত বয়ফ্রেন্ডের জন্য উপহার কিনতে গিয়ে এক ঘন্টা লাগিয়েছে।
রেস্টুরেন্টটা বেশ নিরিবিলি। একটা শান্তির ভাব আছে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই মিলি তার সেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে জন্মদিন সেলিব্রেট করতে জানালার ধারের একটা টেবিলে চলে গেল। ছেলেটাকে দেখতে তো ভালোই‚ এখন শুধু মিলির জন্য ভালো হলেই হয়।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটাকে নিজের নাম বলতেই মেয়েটা দোতলায় যেতে বলল। কিন্তু দোতলায় গিয়ে তিথি কাউকেই দেখতে পেল না। পুরো ফ্লোরটাই খালি‚ কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো। তিথি আশেপাশে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে নিচে নেমে যাবে ভাবছিল। কিন্তু এমন সময়েই কানে এল সুরটা।
হ্যাঁ একটা মাউথ অর্গান বাজছে। ব্যালকনির দিক থেকে আসছে শব্দটা। যেই বাজাচ্ছে‚ খুব মন দিয়ে বাজাচ্ছে। প্রতিটা সুর যেন তিথিকে টানছে। নিজের অজান্তেই তিথি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটা তিথির দিকে পেছন দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের মাউথ অর্গানটা এখনও মুখের কাছে ধরা।
- "মাউথ অর্গানটা কি আপনিই বাজাচ্ছিলেন?"
তিথির অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। ছেলেটা সাথে সাথেই ঘুরে দাড়ালো। মুখে খুব সুন্দর হাসি।
তিথির মনে হল তার যেন একটা হার্ট-বিট মিস হয়ে গেল। ছেলেটাকে সে পুরোপুরি চিনতে পারছে না। কিন্তু তার হাসি, চোখ, তাকানোর ভঙ্গি সব যেন তার কতদিনের চেনা!
তিথির বিস্ময় দেখে ছেলেটার হাসি যেন আরেকটু বিস্তৃত হল। মুখে কোনো কথা না বলে হাতের মাউথ অর্গানটা আবার ঠোঁটে ঠেকালো। সাথে সাথেই বেজে উঠল যন্ত্রটা। কিন্তু এবারের সুরটা সম্পূর্ণ আলাদা।
তিথির চোখের সামনে সিলেটের সেই পুরনো দিন গুলোর ছবি ভেসে উঠলো। সেই পরিচিত গন্ডি, সেখানকার সব স্মৃতি, চেনা মানুষজন আর...
- " তুর্জ.. "
তিথির মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল সেই নাম‚ যার জন্যে তার এতদিনের অপেক্ষা।
তুর্জ মুখ থেকে মাউথ অর্গানটা সরিয়ে আবার সেই চেনা হাসিটা তিথিকে উপহার দিল।
- " যাক‚ চিনেছিস তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম চিনবিই না।"
- " তোর চশমা কই? আর চুলের এই দশা কেন? কতদিন ধরে চুল কাটিস না? আর এত রোগা কিভাবে হলি?"
তিথির প্রশ্নবাণে তুর্জ হো হো করে হেসে উঠল।
- " এতদিন পরে দেখা হল‚ আর তোর প্রথম প্রশ্ন কিনা আমার চশমা কোথায়! "
তিথি কি বলবে বুঝতে পারছিল না। প্রশ্নগুলো নিজে থেকেই বেরিয়ে গেছে। তুর্জ অনেক বদলে গেছে। তিথির সেই নাদুস নুদুস‚ চশমা চোখের বন্ধুর সাথে আজকের তুর্জর আকাশ পাতাল তফাত!
- " না মানে.. আমি.. আসলে..."
- "আরে থাম,থাম। এত নার্ভাস হওয়ার দরকার নেই। আমার নিজের মা-ই আমাকে বিদেশ থেকে ফেরার পর চিনতে পারে নি!"
- " কেমন আছিস?"
- "দেখে কেমন মনে হচ্ছে?"
- " অনেক বদলে গেছিস।"
- "তুই আগের চেয়ে আরও বেশি সুন্দর হয়েছিস।"
তিথির চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠলো।
- " এরপরের জীবনটুকু আমার সাথে কাটাতে আপত্তি আছে?"
তিথির পরক্ষনেই মনে পড়লো সে কেন এখানে এসেছিল। তার চোখে-মুখে উপচে পড়া বিস্ময়।
- "তুই.. তুই সেই.."
তিথিকে কথা শেষ করতে দিল না তুর্জ।
- " হ্যাঁ‚ আমিই তোর মামার অতি পছন্দের পাত্র। এখন তুই বল তোর কি মত? আমি কি আপনার পাণিপ্রার্থী হতে পারি?"
তুর্জর হাত তিথির দিকে বারানো। এক মুহুর্তও সময় লাগল না তিথির সিদ্ধান্ত নিতে। দৌঁড়ে গিয়ে তুর্জকে জড়িয়ে ধরলো।
তিথিকে জড়িয়ে ধরে যেন এক প্রশান্তি অনুভব করল তুর্জ। কতদিন অপেক্ষা করেছে সে আজকের এই দিনটির।
ঠিক এমন সময় বৃষ্টি নামলো চারদিক ছাপিয়ে। ঠিক সেদিন যেমন হয়েছিল। কিন্তু তফাত শুধু এই যে; সেদিনের বৃষ্টি তিথি আর তুর্জকে এক অজানা অপেক্ষার দিকে ঠেলে দিয়েছিল‚ আর আজকের বৃষ্টি তাদের সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক নতুন অধ্যায় শুরুর শুভেচ্ছা জানাচ্ছে...
************* সমাপ্ত ***************
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro