৫. আবীরের সময় ও অবস্থানের অনিশ্চয়তা
ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছে আবীর। শরীর বেশ ক্লান্ত লাগছে। তবে খুব যে খারাপ লাগছে তা অবশ্য না।
ক্লাসের পর আবীর সরাসরি কখনো বাসায় ফিরেনি। এটা তার অভ্যাস বলা যায়। বন জংগলের মাঝ দিয়ে যতদূর চোখ যায় সে পথ ধরে চলে যায় একা একা।
এই যাত্রা যে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক পথযাত্রা, সে ব্যাপারে আবীর সম্পূর্ণরূপে সুনিশ্চিত। সত্যি বলতে কি, ওর কোনো ধারণা নেই যে- যেই পথে হেটে যাচ্ছে সে পথ চিনে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা! ধারণা নেই এই জংগলে কোনো হিংস্র জন্তু শিকারের প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে কিনা!
পথে কোনো নদী পড়লে প্রায়ই একটা ডুব দিয়ে তারপর আবার হাটা শুরু করে দেয় সে। যদি কোন কারণে ঘরে ফিরে যাওয়া না হয়, কোন সমস্যা নেই, মাটিতে বিছিয়ে দিবে পাতার বিছানা তারপর এখানেই থেকে যাবে সে বাকি রাতটা।
উপরে আছে এক আকাশ সমান বিশাল কারুকার্যের ছাদ, ডিম লাইটের মত চাঁদটা আলো দিয়ে যাবে সারারাত। আর গাছপালাগুলি তার ডালপালাগুলিকে বিস্তৃত করে দেবে মাথার উপর, আর মৃদু নাড়া দিয়ে শীতল বায়ু ছড়িয়ে দেবে তার সারা গায়। একটি রাত কেন, সে তার পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে এভাবে।
মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে শুয়ে যখন সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই রাতে তার সাথে পুরো বনও যেন জেগে থাকে। আবীর ছোট ছোট গুল্ম লতাদের সাথে কথা বলে, কখনো কখনো ঘাসফড়িঙদের সাথেও দুটো একটা কথা হয়।
এ বনের শেষ প্রান্তে একটা সাগর আছে, সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকে সে। এই পৃথিবীতে সাগরের চেয়ে সুন্দর আর কি কিছু আছে! এ বনের কোনো এক কোণে একটা কুঁড়েঘর দেখেছিলো একবার। এখন আর খুঁজে পাচ্ছেনা।
অনেক রাতে যখন তার ঘুম ঘুম ভাব হয়, তখন একটি দুটি পাখি শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় অদ্ভুত শব্দে ডেকে ওঠে। সে শব্দে আবীরেরও মাঝে মাঝে হাসি পেয়ে যায়। পাখিগুলি ঘুম থেকে উঠে যেন হেঁড়ে গলায় গান গাওয়া ধরেছে, কাল যেন তাদের গানের ফাংশন আছে।
আবীর মিষ্টি করে হেসে আপন ভাবনার মাঝে হারিয়ে যায়, কখনো কখনো ইচ্ছে হলে শব্দের পিছনে শব্দ লাগিয়ে কিছু কাব্য ডায়েরীতে লিখে রাখে...
"এ বনের পাখিরা ভুলভাল সুরে গান গায়
বসন্ত পেরুলে তবে, ফুল ফোটে এ বারান্দায়"
*******************
আবীর বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছে। শরীর আগের চেয়ে আরো বেশি ক্লান্ত আর অবসাদগ্রস্ত লাগছে। বনের দিকে গিয়ে আর কাজ নেই আজকে। মেইন সড়ক ধরে ধরে এগুচ্ছে সে। মাথায় বিলি কেটে কেটে চুলগুলি এলোমেলো করে দিচ্ছিল।
হঠাৎ রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়ালো আবীর। কি জানি কি কারণে তার মুখ ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যেতে লাগল। খুব খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এখনি কিছু একটা হবে এখানে। কিছু মানুষ মারা যাবে।
আবীর বহু প্রাচীন এক বিশালাকার বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। দূরে মাঠের এক কোণে কিছু মেয়ে ডারিয়া বান্দা খেলছে। তার পাশে একটা দোকানে তের চৌদ্দ বছরের ছেলে এক হাতে চা খাচ্ছে আরেক হাতে বিড়ি ফুঁকছে। দূরে একটা কৃষাণ ধান কাটছে। আবীর কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়না।
আবীর কি ভেবে সামনের দিকে পা বাড়ানো মাত্রই মনে হল, কানের কাছ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে একটা ট্রাক ছুটে গেলো। আবীর চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকালো। সেখানে কিছুই দেখতে পেলোনা। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সামনে থেকে কিছু একটা সজোরে বাড়ি খাওয়ার শব্দ শোনা গেলো। আবীর সামনে ঘুরে তাকাল। সামনে ঘুরেও সে কিছুই দেখতে পেলোনা, শুধু একটা রিক্সা ছাড়া। রিক্সা চালক মনের আনন্দে শিষ দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে, তার পিছনে একজন প্যাসেঞ্জার বসা।
আবীর তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলোনা। এখুনি যেটা শুনল সেটা কি ছিল?
আবীর এক পা সামনের দিকে বাড়ানো মাত্রই তার কান সজাগ হয়ে উঠল। খুব হালকা ভাবে একটা ট্রাকের হর্ন শুনতে পেলো। সাথে সাথে পিছনে তাকিয়ে দেখল একটা ট্রাক বহুদূর থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে। আর একটু কাছে আসতেই বুঝে গেলো গাড়িটা ব্রেক ফেল করেছে। ড্রাইভার অনবরত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার হাত দিয়ে আবীরকে সরে যাওয়ার জন্য ইশারা করল।
আবীর সামান্য সরে গিয়ে সামনে তাকাল। তার সারা মুখ আতঙ্কে ছেয়ে গেলো। ঔ যে রিক্সাটা!! ঐ রিক্সাটাকে তো মেরে দেবে ট্রাকটা এখুনি! আবীর জানে ঐ রিক্সার মানুষগুলি নিশ্চিত মারা পড়বে, কিন্তু তার কিছুই করার নেই। আবীরের পেটের ভিতরে কি যেন পাক খেয়ে ওঠে।
সেই প্রকাণ্ড প্রাচীন বটগাছের সামনে দাঁড়িয়ে আবীর ছটফট করতে থাকে, ঐ তো ট্রাকটা ছুটে যাচ্ছে যম দূতের মত, তার হাতে আজ কারো মৃত্যু লেখা আছে। এক নিমিষেই মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে যাবে রিক্সাটাকে। আবীর যদি কোনোভাবে ট্রাকটার আগে ঐ রিক্সাটার কাছে পৌঁছে যেতে পারত, তাহলে হয়ত কিছু করা যেত। কিন্তু তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
প্রচণ্ড স্ট্রেসে আবীরের মাথা ভারি হয়ে যেতে থাকে, মাথায় ভীষণ চাপ পড়তে থাকে তার। চিৎকার করতে ইচ্ছা হচ্ছে আবীরের, চোখের সামনে কেমন যেন সব কিছু ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে লাল পর্দা নেমে আসতে চাইছে।
চোখ বন্ধ করে ফেলার আগে শেষবার তাকিয়ে দেখল সে, ঐ তো ট্রাকটা রিক্সাটার কাছে পৌঁছে গেছে। রিক্সাটাকে পাশ কেটে যাবার মত এক বিন্দু জায়গাও ছিলনা সেখানে।
চোখ বন্ধ করে ভীষণ জোড়ে আঘাতের শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো এভাবে, কোনো শব্দ হলোনা।
ট্রাকটা কি এক্সিডেন্ট করেনি তাহলে শেষ পর্যন্ত? কোন ভাবে পাশ কেটে চলে গেছে? এতো ছোট্ট জায়গায় তা কিভাবে সম্ভব?
নাকি এগুলি সব কিছুই ছিল তার মস্তিষ্কের উদভ্রান্ত কল্পনা, আসলে কিছুই হয়ত ঘটেনি এখানে! নাকি দুঃস্বপ্ন এটা? অনেক দীর্ঘ কোন দুঃস্বপ্ন?
চোখ মেললেই দেখবে হয়ত তার চিরচেনা বিছানার উপর শুয়ে আছে সে! জানালা দিয়ে হালকা সোনালী রোদ ঢুকে পড়ছে ঘরে। জানালার উপর রাতের রেখে দেয়া পাউরুটির টুকরাটা প্রতিদিনের অভ্যাস বসত কালো রঙের সে কাকটা ঠোকর মেরে মেরে খেয়ে যাচ্ছে!
আবীর চোখ বন্ধ রেখেই তার কল্পনায় কাকটাকে দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। ঐ তো জানালার উপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই দাঁড় কাকটা। কিন্তু কিছুই খাচ্ছেনা। আবীর হেটে যাচ্ছে কাকটার কাছে। কাকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই কাকটা হঠাৎ মাথা তুলে তাকালো। আবীর চিৎকার দিয়ে সরে গেলো পিছনে। এ তো অবিকল একটা মানুষের মত মুখ, যার কপালে একটা ছোট্ট কাটা দাগ!
আবীর তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকাল। চারপাশের সবকিছু একদম অন্য রকম। সে এখন কোথায় আছে বুঝতে বেশ অনেকক্ষন সময় লেগে গেলো। আবীর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলো এবং আবিষ্কার করল সে এখন সেই বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে নয়, সে পৌঁছে গেছে রিক্সাটার কাছে সেই ট্রাকের পৌঁছানোর আরো আগেই।
সেই ট্রাকটা এখন তার একদম সামনে। আবীরের পাশে সেই রিক্সাটা, রিক্সায় একজন প্যাসেঞ্জার আর সামনে ড্রাইভার। আবীরের কাছে প্যাসেঞ্জারকে পরিচিত মনে হল। ঠিক কোথায় দেখেছে তাকে?
ট্রাকটা তাদের দিকেই হর্ন বাজাতে বাজাতে ধেয়ে আসছে বিদ্যুতের বেগে।
এখানে সে কিভাবে এলো তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, আবীর চলন্ত রিক্সার একটা হ্যান্ডল ধরে এক হেঁচকা টান দিয়ে ঘুরিয়ে সেটাকে গড়িয়ে রাস্তা থেকে নীচের দিকে ঠেলে ফেলে দিল। এবং নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়ল রাস্তা থেকে একদম বাহিরে যতদূর সম্ভব।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড শব্দে কিছু একটা ফাটার মত আওয়াজ হল। আবীর মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ট্রাকটা ছুটে যাচ্ছে আগের বেগেই, যেভাবে তেড়ে আসছিল।
রিক্সাটা কাত হয়ে আছে ক্ষেতের উপর। রিক্সা ওয়ালার কনুই থেকে হালকা রক্ত ঝরছে। আবীরও সামান্য ব্যথা পেয়েছে হাঁটুতে। যাক অল্পের উপর দিয়ে পাড় পাওয়া গেছে। রিক্সা ওয়ালার সাথে চোখাচোখি হতেই আবীরের হঠাৎ মনে পড়ল, প্যাসেঞ্জারের কথা! সেই প্যাসেঞ্জার কই? সে ঠিক আছে তো?
মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, প্যাসেঞ্জার রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ট্রাকটা তার মাথাটা একেবারে পিষ্ট করে দিয়ে চলে গেছে।
আবীরের ধীরে ধীরে মনে পড়ল, সে যখন হ্যান্ডল ঘুরিয়ে রিক্সা নীচের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, ঠিক তখন ঐ প্যাসেঞ্জার ভয় পেয়ে বোকার মত রিক্সা থেকে রাস্তার উপর লাফ দিয়ে দিয়েছে। আর ট্রাকটা তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।
চারিদিক থেকে হট্টগোল শোনা যেতে লাগলো। লোকজন ছুটে আসতে লাগল ঘটনা স্থলে। আবীর উঠে এসে বিষণ্ণ মনে চলে আসতে লাগলো। প্যাসেঞ্জারটাকে বাঁচানো গেলনা। লোকটা রাস্তার মাঝে লাফ না দিয়ে, রাস্তার বাহিরের দিকে লাফ দিলে এ অবস্থা হত না।
সামনের বটগাছটার দিকে চোখ পড়তেই আবীর আঁতকে উঠলো। তার স্পষ্ট মনে হয়েছে বহুদূরের প্রাচীন সেই বটগাছের নীচে কেউ একজন দু হাতে মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।
এখন আর দেখা যাচ্ছেনা, মাত্রই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আবীরের শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। কারণ বটগাছের নীচে সে নিজেই দাঁড়িয়ে ছিল।
কাছে কোথাও থেকে কান্নার শব্দ আসছে। কে কাঁদে? আবীর পিছনে তাকিয়ে দেখে কিছু দূরে এক মরা বাবলা গাছের গুঁড়িতে বসে একজন মাঝ বয়সী যুবক কাঁদছে।
আবীর একটু সামনে যেতেই লোকটা মাথা তুলে তাকালো। আবীর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা, এ তো সেই প্যাসেঞ্জার! যে একটু আগে মারা গেছে। যার কপালে একটা বিশাল কাটা দাগ ছিল। যার মাথা একটু আগে একটা ট্রাক পিষ্ট করে দিয়ে গেছে। যার মৃত দেহ ঘিরে আট দশ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। যাকে সে চোখ বন্ধ রেখেও দেখতে পেয়েছিল তার কল্পনায়।
লোকটা আবীরের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,
" ভাইজান একটু এদিকে শুনে যান!" লোকটা নিজেই উঠে আবীরের এগিয়ে আসতে লাগল। আবীর প্রচণ্ড ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। লোকটা তার হাত বাড়িয়ে আরো এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে।
আবীরের মাথা ঘুরে উঠল। মাথায় আবারো সেই প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হল। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আবীর তবু জোড় করে ঠেলে তাকিয়ে থাকতে চাইছে। ঐ তো সেই মানুষটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। কি নিষ্ঠুর আর বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আবীরের দিকে। যেন তার মৃত্যুর জন্য আবীরই দায়ী। আবীর আর তাকিয়ে থাকতে পারলোনা।
ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল!
আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। সব কেমন যেন শান্ত হয়ে এলো। ধীরে ধীরে আবার চোখ মেলে তাকালো। সে এখন সেই বিশাল প্রাচীন বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে।
দূরে কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আবীর বাড়ির দিকে হাঁটছে। বাতাসে তার চুল এলোমেলো ভাবে উড়ছে, কিছু চুল মুখের সামনে এসে পড়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশে সন্ধ্যা তারা দেখা যাচ্ছে। আবীর হেটে যাচ্ছে তার নিজের ঠিকানায়। চুলের কারণে আবীরের চোখ আর দেখা যাচ্ছেনা।
_Go to next page... >>>>>>
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro