৯- দুঃস্বপ্নের প্রথম প্রহর (প্রথম পর্ব)
কোথায় যেন একটা কল করল আবীর। তারপর কালো রঙের একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে সানের সাথে বেড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। শীতকাল এখনো আসেইনি পুরোপুরি, অথচ কি ভীষণ হিম হিম করা ঠাণ্ডা।
" আচ্ছা তোকে কি বলেছি, ছোটবেলায় আমাদের ক্রিকেটের বল লেগে প্রিয়ার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? মেয়েটা আমাকে খুব পছন্দ করতো, জানিস?" রাস্তায় হাটতে হাটতে বলল সান।
আবীর ঠিক কি যেন চিন্তা করছিলো,
" প্রিয়া কে? "
আবীরের মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছেনা। যত দিন যাচ্ছে কিছু অজানা তথ্য জানার ইচ্ছা এবং ভয় তার মাথার ভিতরে হাতুড়ির মত পেটাচ্ছে।
রাতের প্রকৃতির সৌন্দর্য তাকে আজ আর আকর্ষণ করছেনা।
প্রকৃতির কি ধরণের ত্রুটির কারণে সে মহাবিশ্বে প্রলয়ংকারী এক ক্ষমতা নিয়ে টিকে আছে তা তার জানা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তার বিভিন্ন স্থানে একই সময়ে উপস্থিতির ব্যাখ্যা কি??
ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। আইনস্টাইন বলেছেন, এই বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বোধ্য ব্যাপার হচ্ছে, এর সবকিছুই বোধগম্য।
আবীর তাই মহাবিশ্বের সকল রহস্যময় কণা নিয়ে পড়া শুরু করেছে। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে পড়ছে, পদার্থের সকল অবস্থা নিয়ে পড়ছে। ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার, ন্যাগেটিভ ম্যাটার, ন্যাগেটিভ মাস, সুপার নিউট্রিনো, কোয়ার্ক গ্লুয়োন প্লাজমা, জেনারেল ম্যাটার কত কি! কিন্তু কোন কূল কিনারা পায় না সে।
" প্রিয়া কে মানে?"
সানের কথায় আবারো বাস্তবে ফিরে এলো আবীর ,
"যার আত্মাটা ডাকতে যাচ্ছিস তার নাম জানিস না? পরে তো প্রিয়ার আত্মা ডাকতে গিয়ে ফরিদ স্যারের আত্মাটা ডেকে আনবিরে। পড়া বাদ দিয়ে আমাদের চক্রে বসে থাকতে দেখে ক্ষেপে গিয়ে- হাতে গোবর দলা পাকিয়ে আমাদের মুখের উপর মারা শুরু করবেন। কিংবা ছুটে এসে সবার টাকলায় এক খাবলা গোবর কচলে বসিয়ে দেবেন.. যাতে চারা গজাতে পারে! হে হে!"
আবীর কিছুই বলল না.. সে কিছু শুনেছে বলে মনে হয়না।
তার মাথায় এখনো ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের ব্যাপারটা ঘুরছে। একই বস্তু যদি হয় ম্যাটার এবং নিজেই এর অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে তৈরি, যেমন ধরা যাক 'মেজোরানা পার্টিকেল'* অথচ এরা হবে স্ট্যাবল, বিস্ফোরণ হবেনা। কি আশ্চর্য ব্যাপার!
চলতে চলতে ঠিক আধা ঘণ্টার মাথায় মোকতারের ফোন এলো আবীরের কাছে। মোকতার তাদের ক্লাসের পাগল গোছের কিন্তু অসাধারণ ম্যাথমেটিশিয়ান। নতুন নতুন ম্যাথ আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, শুধু পরীক্ষার খাতায় কিছুতেই উত্তর মেলাতে পারেনা।
" হ্যালো আবীর, তুই যে মেজোরানা পার্টিকেলের কথা বলছিলি কিছুক্ষণ আগে, আমি খোঁজ নিয়েছি রে। শোন, অ্যান্টি-ম্যাটার নিজেই মহাবিশ্বের রহস্যময় পদার্থগুলোর মধ্যে একটা, সেখানে 'মেজোরানা পার্টিকেল' তো আরো একশো গুন জটিল জিনিস। এর সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য জানা নেই কারো। "
" ও "
" তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হল, বিজ্ঞানীরা মাত্র 'মেজোরানা পার্টিকেল'এর উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন, থিউরি আবিষ্কারের প্রায় ৬০/৭০ বছর পর। অথচ আরো ৩০ বছর আগে একজন পাগল বিজ্ঞানী নাকি তার ল্যাবে নিজে ওই পদার্থ তৈরি করেছেন। "
আবীর প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে,
" কি বলছিস তুইইই? সেটা কিভাবে সম্ভব? যে জিনিসের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা কয়েকদিন আগে, সেটা কেউ ৩০ বছর আগে কিভাবে তৈরি করবে? আর এটা তৈরি করলে তো দুই চারটা নোবেল প্রাইজ হেসে খেলে পেয়ে যেত। এখনকার বিজ্ঞানীরা সেটা জানবে না কেন?"
" দোস্ত, আমি যতটুকু জেনেছি, সেই পাগল বিজ্ঞানী তার আবিষ্কার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা কালীন তার ল্যাবে বিস্ফোরণ হয়ে একটি নির্জন দ্বীপে মারা গিয়েছেন।
তিনি মৃত্যুর আগে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে বলেছিলেন, আপনারা হয়ত বিশ্বাস করবেননা, আমরা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব নতুন করে লিখতে চলেছি। এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে এই মহাবিশ্বে। এক যুগান্তকারী বস্তুর সৃষ্টি হবে, সৃষ্টি জগতে মানুষের অজানা কিছুই থাকবেনা আর। আমরা চাইলে সময়কে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি, স্কিপ করতে পারি, সময়কে চক্রে আবদ্ধ করতে পারি, নতুন করে সময়কে স্পেসের সাথে জোড়া দিতে পারি, আবার খুলে নিতে পারি। সময় আর স্থানকে আলাদাভাবেও ব্যাবহার করতে পারি। এমনকি আমরা এই মহাবিশ্ব ফুঁড়ে অন্য মহাবিশ্বে উঁকি দিতেও পারি। "
আবীর হতবুদ্ধের মত শুনে যায়! তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। এমনকি সে কল্পনাও করতে পারেনা সে আসলে কি শুনছে! মানুষের কল্পনার একটা মাত্রা থাকে। কিন্তু এর মাত্রা তার থেকেও অনেক উপরে। আবীর মৃদু নিঃশ্বাস ফেলল,
" কি নাম ছিল তার? "
" ডঃ এরিক কার্নেল। "
আবীর সারা দেহে যেন বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের কয়েক হাজার ভোল্টের একটা ঝটকা খেলো। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেলো। ডাঃ এরিক কার্নেল তার নিজের বাবা। এসবের কিছুই সে আগে জানতোনা। তার মাথায় তার বাবার নাম ছাড়া আর কোন স্মৃতি নেই। আবীর নিশ্চিত নয় তবুও তার মনে হয়, এই সবকিছুর সাথে তার এই নিজস্ব ক্ষমতা কোন না কোনভাবে জড়িত। আবীর উত্তেজনা সামলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" তারপর? "
" তারপর আর কি? যা হবার তাই হল!! লোকে তাকে তিরস্কার করেছে, পাগল বলেছে, গালিগালাজ করেছে, তার নির্বুদ্ধিতায় হাসাহাসি করেছে, পাথর ছুঁড়েছে, তিনি তার আবিষ্কার ও থিউরি বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলেন, কেউ শুনলো না। তিনি সৃষ্টি জগতের ফর্মুলাই নাকি বদলে দিতে চলেছেন, এমন গাঁজাখুরি গল্প কে বিশ্বাস করবে?
একদিন কাউকে কিছু না বলে এক এক নির্জন দ্বীপে চলে গিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেলেন। এরপর একদিন ল্যাবে বিস্ফোরণ হয়ে মারা গেলেন নিজের ল্যাবেই।
জেনেছি, তার কিছুদিন পর সেই পুরো দ্বীপটা পানির নীচে তলিয়ে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। তিনি তার আবিষ্কার নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন 'The Immortal Ghost Nature and the unseen crack of the Reality' কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার পাণ্ডুলিপিও জমা দেননি। "
আবীর এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। এক পাগল বিজ্ঞানীর কথা পৃথিবী বিশ্বাস করেনি। তার মৃত্যুতে হালকা সমবেদনা স্বরূপ পৃথিবীর মানুষ এটুকু তথ্য রেখে দিয়েছে এই যা। প্রকৃতি বিরুদ্ধ এ নীতি পৃথিবীর মানুষ অবিশ্বাস করলেও আবীর করতে পারবেনা কোনদিন। এই কারণে নয় যে, উনি তার বাবা। কিন্তু এই কারণে যে সে নিজেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য এক সত্যি।
আবীর খোলা ময়দানের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাড় কেঁপে কেঁপে ওঠে তবু তার শরীর ঘাম দিয়ে উঠতে চাইছে। বেশ কিছুটা দূর দিয়ে হেটে যাচ্ছে সান। তার পাশে আবীর নিজেও চুপ করে শুনে যাচ্ছে সানের কথা।
আবীরের অন্য সত্ত্বা সানকে সঙ্গ দিচ্ছে, সে কথা সান জানেনা। আবীর আর মোকতারের কথোপকথন সানের শোনার প্রয়োজন নেই। তাই সে আবীরের ভিন্ন সত্ত্বার সাথে হাঁটছে।
এও সান জানতে পারলোনা এই ৮/৯ মিনিটে আবীরের আরো ছত্রিশটি সত্ত্বাকে একের পর এক গাড়ি পিষ্ট করে দিয়ে গেছে।
প্রকৃতি বা এর বিরুদ্ধ কোন শক্তি তাকে এসব কিছু জানতে দিতে চায়নি। কিন্তু তবু আবীর টিকে রইলো, কি জানি কি কারণে কেউ তাকে অন্য কোথাও বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু মোকতার আর কতক্ষণ বেঁচে থাকবে তা আর নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবেনা।
continued to
৯- দুঃস্বপ্নের প্রথম প্রহর-(দ্বিতীয় পর্ব)
পরের পৃষ্ঠায়>>>>
.
.
.
.
.
.
.
*মেজোরানা পার্টিকেল- বিজ্ঞানী 'ইরোটি মেজোরানা' ১৯৩৭ সালে এই হাইপোথিসিস দাঁড় করেন। (নিউট্রনকেও এক ধরণের মেজোরানা পার্টিকেল মনে করেন কিছু বিজ্ঞানী, তাই এটি চার্জ শূন্য।)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro