পরিনয়
আকাশটা আজ ভীষণ মেঘলা সাথে মৃদু বাতাস বইছে.. মনে হচ্ছে একটু পর ভারী বৃষ্টি এসে সবকিছু ভিজিয়ে দিবে.. ছাদের এক কোনায় দেওয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি বৃষ্টি আসার আগ মূহুর্তটি.. কিভাবে যেন দুটো বছর পার গিয়েছে চোখের পলকে.. যাকে প্রথম দেখায় এক মূহুর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিলাম আমি.. ভাবতে পারিনি এতো সহজে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকে পাবো.. যে আমার সংসার আলোতে ভরিয়ে দিবে.. যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ.. এসব ভাবতে ভাবতে ডুব দিলাম অতীতের সেই আনন্দময় সময়টুকুতে..
বাবার ইচ্ছেতে আমেরিকায় গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে দেশে আসার কয়েক মাস পর মা তাড়া দিলো একমাত্র বউ ঘরে আনার.. ধাক্কাটা খেলাম কিছুদিন পর যখন বাবা-মায়ের সাথে ছোট কাকীর দূর সম্পর্কের ভাতিজি দেখতে গিয়ে.. এই তো সেই মেয়ে,যাকে আমার বন্ধু তমালের ভার্সিটির নবীনবরণ অনুষ্ঠানে দেখে থমকে গিয়েছিলাম আমি.. মঞ্চে গানের তালে তালে তার নাঁচের প্রতিটি কদমে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিলো.. উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটিকে পরীর চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছেনা.. চোখ দুটো চঞ্চলতায় ঘেরা! ঠোঁটের হাসিতে হাজারো মুক্ত ঝরে পড়ছে.. আর আমি পুরো সময়টা জুড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছিলাম সামনের দৃশ্যটি.. যখন হুশ আসলো দেখলাম মেয়েটি কোথাও নেই.. পাশ থেকে তমাল বলে উঠলো,,
"কি হল শ্রাবণ,এতটা সময় ধরে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস?কি ভাবছিস এতো? সুমনের নাঁচটা দারুণ হয়েছে.. তাইনা?"
"সু সুমন! এই পরীটার নাম তাহলে সুমন.. আচ্ছা তুই কি চিনিস মেয়েটাকে?" শ্রাবণ বললো,,
তমাল হাসি দিয়ে বললো," হ্যাঁ রে,এই মেয়েটা আমাদের স্নেহার বান্ধবী.. অনেকবার বাসায় গিয়েছিলো.. সেই হিসেবে চিনি.. কেন বলছিস বল তো?"
"আরে না না! এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম" শ্রাবণ থতমত খেয়ে জবাব দিলো.. আগ বাড়িয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হলনা আমার.. বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করলেই পিঞ্চ করা শুরু করে দিবে এই তমালটা.. তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে হলো..
সেদিন ভেবেছিলাম হয়তো মেয়েটার সাথে আর কখনো দেখা হবেনা.. কিন্তু আজ এভাবে এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটার দেখার পাবো ভাবতেই পারিনি.. একান্তে কথা বলার সময় তার মিষ্টি রঙের জামদানী শাড়ির সাথে রঙ মিলিয়ে পড়া কাঁচের চুড়ির শব্দগুলো হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছিলো আমার.. মন বলছে এই তো সেই মেয়ে যাকে নিয়ে কল্পনাতে হাজারো স্বপ্ন বুনেছিলাম আমি.. মন দাবি করছিলো "সুমো শুধু আমার হবে.. শুধুই আমার" অবশেষে যখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে দুটো পরিবার এক হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় আমিই হয়েছি.. আমার মনের রাজকন্যা আমার হবে.. কিন্তু মন আনচান করছিলো সত্যিই কি সুমো রাজি এই বিয়েতে??
দোটানায় ভুগতে ভুগতে দ্বিতীয় দিন সিদ্ধান্ত নিলাম ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো সে বিয়েতে রাজি কিনা! যেই ভাবা,তমালের ছোট বোন স্নেহার কাছ থেকে নাম্বার জোগাড় করলাম.. ফোন দেওয়ার আগ মূহুর্তে হার্টবিট ক্রমাগত বাড়ছে.. সাহস করে কল দিয়ে দিলাম.. রিং পড়ছে আর বুকের মধ্যে ধুকধুক করছে! রিসিভ হওয়ার পর ওপাশ থেকে সুমধুর কন্ঠ শুনে পুরো শরীর জুড়ে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল..
"আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন? হ্যালো,কে?"
"আ আ আমি.. শ্রাবণ চৌধুরী.. যার সাথে আপনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে"
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ সাড়া পায়নি.. একটু পর "জ্বি বলুন?"
ফিঙ্গার ক্রস করে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,"আপনার এই বিয়েতে আপত্তি নেই তো? আপত্তি থাকলে বলুন? ভয় পাবেন না.."
সুমোকে স্নেহা অনেক আগেই কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো এই লম্বু তার হবু বর তার নাম্বার নিয়েছে.. কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ফোন আসবে তা ভাবতে পারেনি.. লজ্জা,উত্তেজনা সবকিছু মিলিয়ে সুমো কাঁপছে.. বাবা-মায়ের পছন্দই তার পছন্দ.. তাই সে বিয়েতে আপত্তি করেনি.. মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও বাবা সবসময় তার সকল আবদার,ইচ্ছে পূরণ করেছে.. তাই তাদের সব সিদ্ধান্ত সুমন নিজের জন্যে শতভাগ ভালো মনে করে.. ফোনের অপর পাশের মানুষটা এভাবে বিয়েতে রাজি কিনা জিজ্ঞেস করে তাকে আরও লজ্জায় ফেলে দিয়েছে.. ফোনের অপর পাশের মানুষটা একটু বেশিই লম্বা কিন্তু দেখতে খারাপ নয়.. বরং সুমোর কাছে মনে হয় শ্রাবণ তারচেয়ে একটু বেশিই সুন্দর.. হঠাৎ ওপাশ থেকে শব্দ আসায় সুমোর কল্পনার সুতো ছিঁড়ে গেল..
"কি হলো,আপনি কি বিয়েতে রাজি নন?" শ্রাবণ আবার জিজ্ঞাসা করলো..
"জ্বী আসলে,আমি আসলে,,আমার বিয়েতে কোন আপত্তি নেই" সুমো চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো..
শ্রাবণের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো.. মনে মনে আল্লাহকে হাজারো শুকরিয়া জানালো..
ওদিক থেকে সুমোর ডাক পরার কারণে সুমো রাখছি বলে কল ডিসকানেক্ট করলো.. ফোনের টুট টুট শব্দে শ্রাবণ বুঝতে পারলো ম্যাডাম ফোন রেখে দিয়েছে.. মুচকি হেসে শ্রাবণও ফোন রেখে দিলো.. নিজে নিজেই আওড়াতে লাগলো,"ইউ আর ফল ইন লাভ শ্রাবণ! ইউ আর ফল ইন লাভ!"
---------------------------------------------
আজ শুক্রবার আমার আর সুমোর এনগেজমেন্ট.. গত ১০দিনে আমরা একে অপরের সাথে অনেকটা ফ্রি হয়েছি.. রাতে কথা বলতে শুরু করলে কখন যে ভোর হয়ে যেত খবরই পেতাম না.. দুইজনে সকালের নামাজ সেরে ঘুমাতাম.. আমি চেয়েছি সুমো আমার সাথে কমফরটেবল ফিল করুক.. ভিডিও কলে কথা বলার সময় আমার নানারকম অদ্ভুত প্রশ্নে সুমো যখন লজ্জায় নুয়ে পড়তো আমি ফোনের অপর পাশ হতে তা উপভোগ করতাম.. এই লজ্জাটা সুমোর সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে.. সুমো খুব কম কথা বললেও এই কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছি সে আমার সাথে কিছুটা ইজি হয়েছে.. হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গলো..
"কিরে শ্রাবু,কটা বাজে খেয়াল আছে তোর?আজ তোর এনগেজমেন্ট আর তুই দিনের ১০টা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস? জলদি ফ্রেশ হয়ে আয় বাবা.. আমি নিচে অপেক্ষা করছি তোর জন্যে.."
"আসছি মা,তুমি নিচে যাও.." তারপর তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে..
সারাদিনের সকল কাজকর্ম শেষ করে মাগরিবের পর আমরা রেডি হয়ে রওনা দিলাম সুমোদের বাসায়.. সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর দেখলাম দূর থেকে সুমো আসছে.. মেয়েটার সৌন্দর্য দিন দিন কি বৃদ্ধি পাচ্ছে নাকি আমার চোখেই অপরুপ মনে হচ্ছে? আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম.. বাবা এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে সুমোর পাশে দাঁড় করালো.. আমি তখনো আড়চোখে সুমোকে দেখছিলাম.. মা এসে আমার হাতে রিং ধরিয়ে দিলো.. অবশেষে দুজন দুজনকে রিং পড়িয়ে আমরা এক হয়ে গেলাম❤ সবাই যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো আমি সুমোর কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,"মাশা-আল্লাহ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে.. " সুমো একথা শুনার পর তাড়াতাড়ি দূরে সরে গেলো.. বেচারি লজ্জা পেয়েছে.. মনে হচ্ছিলো সুমোকে আমি আমার করে নিলাম.. সেদিন সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের বিয়ে সামনের মাসের ২২তারিখে হবে.. আমি তো সেদিনের পর থেকে দিন গুনছিলাম কবে সুমোকে একেবারে নিজের করে পাবো.. কবে সে মিসেস শ্রাবণ চৌধুরী হবে!
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের দিনটি এসে গেলো.. সুমো চেয়েছিলো আমাদের বিয়েটা সিম্পলভাবেই হবে.. আমিও সুমোর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়েটা সিম্পলভাবে করার সিদ্ধান্ত নিলাম.. সামনের পর্দার অপর পাশে সাদা-লাল মিশ্রণের বেনারসি শাড়ি পড়ে বসে থাকা মেয়েটা একটু পর আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে.. মেয়েটির একেক সময় একেক রুপ দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছি.. কবুল বলার সময় সাধারণত মেয়েরাই কান্না করে কিন্তু আজ কবুল বলার পর সাইন করার সময় আমার চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পরেছে.. হ্যাঁ এটা আমার সুখের কান্না.. ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার কান্না.. উপরে চোখ তুলে তার সাথে চোখাচোখি হতেই দেখলাম সে আমাকে মিষ্ঠি একটা হাসি উপহার দিলো.. তার চোখে তখনও আপনজনের থেকে দূরে যাওয়ার কষ্টের অশ্রু ঢেউ খেলছে..
ভালোবাসি কথাটা না বললেও কিছুদিন আগে আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমার প্রতি তার কেয়ার,আমাকে দেখতে আসা,আমি কবে সুস্থ হবো তা নিয়ে চিন্তা সব মিলিয়ে বুঝে গিয়েছি সেও আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসে.. প্রচন্ত ভালোবাসে.. সেদিন থেকে শুরু হলো,হাসি,কান্না,অভিমান,কেয়ার সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার.. মেয়েটা শুধু আমার নয় আমার পুরো পরিবারের মন জয় করে নিয়েছিলো ধীরে ধীরে.. দেখতে দেখতে আমাদের সংসারের দুইটি বছর কেটে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি.. পিঠের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে কল্পনার সুতো ছিঁড়ে গেলো সাথে বুঝতে পারলাম এতক্ষণ যার কল্পনায় বিভোর ছিলাম সেই মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছে.. আমার অর্ধাঙ্গিনী মিসেস শ্রাবণ চৌধুরী..
"গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে এখানে তুমি দাঁড়িয়ে কি করছো? অনেকটাই তো ভিজে গিয়েছো.. চলো রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নাও.." সুমো বললো..
"তোমায় নিয়ে ভাবছিলাম.. চলো না আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজি?" শ্রাবণ নরম ও নেশাতুর গলায় বললো..
"লোকটা এখনও পাল্টেনি.. সে ভালো করেই জানে তার এমন নেশাতুর চাহনি আমায় ঘায়েল করে দেয়.. লজ্জায় পড়ি আমি.. তাইতো সবসময় এমনটা করে আমাকে দুর্বল করে দেয় লম্বুটা.." সুমো মনে মনে বললো..
"কি হলো,কি ভাবছো এতো? আচ্ছা আমাদের বিয়ে হয়েছে দুটো বছর হলো.. তুমি এখনও আমাকে 'ভালোবাসি' কথাটা বলোনি.. তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো না.." শ্রাবণ গাল ফুলালো..
"আচ্ছা,তাই নাকি? ভালোবাসি কথাটা বলা লাগে নাকি? বুঝে নিতে পারোনা?" সুমো পায়ের পাতা দুটি উঁচু করে শ্রাবণের গলা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো..
"তোমার মুখে কথাটা শুনার ভীষণ ইচ্ছা আমার.. প্লিস বল না জান.." শ্রাবণ বাচ্চাদের মতো বায়না ধরলো..
সুমো শ্রাবণের চুলে হাত দিয়ে চুলগুলো নাড়াচাড়া করে বললো,"আমার না তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো"
"হ্যাঁ বলো,তার আগে ভালোবাসি বলো.. তারপর একটা না হাজারটা শুনবো আমি" শ্রাবণের ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসি..
সুমো শ্রাবণের কানের কাছে মুখ নেওয়ার চেষ্টা করছিলো.. কারণ লম্বুটার নাগাল সে পায়না.. শ্রাবণ বুঝতে পেরে সুমোকে টেনে উপরে তুললো যাতে সুমোর সুবিধা হয়.. সুমো কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,
"মিস্টার শ্রাবণ চৌধুরী,দ্যা গুড নিউজ ইজ... ইউ আর গোয়িং টু বি অ্যা ফাদার" সুমো লজ্জায় মুখ ডেকে নিলো..
"হোয়াট! তুমি সত্যি বলছো সুমো? আমি বাবা হবো? সত্যি আজ আমি অনেক বেশি খুশি.. ধন্যবাদ সুইটহার্ট আমার লাইফে এসে আমাকে পরিপূর্ণ করে দেওয়ার জন্যে.." শ্রাবণের খুশির চোটে চোখে পানি এসে গেছে..
সুমো শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো,"তোমাকেও ধন্যবাদ আমার জীবনে এসে জীবনটা এত সুন্দর করে দেওয়ার জন্যে..
ভালোবাসি... ভালোবাসি"
শ্রাবণ আজ সারপ্রাইজড.. আজ একটু পর পর সুমো এত শক দিচ্ছে যে সে কন্ট্রোল করতে পারছেনা.. নিজেকে আজ সত্যিই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে.. আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে হাজারো শুকরিয়া জানালো সুমোকে তার জীবনসঙ্গী করার জন্যে❤❤
সমাপ্ত
[বিঃদ্রঃ শ্রামন আমার ফেভারিট জুটি.. তাই তাদের নিয়ে একটা হ্যাপি এন্ডিং দিলাম❤]
Writer.....AnjumFahima93
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro