১৯. সরীসৃপ
আঁখি শূন্যের মাঝে ঝুলে আছে যেন অনন্তকাল ধরে। কোথাও কোনো সাড়া নেই, আশেপাশে কোথাও একবিন্দু শব্দ নেই। আলো নেই, অন্ধকার নেই। নেই কোনো কিছুর শুরু, নেই কোনো শেষ। হাত বাড়িয়ে কিছু স্পর্শ করতে পারেনা সে। দাঁড়াবার জন্য সামান্য একটু তল কিছুতেই খুঁজে পায়না সে।
" কেউ কি আছো? কেউ কি শুনতে পাচ্ছো আমাকে? একটিবার কি কেও জবাব দেবে? অনুগ্রহ কর আমায়, অথবা মেরে ফেলো আমায়। তবু একবার জবাব দাও! দোহাই তোমাদের! "
আঁখি চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গলা দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়না।
একটুখানি শব্দ শোনার জন্য তার হৃদয় খাঁ খাঁ করে। কতকাল সে কোনো শব্দ শুনেনি। শোনেনি কোলাহল কিংবা পাখির কিচিরমিচির। শোনেনি বাতাসের শব্দ, কিংবা শোনেনি কোনো কোকিলের কুহু ডাক। অথবা পায়না বাতাসে কোনো ফুলের গন্ধ, কিংবা উন্মুক্ত শহরের পেট্রল পোড়ার গন্ধ। আজ সবই যেন তার প্রিয় বলে মনে হয়।
আঁখি চোখ মেলে তাকায় তবু কিছুই দেখতে পায়না সে। না অন্ধকার না আলো- কিছুই বুঝতে পারেনা সে। মাঝেমাঝে একটু খানি আলোর জন্য হৃদয় তোলপাড় করতে থাকে তার। যেন একবিন্দু আলোর জন্য এই পৃথিবী বিসর্জন দিয়ে দিতে পারে। কখনো বা একটুখানি অন্ধকারের জন্য বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
এখানে নেই কোনো কিছুর শুরু, নেই কোনো কিছুর শেষ। নেই জন্ম, নেই মৃত্যু। নেই ক্ষুধা, নেই তৃষ্ণা। শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা। যে অপেক্ষার কোনো শেষ নেই। মহাকালের সময়ের পরিক্রমা যেন থেমে রয়েছে অনন্তকাল ধরে। অপেক্ষা ছাড়া যেন আর সবই অর্থহীন।
কিসের জন্য অপেক্ষা তাও জানা নেই। এখানে ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই, শুধুই জেগে থাকা। কিসের জন্য জেগে থাকা তা কেউ বলতে পারেনা। রাত নেই, দিন নেই। সূর্যোদয় নেই, সূর্যাস্ত নেই।
আঁখি চাইলেও কিছু চিন্তা করতে পারেনা। তার সকল চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। মনোযোগ আবদ্ধ করতে পারেনা সে কোনো কিছুর উপর। ঘুম, জাগরণ, কিংবা অচেতন কোনো কিছুই পার্থক্য করতে পারেনা তার অস্তিত্ব।
একবার নিজের কণ্ঠ শোনার জন্য তার জগত বিতৃষ্ণার সাগরে ডুবে যায়। নিজেকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য তার অন্দর বাহির দুমড়ে মুচড়ে যায়।
কতকাল আর কতকাল! দিনের পর দিন পেরিয়ে গেছে, তারপর যেন কত বছর পেরিয়ে গেছে, যুগ যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে। পেরিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তবু আঁখি বেঁচে রয়। মৃত্যু হয়না কিছুতে। আর শেষ হয়না এ প্রতীক্ষার প্রহর।
আঁখির নেই কোনো শরীর, নেই হাত, নেই পা মুখ বা অন্যকিছু। সে এখন কিছু চিন্তা করেনা, ধীরে ধীরে যখন তার চেতন কিংবা অবচেতন মন মরে যেতে শুরু করলো তখন-
একদিন হঠাৎ সবকিছুর পরিবর্তন আসে।
আঁখির অদ্ভুত যেন একটা ভোঁতা অনুভূতি হয়। তার মস্তিষ্ক বন্য শ্বাপদের মত সজাগ হয়ে ওঠে মুহূর্তেই।
তারপর সারা গগন কাঁপিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। যন্ত্রণা। কি ভীষণ যন্ত্রণা। তার অস্তিত্ব সে আর্তনাদের মাঝে বিলীন হয়ে যেতে চায়।
কষ্ট! ভীষণ কষ্ট। কোথায় সে কষ্টের উৎস তা সে জানেনা। যেন বহুদূর থেকে সে কষ্ট তাকে তাড়া করে একটু একটু করে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলছে। তার শরীর নেই, অঙ্গ নেই, তবু আছে এক সত্যিকার অনুভূতি। তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি। সে যন্ত্রণা এতো তীব্র, এতো ভয়াবহ, এতো বীভৎস- যে তার থেকে আঁখির কোনো মুক্তি নেই।
আঁখি চিৎকার করে ডাকতে থাকে সৃষ্টিকর্তাকে, তার সমগ্র সত্তা থেকে নিজের মৃত্যু কামনা করতে থাকে। কিন্তু সে যন্ত্রণা কে যেন মৃত্যুও ভয় পায়। তাই মৃত্যুও তার কাছে ভিড়তে পারেনা।
*** ***** ********* **** ***
এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে আবীরের। সারা শরীর বেয়ে ঘাম নেমে গেছে তার। মাথার ভিতরে বিপ বিপ করে এক ধরণের ব্যথা অনুভব করতে থাকে। যেন কোনো রগের ভিতর দিয়ে রক্ত প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, আর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার কোনো শিরা। সারারাত এক ফোঁটা ঘুম ছিলোনা তার চোখে। ভোরের দিকে চোখ লেগে আসা মাত্রই স্বপ্ন নেমে আসে চোখে...
স্বপ্নটা ছিলো আঁখিকে নিয়ে,
আবীরকে ঘিরে ঘুরছে আঁখি। তাকে কেন্দ্র করে অনেকটা বৃত্তের মত ভাসছে চারিদিকে। আঁখির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। নীল রঙ ছেয়ে গেছে তার তুষার শুভ্র মুখখানির উপর। তার বেদনার্ত নিষ্প্রাণ ঠোঁটে যেন ছেয়ে গেছে কোনো ঘোর অমানিশা।
আবীর বুকের ভেতরে যেন এক অদম্য অস্থিরতা ভিড় করে। সে সবকিছু ফেলে ছুটে যেতে চায় আঁখির কাছে। কিন্তু একটু এগিয়ে যাওয়া মাত্রই যেন আঁখি বাতাসে মিলিয়ে যায়। একটু দূরে আবার বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আবীর আবারো ছুটে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু বিন্দুর মত আবীরকে প্রদক্ষিণ করতে করতে আঁখি যেন বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়।
আবীর পাগলের মত ছুটতে থাকে মাঝ বিন্দু হয়ে। কিন্তু সে বিন্দু যেন শত কোটি বছরের পথে পাড়ি দিতে দিয়েও পরিধির গা ছুঁয়ে দিতে পারেনা।
আবীর ছুটতে ছুটতে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় আঁখির নিষ্প্রভ প্রায় চোখের পাতাগুলিকে। আবীরের সারা গাল বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্রুকণারা বৃষ্টির মত, যেন এক ফোয়ারা হয়ে ভাসিয়ে দেবে দিগন্ত। আবীর যেন আর একটিবার ছুঁয়ে দিতে চায় নিষ্প্রাণ প্রায় তার চির ভালোবাসাময় সে রমণীর কোমল পেলব শরীর।
আঁখির শরীর ভেসে ভেসে এগিয়ে যায় যেন শূন্য থেকে আরো গভীর কোনো শূন্যতার মাঝে। আবীর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে যায় দিক্বিদিক শূন্য এক পথহারা হরিণের মত।
আঁখি যেন তার প্রায় জ্যোতিহীন চোখে শেষ একটিবার তাকিয়ে দেখে আবীরকে। সে চোখে অশ্রুরা মুক্তার মত জ্বলছে ঝলমল করে। কত বেদনার্ত সে চোখ তবু যেন সে চোখে এক অস্ফুট হাসি শোভা পাচ্ছে আবীরের পানে চেয়ে। বেদনা মাখানো এক নীলাভ প্রশান্তির হাসি। এ জীবনে ভালোবাসা পেয়েছে সে। আবীরের ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েছে তার জীবন। এ জীবন ফুরিয়ে গেলেও তার না পাওয়ার কিছু নেই। তার চোখে কত কথা জমা আছে তা পড়তে কোনো অসুবিধা হয়না আবীরের।
আবীর তাকিয়ে আছে সে চোখের দিকে। সে চোখের বিদায় সম্ভাষণ সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা।
আঁখির দুটো ঠোঁট একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় তার ঠোঁটের উপর চুল এসে পড়ছে মাঝেমাঝে। তার চোখের কাজল ধুয়ে গালের ভাজে আটকা পড়েছে ক্ষণিকের জন্য। চোখের অশ্রু ধুয়ে জমা হচ্ছে তার গালের ছোট্ট টোলের মাঝে। যে টোলের উপর আবীরের ছিল যত অভিমান। আঁখির টোল পড়া সে হাসির দিকে তাকিয়ে সে কোনোদিন রাগ করে থাকতে পারেনা। এ অন্যায়। ভারি অন্যায়।
আঁখির ঠোঁট দুটি কাঁপছে। তার মুখে এখনো বেদনা মিশ্রিত সে হাসি উবে যায়নি এক বিন্দু। সে ঠোঁটে অস্পষ্ট কিছু একটা বলছে আঁখি।
অথচ একবিন্দু শব্দ উচ্চারিত হয়নি সে ঠোঁটে। তবু আবীরের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আঁখি তারই নাম ধরে ডেকেছে...
" আবীর!! "
আবীরের বুক ভেঙে ছারখার হয়ে যায় আঁখির কণ্ঠ একবার শোনার জন্য।
" আবীর "
আবীর বুভুক্ষের মত চেয়ে থাকে তার ঠোঁটের দিকে। অল্প অল্প করে কাঁপছে তার সে ঠোঁট, যেন ভীষণ কষ্টে জর্জরিত তার সমস্ত অধর।আবীর তাকিয়ে থাকতে পারেনা তার দিকে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার। যদি চিরদিনের জন্য থেমে যায় তার ঠোঁট দুটি?
আবীর আঁখির চোখের দিকে তাকিয়ে পড়তে পারে প্রতিটা শব্দ। আঁখির প্রতিটা পলক ঝাপটানোর মাঝে লেখা আছে যেন একটি একটি করে শব্দ।
" আবীর! "
আবীর তাকিয়ে আছে বেদনা বিধুর নয়নে।
" ভালোবাসি...
তোমায়!....
খুব....
খুব.... বেশি! "
আবীর ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেনা। কি করে তাকিয়ে থাকবে সে চোখের দিকে যে চোখ বিদায়ের অনুমতি চাইছে?
তবু ভীষণ ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে চোখের দিকে যে চোখ যে কোনো মুহূর্তে পৃথিবীর সব আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে...... আলতো করে।
কি করে মেনে নেবে তা আবীর?
............... .....
আবীর বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে তার ঘরে ফিরে এসে দেখে.... মোকতার তার জন্য অপেক্ষা করছে।
আবীরের রক্ত-লাল ফুলে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায় মোকতার। চেয়ার ছেড়ে উঠে আবীরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে...
আবীর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বিছানার পাশে রাখতে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলে,
" সরীসৃপ! আঁখির শরীরে সরীসৃপ ছেড়ে দিয়েছে ওমেগা। "
মোকতার যেন বুঝে উঠতে পারলোনা আবীর কি বলছে! চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আবীরের ইস্পাতের মত শক্ত চোয়ালের দিকে।
" তার শরীরের ভিতরে তারা বড় হচ্ছে! একটু একটু করে সবল হয়ে উঠছে আঁখিরই রক্ত মাংস খেয়ে!! "
মোকতার মুখ হা করে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো আবীরের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।
আবীর সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে ভীষণ কঠোর আর ভয়ংকর দেখাতে থাকে। আবীরের এমন কঠোর রূপ সে আগে কখনো দেখেনি। আবীর হাতে বিরাট একটা পাথর নিয়ে ছুটে আসে মোকতারের দিকে।
মোকতার যেই মাত্র ভয়ে চিৎকার দিতে যাবে ঠিক তখনই আবীর পাথরটা মোকতারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে,
" ভাঙ! ভাঙ আমার মস্তক। বের করে আন আমার মগজ। আমার হাতে এনে দে সেই মস্তিষ্ক। "
..... :)
Continued to next part
turn the page!
পাঠ- ২০
ওমেগার মুখোমুখি
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro