১৫. ওমেগা বনাম আবীর
আবীর টেবিলে এক পা এলিয়ে বসে বিরস মুখে কলমের ক্যাপ চিবুচ্ছে। মাঝে মাঝে টেবিলে টোকা দিচ্ছে। টেবিলের পাশে চেয়ারে বসা মোকতার। তার গা ঘাম দিয়ে উঠছে।
টেবিল চাপড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায় সে,
" তুই কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস যে তুই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সময় পরিচারিকা ঘড়ি নিজের চোখে দেখে এসেছিস? একদম নিজের চোখে? যার সময়কে কেন্দ্র করে সারা মহাবিশ্ব চলছে?"
- উত্তেজনায় প্রায় শ্বাস রোধ হয়ে যাচ্ছে তার। সবকিছু একেবারে বাড়াবাড়ি রকমের অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে!
আবীর কলমের টোকা দেওয়া বন্ধ করে একবার মোকতারের দিকে তাকালো, তারপর উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো..
" ঘড়ি? হ্যাঁ! অনেকটা সেরকমই রে। "
" তার পরও তুই এরকম শান্ত হয়ে বসে আছিস এখানে? কেমন করে!!!"
আবীর জানালা দিয়ে দৃষ্টি যতদূর সম্ভব প্রসারিত করে তাকিয়ে আছে।
" নাহ! শান্ত ঠিক না রে! অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। খুব মন খারাপ লাগছে। আজ আমি প্রথম আমার মা'র কথা জেনেছি। মার ভালোবাসার জন্য বুকটা এক অসহায় শূন্যতায় ভরে গেছে! বুকের কোন জায়গাটায় জানি এক বিশাল গর্ত হয়ে গেছে রে। "
আবীর মেঘের মাঝে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া ঊর্ধ্বগামী পাখিদের ছোট্ট দলটির দিকে তাকিয়ে আছে। কত শূন্যতার পাথেয় এই মহাযাত্রা, কত শূন্যতার আস্তরণে বাঁধা এই অস্পষ্ট পরিক্রমা। তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলো আবীর।
মোকতার কাছে এসে ঘাড়ে হাত রাখলো আবীরের।
" আবীর! কি করবি তাহলে এখন! "
আবীর ঘুরে তাকায় তার দিকে। তার চোখ শান্ত, কিন্তু কঠিন।
" আমাদের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে ওমেগা। সেই অদৃশ্য শক্তি। ইম-মোর্টাল ন্যাচার। খুব শীঘ্রই আমাদের উপর আরো বড় আক্রমণ করবে। বারবার বেঁচে গিয়েছি অদৃষ্টের জোড়ে। কিন্তু তাকে প্রতিহত করতে আমাদেরকেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এবার আমরাও প্রস্তুত থাকবো। "
মোকতার অস্থির হয়ে ওঠে,
" আবীর! মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধ হয়। মানুষের সাথে প্রকৃতির যুদ্ধ হয়না, অদৃশ্য শক্তির সাথে যুদ্ধ হয়না। যাকে দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না, ধরা যায়না, যাকে অনুভব করার আগেই সে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ-এ ফুঁড়ে চলে পারে এক মুহূর্তেই, তার সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয় আবীর। "
মোকতার একটু থেমে আবার যোগ করলো,
" তুই-ই তো বলেছিস, তার কিছু অংশ অতীত ফুঁড়ে চলে গেছে মহাবিশ্বের একদম প্রারম্ভের দিকে, নিউক্লিয়ার ফিসনের মত আরেকটা চলে গেছে সীমাহীন অসীম ভবিষ্যৎ এর দিকে। সে এক চলমান ওয়ার্ম হোল। এক অদম্য অশরীরী।
তুই কি বুঝতে পারছিস না ডঃ কার্নেল স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, সে চলমান টাইম ফ্রেমের মত গতিময়। সে সবসময় ছিলো, আছে এবং সবসময় থাকবে? "
আবীর অন্যমনস্ক হয়ে বলল, " মনে আছে, ভালো করেই মনে আছে! তার কোনো সৃষ্টি নেই, তার ধ্বংস নেই। "
"সৃষ্টি নেই, ব্যাপারটা বুঝি নি!"
"এক সময় তার সৃষ্টি হয়েছিলো, কিন্তু যেহেতু তার একটি স্বত্বা অতীত ফুঁড়ে চলে গিয়েছে, তাই সে তার সৃষ্টি হওয়ার সময়ের আগেও উপস্থিত ছিলো। তাই তার কোনো এক সময় সৃষ্টি হয়েছিলো সত্যি, কিন্তু এখন তার সৃষ্টি বা মৃত্যু নেই। "
কয়েক মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না।
আবীর আবার শুরু করলো, " তবু সে এক স্রষ্টার সৃষ্টি মাত্র। সৃষ্টিকর্তা নয়। সৃষ্টি হয়ই একদিন ধ্বংস হওয়ার জন্য। তার ধ্বংসও নিশ্চয়ই হবে। "
মোকতার অবাক হয়ে আবীরের দিকে তাকায়, " কিন্তু কিভাবে? বল কিভাবে সেটা সম্ভব? "
আবীরের চোখ চকচক করে ওঠে,
" প্লুটোনিয়াম-২৩৯ এর সমপরিমাণ এন্টি পার্টিকেল তৈরি করে, যদি পরিমাণমত এন্টি পার্টিকেলের ট্র্যাপ তৈরি করে তাকে সেখানে আটকানো যায়, তবে এই দুই বিপরীত পদার্থের কলিশানে উভয়েই ধ্বংস হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে চিরতরে এই মহাবিশ্ব থেকে। জানিস তো? ভবিষ্যৎ বদলায়। "
মোকতার তাতে ভরসা পায়না। " কিন্তু কিভাবে তুই বানাবি এন্টি ম্যাটার? তুই জানিস? এন্টিপার্টিকেল সংরক্ষণ করা কত বিপদজনক? মাত্র এক গ্রাম এন্টি ম্যাটার তৈরি করতে সারা পৃথিবীর সমস্ত অর্থ লেগে যাবে। প্রায় ৬৫ হাজার লক্ষ-কোটি টাকা। আর এক গ্রামে কিছুই হবেনা। আমাদের প্রচুর শক্তিরও দরকার।"
আবীর মৃদু হেসে উত্তর দেয়, " ডার্ক এনার্জি হবে সব শক্তির উৎস। । যে এনার্জি এই মহাবিশ্বকে টেনে লম্বা করে ফেলতে পারে বিলিয়ন বছর ধরে, সে এনার্জির কাছে এটা ছেলে খেলা। সে এনার্জির সন্ধান বাবা দিয়েছেন। তুই ওটা আমার উপর ছেড়ে দে। "
মোকতার কাছে এসে আবীরের ঘাড়ে আবারো হাত রাখে। " কোথায় বানাবি সে এন্টিম্যাটার ট্র্যাপ? যে কাজ তোর বাবা করতে পারেনি এতো বড় বিজ্ঞানী হয়ে। সে কাজ তুই কিভাবে করবি বলতো! "
" আমার শত কোটি প্রতিলিপির সাহায্যে। সবার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে। এই মুহূর্তে তারা সকল প্যারালাল ইউনিভার্সে ছড়িয়ে আছে। পৃথিবী ও পৃথিবী সমূহের সকল লাইব্রেরীতে বসে বিজ্ঞানের সকল গ্রন্থ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করছে এক সাথে। বানাবো সেই চিরচেনা দ্বীপে। "
" কিন্তু তাও প্রতিলিপি তো তোর বাবার ও ছিল। তবুও তিনি পারেননি। "
আবীরের চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে,
" তিনি তার সব প্রতিলিপি আলাদাভাবে ব্যাবহার করেছেন। আমি করবো সব একসাথে, সামগ্রিকভাবে। "
মোকতার চমকে ওঠে আবীরের কথায়, " মানে? "
আবীর উন্মাদের মত হাসতে থাকে, " আমার সব প্রতিলিপির ব্রেনকে একটি ব্রেনে জুড়ে দেবো। এক মহা শক্তিধর সম্মিলিত প্রাণীর মত কাজ করবো আমরা। "
মোকতার হতবাক হয়ে যায়! প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, " তুই কি বলতে চাইছিস আবীর? "
আবীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, " টেলি-ইলেক্ট্রোড-মাল্টি-মাইন্ড-কানেক্টর!
আমাদের দরকার বিশাল বুদ্ধিমত্তা। যে এই সবগুলি ক্যালকুলেশন করে বিশ্লেষণ করে হাজার বছরের হাজার বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যৎ এর ট্যাকনোলোজি বের করে ফেলতে পারবে এক নিমিষে। আমাদের, অর্থাৎ সব আবীরের মাথার খুলি ফাটিয়ে মস্তিষ্ক বের করে একত্রে এক সিন্যাপ্স সংযোগে এক বিশাল মস্তিষ্ক গঠন করা হবে। কোটি কোটি মস্তিষ্কের সেই বিশালাকার বুদ্ধিমত্তা একত্রে একটি প্রাণীর মত কাজ করবে, তার ভাণ্ডারের সমগ্র শক্তি হবে অপরিমেয়। অতুলনীয়। অবর্ণনীয়। বর্ণনাতীত।
এক মহাসমুদ্রের লবণ পানিতে বসানো হবে সেই অতিকায় বিশাল মস্তিষ্কের সিন্যাপ্স সংযোগ। ইলেকট্রিক্যাল ম্যাগনেটিক সিগনালের সংযোগে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সে সমুদ্রের তরঙ্গে মৃদু দোল খেতে খেতে ভাসতে থাকবে সেই কোটি কোটি মগজের সমন্বয়ে এক সুবিশাল নিউরন সংযোগ। তুই সে সময় আমার পাশে থাকবি তো মোকতার? "
মোকতারের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়, চোখ থেকে হালকা হলুদ আলো বিচ্ছুরিত হয় " তুই কি মনে করিস ওমেগা তোকে তা করতে দেবে? তোকে ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবে? "
আবীর হালকা টলতে থাকে, কোনো অজ্ঞাত কারণে তার মাথার ভিতরের রগ দপদপ করতে থাকে। চোখ বন্ধ করে বলতে থাকে সে, " অসংখ্যবার মারার চেষ্টা করেছে, লাভ নাই। ও যখন এক স্থানে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে, তখন আমি অলরেডি অন্য অসংখ্য স্থানে পৌঁছে গিয়েছি। "
আবীর মাথা ঘুরে পড়ে যেতে চায়। কিন্তু মোকতার তাৎক্ষণিক তাকে ধরে পাশের বিছানায় শুইয়ে দেয়। বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমের কোলে ঢলে যায় আবীর। অনেক ক্লান্ত সে। তার ঘুমের প্রয়োজন। মোকতার বিছানার চাদর টেনে দিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো।
তারপর....
তারপর মোকতার ঝড়ের মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। অসংখ্য জোনাকের ঝাঁকের মত ঝিকমিক করতে করতে
আকাশের দিকে ছুটে গেলো সে।
মোকতারের পক্ষে যা কখনোই সম্ভব নয়। সম্ভব কেবল....... ওমেগার!!
Next part revealed,
turn the page to next... :)
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro