৬. আঁখির মায়াজাল
মখমলের নরম বিছানার উপর শুয়ে আছে আঁখি। কাঁচের পুরু দেয়াল ভেদ করেও এক চিলতে আলো ঠিকই এসে পড়েছে আঁখির নরম গালের উপর খুব অলতো ভাবে।
তার গালে জমে থাকা কয়েক ফোঁটা অশ্রু যেন সূর্যের সে আলোতে ঝিকমিক করে জ্বলছে। আর সে আলোতে বিবর্ণ ঘরটিতেও এক রহস্যময় অদৃশ্য আলোর সঞ্চার হয়েছে।
আঁখির নিস্তেজ শরীরের উপরে এমনি করে আলোরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে খেলা করে। সে খবর হয়তো রাখেনি পড়ন্ত বিকেলের রাস্তার ধারের বাবলা গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের ছোট্ট জনসভা! অথবা ছোট্ট মরিচ গাছে পা এলিয়ে মহাসুখে বসে থাকা ছোট্ট পতঙ্গটিও।
রঙিন কাঁচের তৈরি সে দেয়াল বিকেলের মৃদু আলোকে ভিড়তে দিতে চায়না কিছুতেই। তবু কিভাবে যেন এক ছটা আলো এসে একবার আঁখির গাল স্পর্শ করে দিয়ে যায়। আর ঔ সামান্য একটু আলোই যেন আঁখির শুভ্র সুন্দর মুখটার উপর রাজ্যের সব মায়া কোথা থেকে এনে জড়ো করতে থাকে।
মাঝে মাঝে বাতাসে উড়ে আসা তার চুলগুলো যখন চোখের পাশ দিয়ে ঠোঁটের উপর এসে পড়ে তার অর্ধেক গাল ঢেকে দেয়, তখন বিকালের সে আলো হাজার চেষ্টা করেও তাদের খেলাঘর থেকে কিছুতেই সরিয়ে দিতে পারেনা সে চুল। এতে এই আলোদের মন খানিকটা খারাপ হয় বটে।
আঁখির ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আজ ভীষণ কেঁদেছে সে। তার এই মায়া ভরা মুখে কান্নার দাগগুলি যেন জীবন্ত হয়ে আছে। যেন কোন এক অদৃশ্য ফ্রেমে আটকা পড়ে রয়েছে অশ্রু বিন্দুগুলি। উড়ে যেতে পারছেনা কিছুতেই।
কেন যেন খুব বেমানান লাগে তার চোখে কান্নার দাগ। কতকাল পর যে সে কেঁদেছে তা আদৌ মনে করতে পারবেনা আঁখি। মনে করতে পারবেনা, আদৌ সে কোনদিন কাঁদতে শিখেছিল কিনা।
আঁখির বয়স যখন এক, যখন সে ঠিকমত কথা বলাই শিখেনি তখনি তার মা মারা যায়। মা কে মা বলে ডাকার আগেই তার মায়ের কাছে উপর ওয়ালার ডাক এসে গেলো।
মা মারা যাবার সময় আঁখি ঠিক তার মায়ের পাশেই বসে ছিলো। ছোট্ট আঁখি কিভাবে জানি বুঝে গিয়েছিলো তার মা চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে, না ফেরার দেশে। অনেক অনেক দূরের সে পথ... আর কোনদিনও হয়ত পাবেনা মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ। আঁখি সেদিন কাঁদেনি। কেবল জানালা দিয়ে বাহিরে কোথায় যেন তাকিয়ে ছিলো এক দৃষ্টিতে। কি জানি কি ছিলো তার ছোট্ট বুকটার ভিতরে লুকানো। কোথায় যেন জমে ছিল এক অব্যক্ত অভিমানের ঝড়।
আঁখির মা মারা যাবার পর তার বাবা আর বিয়ে করেনি। স্ত্রীকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তাকে ভুলে থাকার জন্য নিজেকে কাজের মধ্যে ভীষণভাবে বেঁধে ফেলেছিলেন।
এক সময় তিনি কাজের সাথে এতো বেশি জড়িয়ে পড়লেন যে বছরের দশ মাসই তাকে বিভিন্ন দেশে দেশে ছুটে বেড়াতে হয়। আঁখিকে তিনি মাঝে মাঝেই সঙ্গে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু সে কখনোই রাজি হয়না।
আঁখির মুখটা তার বাবাকে অনেক কষ্ট দেয়। আঁখিকে তিনি যতবার দেখেন, তার চোখ ছলছল করে ওঠে। আঁখি অবিকল তার মায়ের মত হয়েছে দেখতে। সে বাবাকে মায়ের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়ে একদম কষ্ট দিতে চায়না। বাবার জন্য তার ভীষণ মায়া হয় মাঝে মাঝে। এতো ছোট মেয়ে কিভাবে এতো কিছু বুঝতে পারতো কে জানে?
ছামিহা নামের একটা কাজের মেয়ে ছিল তাদের বাসায়। আঁখিকে খুব পছন্দ করত। সারাদিন তার সঙ্গেই খেলা করত, তার এতটুকু সমস্যা হতে দিতো না। আঁখিকে তার সাথে খুব আনন্দেই থাকতে দেখা যেত।
ছামিহা ছাড়াও বাড়িতে আরো তিনজন কর্মচারী ছিল। তারাও আঁখিকে অনেক ভালবাসত। তবে আঁখি কেবল ছামিহার সাথেই থাকতে পছন্দ করত।
ছামিহা আঁখিকে প্রায়ই সুন্দর করে সাজিয়ে দিতো। কিছুক্ষণ পর পর নতুন করে একটা ড্রেস পড়াতো, আর সারা বাড়ির সবাইকে ডেকে ডেকে বলতো,
"দেখছেন আফা মণিরে কিরকাম সুন্দর দেহা যায়! এমুন সুন্দর মাইয়া জীবনে দেখছেন? কোনোদিন দেখবেন? জন্মেও আরেকটা দেখবেননা।"
সারাদিনে একই কথা সে হাজার বার বলত। তবু কেউ তার কথায় বিরক্ত হতোনা বরং অবাক হয়ে এই ছোট্ট পরীর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সব কথাই মেনে নিতো। সত্যিই তো, এমন সুন্দর আরেকটা বাচ্চা তারা কোথায় দেখবে?
ছামিহা যখন আঁখিকে নিয়ে বাইরে যেত, সবাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। ছামিহার বয়সও খুব বেশি নয়, মাত্র তের। সে আঁখিকে সামলে রাখতে পারবে তো? যদি ভুলে হাত ছেড়ে দেয়, আর আঁখি যদি চলে যায় মাঝ রাস্তায়? আর যদি ট্রাক এসে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার ছোট্ট শরীর?
কিন্তু শুধু আঁখির মনে কোনো ভয় ছিলো না। ছামিহার সাথে যতক্ষণ থাকতো, ততক্ষণ তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে হত।
সেই ছামিহা যেদিন মারা যায়, সেদিনও আঁখি তার সামনেই বসা ছিলো। আঁখি কিছু মুড়ি নিয়ে প্লেটের উপর রাস্তা বানাচ্ছিল।
ছামিহা বটিতে পিয়াজ কাটতে কাটতে হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে মাটিতে শুয়ে গেলো। পেটে হাত দিয়ে ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে চোখ মুখ উল্টে দিল। তার কিছুক্ষণের মধ্যে দুবার রক্তবমি করল।
আঁখি বিস্ফোরিত চোখে ছামিহার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তার চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস আর ভয়। ছামিহা আঁখিকে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে দেখে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।
"আফামনি ভয় খায়েন্না, আমার কিছুই হয় নাই।"
কথাটা বলার পরপরই মুখ দিয়ে ফেনা উঠে, দুইবার ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেলো সে। আর একটিবারের জন্যেও নড়লোনা সে।
ছামিহার মৃত্যুর পর আঁখি একেবারে শান্ত আর গম্ভীর হয়ে গেলো। তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো একেবারে। ছামিহার মৃত্যুতেও আঁখি কাঁদেনি, তবে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙার পরও সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতো অনেক সময় ধরে।
তার মনে হতো, এই বুঝি ছামিহা এসে 'আফামনি' বলে ডাক দিবে তার ঘুম ভাঙাবার জন্যে। যদি সে চোখ না খুলে, তাহলে কাতুকুতু দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিবে। আর আঁখি খিলখিল করে হেসে কুটিকুটি হবে।
কিন্তু 'আফামনি'বলে ছামিহা তাকে আর কোনোদিনও ডাকেনি। কোনোদিন না!
এরপর ছয় বছর বয়স হলে বাবা তাকে একদিন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলে গিয়ে তার জীবনে সত্যিকারের একটা পরিবর্তন ঘটে গেলো। এটাই যেন তার পরিবার, তার নতুন পৃথিবী। চুপচাপ আঁখি আবারো চঞ্চল হয়ে উঠল। হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো।
ক্লাসের সব বাচ্চাদেরকে ঘোল খাইয়ে ছাড়তো, আবার তাদের সবাইকেই যেন সে একাই দেখে রাখতো পারতো। ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে, কুটিল সব শয়তানি বুদ্ধি দিয়েও।
পড়াশুনায় যে খুব ভালো ছিল তা নয়, কিন্তু কিভাবে যেন এস.এস.সি পরীক্ষায় একেবারে সাংঘাতিক ভালো রেজাল্ট করে ফেললো। বাবা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
মেয়েকে কি উপহার দেবেন, তাই ভেবে ভেবে অস্থির! গাড়ি দেয়ার কথা চিন্তা করে সাথে সাথে মন থেকে সরিয়ে দিলেন। আঁখি কখনোই তা নেবেনা। এতো এক্সপেন্সিভ জিনিস নিলে তার স্কুলের বন্ধুরা হঠাৎ আলাদা ভাবে দেখা শুরু করতে পারে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি ঠিক করলেন একটা অতিকায় বিরাট পাখি দেবেন। যেন তেন পাখি নয়, তিনি দেবেন একেবারে 'ভালচার'। মানে শকুন।
এমন উদ্ভট উপহার আনার কারণে মেয়ে খানিকটা চেঁচামেচি করতে পারে, কিন্তু তিনি জানেন, মেয়ে এটা কিছুদিন পরে ভীষণ পছন্দ করবে। কারণ এই কুৎসিত পাখিটা যখন ডানা মেলে ধরে, তখন তাকে এই পৃথিবীর সকল পাখির রাজা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর প্রাণী বলে মনে হয়।
মেয়ে যখন তার মেলে ধরা ডানা দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবে, সে কথা চিন্তা করে তার এখুনি চোখে পানি চলে আসছে। তিনি এও জানেন, কিছুদিনের মধ্যেই সে নিশ্চিত পাখিটা উড়িয়েও দেবে।
তবু, আঁখির দাবী সে নাকি পৃথিবীর তামাম প্রাণীকে পোষ মানাতে পারে। সব প্রাণী নাকি তার কথাও বুঝতে পারে। তিনি দেখতে চান, এই শকুনটিকে সে কিভাবে পোষ মানায়। কিভাবে এই শকুনটি তার কথার উত্তর দেয়। তিনি নিউইয়র্ক ও বাংলাদেশের যৌথভাবে অনুমতি নিয়ে লাইসেন্স করিয়ে নেন একটি ভালচার পোষার জন্য। কাজটা খুব সহজ ছিলনা। কিন্তু আহমেদ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ ও পৃথিবীর ৬১টি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক আঁখির বাবা, চল্লিশ হাজার কোটি টাকা যার সম্পদ তার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছুই নেই।
আঁখির বাবা আহমেদ রফিকের সে স্বপ্ন পূরণ হলোনা। নিউইয়র্ক থেকে আসার পথে ভুলভালভাবে ল্যান্ডিং হয়ে বিমান বিস্ফারণ হয়ে তিনি মারা গেলেন।
আঁখি একবার তার বাবার মৃতদেহ দেখবার সুযোগ পেয়েছিলো। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা বীভৎস শরীর। তার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না, এই শরীরটা তার প্রিয় বাবার। আঁখি অশ্রু শূন্য চোখে সে বীভৎস দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেনি সে। এই পৃথিবী তার সবই যদি কেড়ে নেবে, তাহলে তাকে কেন রেখে গেলো এখানে, তাকেও কেন নিয়ে যায়না?
আকাশের ঐ উঁচুতে জ্বল জ্বল করা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে সে যেন তার বাবা মাকে খুঁজে পায়, ঐ যে ঐ কালপুরুষের পুব দিকের নক্ষত্র দুটি, রাতের আকাশে সর্বদা প্রজ্বলিত ঐ নক্ষত্র দ্বয়ের পাশে একটুক খানি আশ্রয়ের জন্যে মুখিয়ে থাকতো সারাক্ষণ।
কিন্তু সে জানতোনা, সে কোনোদিন ঐ আকাশের তারা হতে পারবেনা।
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে ভাবতে থাকে, ড্রইংরুমে ঢুকেই হয়ত দেখবে তার বাবা সোফায় পা তুলে সিগারেট টানছে, আঁখিকে দেখা মাত্রই সিগারেট লুকিয়ে হেসে বলবে, " মা আঁখি- এলি তো?"
রান্নাঘর থেকে এই বুঝি মা উঁকি দিয়ে বলবে, " আঁখি এদিকে আয় তো মা, একটু নুডুলস খাইয়ে দেই?"
পৃথিবীতে কত অদ্ভুত ঘটনাই তো ঘটে, কত মিরাকল ঘটে, কত রহস্যময় ঘটনা ঘটে, তবে কেন তার জীবনে ঘটেনা? কেন সব আগের মত হয়ে যায়না? কেন একদিনের জন্যেও নয়?
আজ ক্লাসের শেষ বেঞ্চে একা একা বসেছিল সে। বেঞ্চে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল বহুক্ষণ। জীবনের সব কষ্টগুলি একসাথে দানা বেঁধে বুকের কোথায় জানি শূলের মত বিঁধে যাচ্ছিল তার। হৃদয় লক্ষ প্রশ্নের ঝড়ে অস্থিরন্তর। শুধু একটি কথার উত্তর জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে, কি নিয়ে বেঁচে থাকবে সে? কাকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে সে?
আঁখি চোখ বন্ধ করতেই আবীরের দেবদূতের মত মুখটা ভেসে আসে! আঁখি জোর করে সে চিন্তা মাথা থেকে মুছে ফেলতে চায়, আবীরের কথা কিছুতেই মনে আনতে চায়না। তার পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখতে মানা! যাকেই আপন মনে হয়েছে, সেই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কাউকে না জানিয়েই। এ পৃথিবী তার প্রতি নির্দয় হতে এতটুকু কৃপণতা করেনি কোনদিন! নিষ্ঠুরতার ডালিটা যেন উপুত করে ঢেলে দিয়েছে আঁখির জীবনে।
কিন্তু তবু আঁখির মনে হয় তার কল্পনার মধ্য দিয়েও আবীর কিভাবে যেন নিস্পলক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়তে চেষ্টা করে এসব কি হিজিবিজি লেখা মেয়েটার মনের মধ্যে? শীতের আগমনে জানালা দিয়ে হিরহির করে ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে ঘরের মধ্যে। একটি দুটি করে গাছের পাতারা ঝরে পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে একটু করে গাছের ডালপালাগুলি নড়ছে। বেজে উঠেছে বৃন্দাবনের বাঁশি। বদলে যাচ্ছে ঋতু, প্রকৃতি নতুন এক রূপ ধারণ করছে, কেবল ছোট্ট আঁখির জীবনটাই আগের মতই রয়ে গেছে।
আঁখির এলোমেলো চিন্তায় হঠাৎ বাঁধা পরে।
আঁখির মনে হল, তার ঘাড়ে কেউ হাত রেখেছে অলতোভাবে। আঁখি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চমকে উঠে। না তার ঘাড়ে কেউ হাত রাখেনি।
কিন্তু তার পাশেই বসে আছে আবীর, তার দিকেই তাকিয়ে...
আবীর কখন এসেছে একদম লক্ষ্য করেনি সে। সান, মিলনের সাথে প্রথম বেঞ্চে বসে ক্লাস করছিলো সে। আঁখি অপ্রস্তুতের মত হেসে আবীরের দিকে মুখ তুলে তাকালো। আহ্, মরণ। এভাবে কি কেউ তাকিয়ে থাকে?
আঁখি অস্বস্তিতে তাকাতে পারছিলো না আবীরের দিকে, যেন তাকালেই আবীরের কাছে তার হৃদয়ের সব গোপন কথাগুলি ধরা পড়ে যাবে।
আবীর চেয়েই রইল একমনে, সামনে বসে থাকা অদ্ভুত সুন্দর সেই মেয়েটির চোখের দিকে।
যে চোখের কাজলে নদীর ঘুরপাক খাওয়া কালো পানিতে হারিয়ে যাওয়া কত গল্পের মত অল্প অল্প করে ভেসে উঠে আছে একটি দুটি স্বপ্নের ডালপালা!
সে স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে ঢেউয়ের ধাক্কায় ছুটে চলে আবীর, ছুটে যাচ্ছে এর গভীরতায়! ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে আঁখির স্বপ্নের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সে, এক সীমাহীন অন্ধকারময় জগতের অভ্যন্তরে। আঁখির স্বপ্নের ভিতর দিয়ে আবীর যেন কোথাও পড়ে যেতে থাকে কোন গভীর অন্ধকার গর্তের মধ্য দিয়ে। তার সারা শরীর বেয়ে ঠাণ্ডা পানির স্রোত উঠতে থাকে উপরের দিকে। আবীর তলিয়ে যাচ্ছে তলহীন কোন পাতালের নিগুড় বিস্তৃত কোন জগতে। আবীর হাত বাড়িয়ে কিছু আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে কিছুই খুঁজে পায়না ধরার মত। আঁখির চোখের ভিতরে তলিয়ে যেতেই থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাও পড়ে যায়না সে। কত লক্ষ বছরের জমানো অশ্রু সে চোখের তারা বিন্দুতে জমে খাঁক হয়ে গিয়েছে, আবীর তা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারেনা।
কি বিষাদময় শূন্য এক জগতের দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। একফোঁটা আলোর জন্য বুক হাহাকার করে উঠে তার। কিছু আঁকড়ে ধরার জন্য পাগলের মত ছটফট করতে থাকে সে। কত হাজার বছরের জমানো শূন্যতার মাঝে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সে ধীরে ধীরে।
"আবীর? এই আবীর?"
আবীর তার চেতনায় ফিরে আসে। আবীর যেন এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে। মাঝে মাঝে আবীরের মনে হয় এ জগত তার পরিচিত জগত নয়। সব কিছু মায়া। সব কিছু মিথ্যা। এই নিখুঁত পৃথিবীর মাঝেও সূক্ষ্ম কৃত্রিমতা আছে যা কখনোই তার চোখ এড়ায় না!
যেমন আঁখি নামের এই মেয়েটি জানেনা, আবীর নামের ছেলেটি এখনো প্রথম বেঞ্চে বসেই আগের জায়গায় ক্লাস করছে। কিন্তু সে ভাবছে আবীর তার পাশে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, যেমনটা সে কল্পনা করেছে। কিন্তু আঁখি ভুল দেখছেনা। পিছনে ঘুরে একবার তাকালেই সবাই জেনে যেত এই প্রকৃতি কত বড় এক ত্রুটি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অসীমের দিকে, ছুটে যাচ্ছে শূন্য থেকে সৃষ্টি হওয়া আরেক সীমাহীন শূন্যতারই দিকে।
প্রকৃতি অনিয়ম সহ্য করেনা। অতীতে যারাই প্রকৃতির অসামঞ্জস্যতা ধরতে পেরেছে, তাদের স্মৃতি, প্রকৃতি ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করে আবার ত্রুটিমুক্ত হয়েছে। তবুও কোথায় যেন কিছু গণ্ডগোল হয়েছে যার জট প্রকৃতি কিছুতেই খুলতে পারছেনা। আর তাই আবীর দিব্যি টিকে থাকল প্রকৃতিরই মাঝে, সকল অসামঞ্জস্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
আবীর আঁখির আরো কাছে এগিয়ে গেলো, তার মুখটা তুলে ধরল উপরে, আঁখি চোখ বড় বড় করে তাকাল আবীরের দিকে, আবীর কি করতে চাইছে সে বুঝতে পারছেনা! এই মেয়েটা বড় দুখী, আর আবীরও।
আবীর জানে তারা দুজনেই দুজনকে ভালোবেসেছে। কিন্তু তার সন্দেহ হয়, যদি তাদের মিলনে একে অপরের শূন্যতা পূরণ না হয়? যদি দুটি হৃদয়ের শূন্যতা এক হয়ে আরো বড় কোন সীমাহীন শূন্যতার জন্ম দেয়?
শীতের প্রকট আরো বাড়তে শুরু করেছে, চারিদিক গাড় কুয়াশায় আবছা হয়ে আসছে। দূরের যত দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আঁখি জানতেও পারেনি কখন সে আবীরের মাঝে হারিয়ে গেছে। কুয়াশার সাদা চাদর চিড়েও পাখিদের মৃদু কিচিরমিচির কানে আসছে। আবীর আঁখিকে আঁকড়ে ধরে আছে বুকের মধ্যে। আঁখি বাঁধা দিতে পারছেনা, সে ক্ষমতা তার নেই।
আঁখি কাঁদছে। তার চোখের পানিতে কাজল ধুয়ে গালের উপর দিয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে দিক্বিদিক শূন্য হয়ে জলস্রোতের মত ছুটে চলেছে অজানার উদ্দেশ্যে। ঐ তো কুয়াশা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, সোনালী সূর্যটা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। আঁখির সেই চিরচেনা আলোর ছটা, তার ছোটবেলার খেলার সাথী, ক্ষণে ক্ষণে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে।
কেন দেবেনা? এ সময় যে আঁখির জীবনের ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকবে স্থির কোন সময়ের বদ্ধ ফ্রেমে!! :)
আঁখি শুধু মনে মনে স্রষ্টাকে এই দিনটির জন্য ধন্যবাদ দেয়, অন্তরের গহীন থেকে,
" তুমি স্রষ্টা সব সৃষ্টির, সব সৌন্দর্যের বৃষ্টির "
Continued to next part..
৭- কলেজে হাত ধোয়া দিবস উদযাপন
Go to next page>>>
& don't forget
to vote
:)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro