আলোর গায়ে আলো লেগেছে
#আলোর_গায়ে_আলো_লেগেছে
যিনি আমায় দেখতে এসেছেন তাঁর পরনে কালো পাঞ্জাবি। কালো পাঞ্জাবি আমার জন্মের অসহ্য। দেখেই ইচ্ছে করছে দু-হাতে পাঞ্জাবি টেনে ছিঁড়ে ফেলি। পাঞ্জাবির কলারে একটা জড়ির সুতা বোধহয় ভদ্রলোককে খুব খোঁচাচ্ছে; বারবার ঘাড় চুলকে লাল করে ফেলেছেন। কলার বারবার পেছন দিকে টানছেন। একবারও আমার দিকে তাকাননি তিনি। ভদ্রলোকের বড় মামা আমায় প্রশ্ন করলেন,
---আপনি কেমন আছেন মা?
আমি উদাস কণ্ঠে বললাম,
---ভালো নেই আঙ্কেল। যবে থেকে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তবে থেকে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
ড্রয়িংরুমে বসা সবাই হেসে ফেললো। শুধু পাত্র হাসলো না। বরং পাত্রের মুখ পাঞ্জাবির মতোই কালো হয়ে গেল।
খালামণি আমায় এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন।
---যাও তো মা তুমি একটু মাহীনকেও দুশ্চিন্তায় ফেলো তো। তোমার সাথে করে নিয়ে যাও। তোমার বারান্দার বাগানটা মাহীনের নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে।
আমি উঠে এলাম। কালো পাঞ্জাবির মাহীন সাহেব আমার পিছু পিছু এলেন।
আমার ঘর অবধি এসে প্রথম যে কথাটা বললেন তা হলো,
---পাঞ্জাবির ট্যাগের নাইলনটা রয়ে গেছে। ওটা কাটতে হবে। আসলে নতুন পাঞ্জাবি তো; গাড়িতে বসেই পরলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এসেছি।
আমি কাঁচি বের করে সহজ গলায় বললাম,
---গায়ে কাপড় রেখে কাটতে হয় না। পাঞ্জাবিটা খুলুন আমি কেটে দিচ্ছি।
মাহীন সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পাঞ্জাবি খুললেন।
আমি কাঁচি দিয়ে পাঞ্জাবির নাইলন নয় বরং পুরো পাঞ্জাবিটা কেটে চার ভাগ করে ফেললাম। আরো কুচি কুচি করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মাহীন সাহেবের বিস্মিত হা মুখ দেখে ইচ্ছেটা বাদ দিলাম।
---আপনি এখন কি পরবেন সেটা নিয়ে কি দুশ্চিন্তা করছেন? দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আমি আলমারি থেকে আরিফের জন্য কিনে রাখা গাঢ় নীল পাঞ্জাবিটা বের করে দিলাম। সাতাশশো টাকা দিয়ে ফ্যাশন মার্ট থেকে কেনা। আমি প্রথম বেতন পাবার পর কিনেছিলাম। আরিফকে দেওয়ার সুযোগ হয়নি। ও নিজের ক্যারিয়ারে ব্যস্ত তখন। সেরা জার্নালিস্ট হবে।এওয়ার্ড পাবে। টিভিতে সব বড় বড় মানুষের ইন্টারভিউ করবে। কত স্বপ্ন! নীল পাঞ্জাবি স্বপ্নের তলে চাপা পড়ে গেল। আমার পাঞ্জাবি পরে হাঁটবার সময় কই তার! পাঞ্জাবির প্যাকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সে আমায় ফেরত দিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিল,
---আমি এখনও সিরিয়াস নই রিশা। জীবনের সব মেটাফোরকে ধরতে চাই রিশা।
মাহীন সাহেব যথেষ্ট জড়তায় পাঞ্জাবি হাতে নিলেন।
---আমি গিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দেবো এটা।
---ফেরত দিতে হবে না। ওটা যার জন্য কেনা হয়েছিল সে এখন ইচ্ছে করলেও আমার দেয়া পাঞ্জাবি পরতে পারবে না।
মাহীন সাহেব কোনো কথা না বলে পাঞ্জাবি পরলো। সাইজে একটু ছোট হলো। তাও বেশ লাগছিলো দেখতে। আমি মাহীন সাহেবের চার টুকরো করা পাঞ্জাবি ভাঁজ করে প্যাকেট করে দিলাম।
প্যাকেটটা হাতে নেবার সময় মাহীন সাহেব খুব নিচু স্বরে বললেন,
---আপনার দেয়া পাঞ্জাবিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে রিশা।
আমি হাসলাম।
---আমিও পাঞ্জাবিটা খুব পছন্দ করে কিনেছিলাম।
মাহীন সাহেবরা চলে গেলেন। রাতে মাহীনের মামা ফোন করে জানালেন, উনারা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের একটা ডেট চান। আমার মাহীনকে পছন্দ হয়েছে কিনা! বাবা জানিয়ে দিলেন আগামী সোমবারেই হোক। অবশ্য বাবাকে আমার বলাই ছিল। আরিফ চলে যাবার পর আমি বাবার উপর সব ছেড়ে দিয়েছিলাম।
বিয়ের দিনে মাহীন আমার দেয়া পাঞ্জাবি পরে বর সেজে চলে এলো। আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। আমি কত ভারী সাজগোজে বউ সেজে আছি অথচ সে কিনা একটা কটন পাঞ্জাবি পরে চলে এলো! আমার পাশে কেমন হুতোম দেখাবে ওকে।
বিয়ের পর গাড়িতে বসে আমি খুব রেগে বললাম,
---পাঞ্জাবি খুলুন তো। একই পাঞ্জাবি গায়ে দেখতে বিরক্ত লাগছে। পছন্দ হলো বলেই এটা গায়ে আঠা দিয়ে সেঁটে ফেলতে হবে নাকি?
মাহীন পাঞ্জাবি খুলে বললো,
---এটা অন্তত কেটো না রিশা। আমি খালি গায়ে বাড়ি ফিরবো। তবু কেটো না।
আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে মাহীনকে জিজ্ঞেস করলাম,
---আচ্ছা, একটা মেয়ে যে প্রথম দেখায় আপনার পাঞ্জাবি কেটে ফেললো তাকে আপনি কেমন করে বিয়ে করলেন বলুন তো। আমাকে আপনার পাগল মনে হয় নি?
মাহীন হেসে বললো,
---আমার মা একবার বাবার একটা শার্ট এরকম কেটে কুচিকুচি করে ফেলেছিলো। আর আমার মা আমার বাবাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসতেন।
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
---আমি কিন্তু আপনাকে একটুও ভালোবাসবো না।
মাহীন চুপচাপ আমার হাত ধরে জানালার অন্য পাশে তাকালো। আমার চোখ ভিজলো। মাহীনের কোলে আমার দেয়া নীল পাঞ্জাবি। ওর ডান হাতে আমার হাত শক্ত করে ধরা।
সেই প্রথম আমি ফিল করলাম, আরিফের চলে যাওয়াটা মাহীনের আমার জীবনে আসার গল্প হবে বলেই বোধহয় ঠিক করা ছিল।
বিয়ের চার বছর পরের কথা…
মাহীনের একটা টিভি ইন্টারভিউতে ডাক পরলো। সে তখনে দুদকে কাজ করছে। একটা জমজমাট ইস্যূ নিয়ে কথা বলতে গেল। ইন্টারভিউ যিনি করতে এলেন, তাঁর নাম আরিফ আহসান।
মাহীন আমার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউতে গেল।
আমি টিভির সামনে বসে খুব অনুভব করলাম, আমার দেয়া নীল পাঞ্জাবিটা আরিফের চোখে দারুণ বিঁধছিলো ব্যথা আর যন্ত্রণা হয়ে।
সেদিন ইন্টারভিউ থেকে বাসায় ফিরে মাহীন আমায় জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি কিন্তু খুব বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতরে একটা ঝড় চলছে।
ইচ্ছে করেই কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলাম না।
তার ঠিক দুদিন পর অফিসের জন্য বেরোবো, মাহীন একটা খাম আমায় বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
---ওটা তোমায় সেদিন আরিফ আহসান দিয়েছিলেন।
আমি খামটা হাতে নিলাম না। যা আমি ছেড়ে এসেছি তা আর ছুঁয়ে দেখতেও চাই না।
মাহীন নিজেই খাম ছিঁড়লো। ভেতরে চিঠি।
আমায় জোর করে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো,
---আমি পড়বো তুমি শুনবে। যদি শুনতেও তোমার আপত্তি থাকে তাহলে আমি ভেবে নেবো তুমি ভীতু। লুকিয়ে শুধু আরিফের জন্য কেনা পাঞ্জাবিই আমায় দিতে পারো, তাঁর কথা উপেক্ষা করে আমায় পাশে রাখতে পারো না।
আরিফ চিঠি পড়তে শুরু করলো,
মিসেস মাহীন,
কী অদ্ভুত তাই না রিশা? আজ তোমায় অন্যজনের নামে ডেকে লিখছি।
কারণটা ব্যাখ্যা করি… এই পৃথিবীতে সবজিনিসের একটা কনটেম্পরারি ম্যাচ আছে বুঝলে। আমি যদি রঙের কথাই বলি, পাতা সবুজ বলেই হয়তো সব ফুলের রং অত সুন্দর দেখায়। একবার ভেবে দেখো তো, বেগুণী পাতায় তোমার লাল জবা ফুটলে কেমন ক্যাটক্যাটে দেখতে লাগতো। মানুষও ঠিক তেমনি। প্রতিটা মানুষেরও এমন ম্যাচ আছে। সমস্যা হলো সবাই সেই পারফেক্ট ম্যাচ পায় না। হাতে গোণা ভাগ্যবান ক'জন পায়। তারা ম্যাচ চায় না, তাও পায়। তুমি পেয়েছো। তাই মিসেস মাহীন লিখলাম তোমায়!
তোমার মতো অসাধারণ একটি মেয়েকে আমি সেদিন কী অবলীলায় উপেক্ষা করেছিলাম। আজ দেখো, সেই উপেক্ষা আমার সমস্ত জীবনের উপর আফসোসের ভার হয়ে বসেছে। তোমাকে এত সুখী হতে দেখে বুকের ভেতরে খুব করে 'কেন পেলি না' নামক বেসুরো গান হচ্ছে। উহু। তোমার সুখের হিংসেয় নয়, আলোর গায়ে আলো ছুঁয়েছে বলে। আমি ভেবেছিলাম আমি জিতবো। তুমি কিচ্ছু চাওনি অথচ সব সুখ, জিত আর আনন্দের আলো তোমার গায়ে গিয়ে বসেছে।
মাহীনকে আমার অসাধারণ লেগেছে। অবশ্য আমি জানি আমি রায় না দিলেও তোমার চলবে।
রিশা, আজ আমার খুব রিগ্রেট হচ্ছে। খুব। মনে হচ্ছে ক্যারিয়ারটা ছাড়লেও হতো। অন্তত, তোমার মতো এক টুকরো আলো সবসময় ছু্ঁয়ে রাখতো আমায় এ জীবনে।
ইতি
আরিফ।
আমার আমৃত্যু আফসোস হোক তোমার সকল সুখ।
চিঠি শেষ করে দেখলাম মাহীন চোখ মুছলো।
আমি খুব হাসলাম।
---এমন করে কাঁদছো, যেন আমি নই তুমি ওর প্রেমিকা ছিলে।
---বেচারা তোমায় না পেয়ে কত কষ্টে আছে, ভাবতেই বুকে জ্যাম লাগছে।
আমি গাড়ি ঘুরিয়ে একটা রেস্তোরায় গেলাম।
---কী ব্যাপার অফিস যাবে না?
আমি মাহীনের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ভাবে হাসলাম।
ওয়েটার ডেকে অর্ডার করলাম,
---তিনটা আইসক্রিম দিন তো।
---তিনটা কার জন্য? বাড়তিটা কে খাবে?
আমি গম্ভীর স্বরে বললাম,
---এখন থেকে আমাদের সবকিছু তিনটে অর্ডার হবে।
মাহীন বোকা হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে।
আমি মাহীনের সেই বোকামো ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আসলেই তুমি আমার জীবনের আলো মাহীন। আমার জীবনের আরিফ নামক অন্ধকার তো তুমিই ছাপিয়ে গিয়েছো।
~শেষ~
#তৃধা_আনিকা
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro