
বুকের খাঁচায় প্রত্যাশার দাঁড় কাক বাসা বাঁধে
অবেলার রোদে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া এক দাড় কাঁক কি মনে করে সেদিন ঢুকে পড়েছিল আমার রঙ ওঠা ধূসর দেওয়ালের একখানা ছোট্ট কুঠরিতে...
আমার ঘোর লাগা চোখে দাঁড় কাকের মুখে এক খন্ড কাঠ দেখে ক্ষনিকের জন্য হতচকিয়ে গিয়েছিলাম। হুট করে তাকে দেখে মনের মধ্যে খিচাং লাগলো, ব্যাটা সিগারেট খাচ্ছে নাকি! সোনালী আর সাদা কালারের! বেনসন কিংবা গোল্ডলীফ এর আবেশ।""উহু! কাঠ, এইটা সিগারেট না!", কাকের আচমকা উত্তর। আমি চোখ পিটপিট করতে লাগলাম। মাথায় আমার ডিস্টার্ব আছে, এইটা অনেকেই কয় কিন্তু, আমি সিওর ছিলাম না। " এ কিরে! কথা বললি নাকি? " কখন?"কথা কি তুই বললি, নাকি আমি জাস্ট ভাবলাম! --"নাহ! কথা আমি বলি নাই। আপনেই ভাবছেন!"---"আসলেই বলিস নাই?"---"জীবানেও না!"আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে মাথা চুলকাতে লাগলাম! --"এ তো দেখি সব কথার উত্তর দিচ্ছে তাও কয় আমি না!"কাকটা সম্ভবত ঢুকেছে আরো অনেকক্ষন আগেই।আমার হাল্কা বাদামী রঙের চালের ছোট্ট ফুকরির মাঝ দিয়ে ঘুচিয়ে দিল তার পোঁড়া কিন্তু এখনো অখন্ড একখানা শরীর। এসে ঠিক দাঁড়িয়ে পড়লো আমার চেয়ারের উপর ক্লথ নামক অপাললিক শিলা দ্বারা গঠিত আমার দলা করে রাখা আধ-ময়লা কাপড়ের মাউন্ট এভারেস্টের চূড়োয়। অবশ্য কাকের উদাসীন দৃষ্টিতে সেই স্থান, কাল, পাত্র নিয়ে কোনো ব্যাতি ব্যাস্ততা নেই, কিন্তু তার স্বচ্ছ কিন্তু কালো দুটি চোখে এক অদ্ভুত আলোর রঙের ছটা খেলছে। এ সেই অন্ধকারের আলো। আমি কিভাবে জানি বুঝে গেলাম তার অনেক কিছু বলার আছে আমাকে! হয়তো আমাকে নয়, তবে বলার কিছু অবশ্যই আছে। কাকে তা আমি জানি না! কখনো জানতে পারবো না। আমি আমার বিছানার উপর আধশোয়া, আর মশারীর অর্ধেকটা এখনো খাটের এক কোণায় ঝুলছে। তা ঠিক কত কাল আগ থেকে ঝুলছে তা নিয়ে মতবিরোধ আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। একজনের ঘরের মশারির অবয়ব দেখে একজনের মনের অবস্থা কি বিশ্লেষণ বের করা সম্ভব? এক প্রত্নতাত্তিকবিদ বহু মেধা খাটিয়ে একবার বের করলেন, মৌর্য সম্রাজ্যের রাজাদের ধারনা এই ঔদ্ধত্তপূর্ণ তাবুর পিছনের রহস্য আর্য সম্রাজ্যের পন্ডিতগণ বলতে পারবেন। চদ্রগ্রুপ্ত মৌর্যেরদলিল দস্তাবেজ ঘেটেও দিন তারিখ উল্লেখ পাওয়া যায়নি কবে, কখন, কিভাবে এই মশারীর উত্তান হয়েছিলো। কিন্তু হয়েছিল ঠিকই। কোনো এক পন্ডিত অতীত-বাণী করেছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে বৈদিক যুগের সূচনাকালে যখন মশাগণ হুল ফুটিয়ে মানুষকে ধরাশয়ী করতে লাগলো, তখন তাদের বিরুদ্ধে অনশন করতে গিয়ে এই মশারী বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে উত্তিত হয়ে থাকতে পারে , অথবা কোনো রমণীর শোনানো বিরহী গানে নিজেকে লুকায়িত করতে এই মশারীর পর্দা অন্তরের পর্দা হয়ে থাকতে পারে। এই শুনে অবশ্য আমার মন বিশেষ পুলকিত হলো না। আপনি অবশ্যই লোক ভালো! আমার এই চেয়ারের উপর কাপড়ের জঞ্জাল কে যেহেতু আপনি মাউন্ট এভারেস্টের সম্মান দেওয়াতে আপত্তি করেন নাই, তাই,অনুরোধ রইলো আমার এই জীর্ণ ফুটো ওয়ালা ঝুলন্ত মশারীকেও আপনি ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান খেতাবে আখ্যায়িত করার জন্য আমাকে মৃত্যুদন্ড দিবেন না এটলিস্ট। কারণ আমি আমার জীবনের সকল অর্জন, বর্জন, কল্পনা, জল্পনা, মার্জনা, আবর্জনা, অনুশোচনা, ইতিহাস, পাতিহাস, ফ্যান্টাসি, একস্টেসি সব এখান থেকেই উদ্ভব। পাওয়া না পাওয়ার চ্যপ্টারগুলি এই মশারীর ভিতরে উদ্ভব হয়, আবার সেই স্বপ্নগুলি কুড়িতেই ঝরে যায়, শুধু মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকে আমার এই মশারি। যাই হোক, কাকটি চেয়ার থেকে উড়ে এসে আমার খাটের পাশে টেবিলের উপর এসে বসল আর ঠোঁটের কাঠটি টেবিলের উপর ফেলে দিলো। কাঠটা টেবিলের উপর পড়ায় ঠক করে একটা শব্দ হলো, সেই শব্দের তরঙ্গ ধ্বনিতে মনে হলো এই কাঠটা যেন ঘাটে এসে ধাক্কা দিলো ডাঙায়। অল্প কিছু আগেই বৈঠা হয়ে সাতরে বেড়াচ্ছিল যমুনায়। নৌকা তো ভিড়লো একলা তীরে, কিন্তু পথিক গেলো কোথায়! 'মাস্তুলে বসে একলা ডাকছে কাক। কাকের ডাকে দেয়না সাড়া কেউ, সাগর জলে ছিন্ন তারার দাগসাক্ষী শুধু তিন মোহনার ঢেউ।'কাকটার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আছি অনেক ক্ষন। জানিনা ঠিক কতক্ষণ।আমি যখনি তার একটু কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সে ভয় পেয়ে দূরে সরে যাচ্ছিলো, কিন্তু চলে যাচ্ছিলো না। তার সাহস ছিলো বটে, তবে গলা উঁচু করে বলার মত অতটাও না। এদিক থেকে সে বোধহয় আমারই মত। সাত সমূদ্র পাড়ি দিয়ে যেই কথা বলার কথা বলতে গিয়ে দেখি তাই বলার আর সাহস নাই। অবশ্য এই ব্যপারে আমার দ্বিমতও আছে। 'প্রেয়সী যদি আঁখি পল্লবে চাহিয়া, তব বুঝিতে না পায় সে ভাষা, সেই কথা বলিয়া বলো আর কাজ কি?'চোখের আইরিশে যে ধরেনা এতো কথার রাশিমালা,'যখন থাকবি না তুই আর এ সঙ্গীতে,বুঝিয়ে দিবি ভুলেই গেছিস ভঙ্গিতেএকলা ঘরে লুকিয়ে তবু আমার জন্য সাজবি?মরণব্যাধির হঠাৎ করে ভীষণ পেলে তেষ্টা,চুপটি করে আমরা কেবল দেখবো মোদের শেষটা,সেদিন কি তুই আমার জন্য আর দুটা দিন বাঁচবি?এই যে, আমি কাকটার দিকে তাকিয়ে আছি আর বকবক করেই যাচ্ছি, কাকটা কেবল বাম পা থেকে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো, আমার টেবিলের পাশে যে জানালা দিয়ে হিরহির করে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে অন্তর কাঁপিয়ে, সে তাকিয়ে ছিলো দখিনের সেই জানালার দিকে।এই বাতাসের নাম, 'জার্নি টু নিউমোনিয়া' অথবা জার্নি টু ইনফ্লুয়েঞ্জা' এর নীচে কিছুতেই না। বাতাসের একটা স্ট্যাটাস আছে না?তাই আমি কথা না বাড়িয়ে, কানের বোটা গুটিয়ে ঢুকে পড়লাম আমার ছন্নছাড়া মশারিতে। আহা! কি শান্তি! কাকটা আছে কি নাই, আমি তা আর জানি না। জানার দরকারও নেই।কারণ প্রত্যাশার যে দাড়কাক হৃদয়ে বাসা বাধে, সেই দাড়কাক এতো সহজে পাখা মেলে না। ০২.১০.২০২১
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro