0
কাল অামার ছেলে তপুর জন্মদিন! বাবা ছেলের জেদ, একই রকম পোশাক পড়বে। তপুর নীল পাঞ্জাবি রেডী। অামি শিহাবের নীল পাঞ্জাবি খুঁজতে ও'র অালমারি খুললাম। শিহাবের অালমারী খুললে, অামার খুব শাই ফিল হয়, বেচারা ছেলেমানুষ হয়েই কি গোছানো সব! শার্টের তাঁকে শার্ট, প্যান্টের তাঁকে প্যান্ট, পাঞ্জাবির জন্য অালাদা তাকঁ।
এমনকি পারফিউম গুলোও লাইন করে রাখা।
এই তো ও'র নীল পাঞ্জাবি! এই পাঞ্জাবিটা শিহাব অবশ্য একদিন ও পড়েনি। এত সুন্দর পাঞ্জাবি, কেনো পড়েনি কে জানে?? বিয়ের অনেক বছর পর নীপা যখন শিহাবকে প্রথম দুলাভাই ডেকে মুখ দেখলো, তখনই পাঞ্জাবিটা দেয়।
ইশ কি সুন্দর পাঞ্জাবি! এবার অন্তত তপুর জন্মদিনে পড়া তো হচ্ছে।
এতবছর পর নীপাটা অাসছে, সেও নিশ্চয়ই এটা দেখে চমকে যাবে....!
পাঞ্জাবিটা খুলেতেই নীল একটা প্যাকেট....
অারে এটা কি??
পাঞ্জাবির সাথে মিলিয়ে প্যাকেট! নীপাটা যে কত সারপ্রাইজ দেয়!
প্যাকেটটা খুলতেই অামার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো,
নীপার ছবি! চশমা চোখে নীপা টেবিলের উপর কনুই রেখে দুগালে হাত দিয়ে
দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে আছে! ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন ছবি?? এত অাগের???
ছবির উল্টোপিঠে লিখা,
"ভালো ও খারাপ সময়ে অামার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে বলেছিলেন। অামার ইচ্ছে অাপনি নিজের হৃদয় বিসর্জন দিয়ে পূরণ করেছেন, তাই অাপনার ইচ্ছে ও পূরণ করে দিলাম।নিন এবার যখন ইচ্ছে তখন মুখ দেখুন "
সাথে
এগুলো কি???
চিঠি??
শিহাবের লিখা... নীপার ও লিখা??
অামি এক নিঃশ্বাসে চিঠি খুলে বসলাম।
তারপর যা হলো...
অামার শরীর থেমে গেলো। হাত-পা জমে গেলো,
বসা থেকে উঠে দাঁড়াবার সাধ্যি যেনো অামার ছিলোনা।
⏰⏰⏰
সেই অাট বছর অাগে, এক বিকেলে শিহাবের এক দুসম্পর্কের ফুফা এসে বাবার হাত ধরে কেঁদে বলেছিলেন, ----অাপনার মেয়েকে অামার বোনপোর জন্য চাই।
বাবা-মা মরা দুঃখ দুর্দশায় একা বড় হওয়া ছেলেটা, জীবনে নিজের জন্য কিছু চায়নি। এই প্রথম নিজের জন্য কিছু পছন্দ করে চেয়েছে।
যদি অাপনার মর্জি হয়??
পাত্র অাবার অামার একমাত্র ছোটবোন নীপার ইউনিভার্সিটির টিচার। বাবা ঘাবড়ে গিয়ে কি বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না।এত ভালো পাত্র,তাও এমন পছন্দ করে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, কি করা যায়??
অামি তখন এমবিবিএস ফোর্থ ইয়ারে পড়ছি।বিয়ের প্রশ্নই অাসে না।
তাও শিহাবের ছবিটা দেখিয়ে বাবা অামায় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-------দেখতো....ছেলেটাকে.... কি যে বলি?? নীপার টিচার তো??ছেলেটা নাকি তোকে ভীষণ পছন্দ করেই.......?
তুই কি চিনিস???
অামি ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছবিটা হাতে নিলাম।
লেমন ইয়েলোর মাঝে ওয়াটার ওয়েভের শার্ট পড়া ভীষণ মন খারাপ করা অার বড় বড় চোখের শিহাবের ছবিটা দেখে অামার তক্ষুনি পছন্দ হয়ে গেলো। সেদিন সারাসন্ধ্যা অামি শিহাবের ছবি হাতে বসেছিলাম।
নীপা ফিরে যখন অামায় এমন মোহাবিষ্ট অবস্থায় দেখলো, সেও তাজ্জব বনে গিয়েছিল।
বারবার করে বলল,
-------ছবি দেখেই জমে গেলি অাপা?? যাবি নাকি কাল একবার ইউনিভার্সিটিতে?? সরাসরি দেখা করে অাসবি??
অামি ঠান্ডা গলায় বলেছিলাম,
------অার দেখার দরকার নেই অামার।
একেই বিয়ে করবো অামি.....
সে নাকি অামায় পছন্দ করেই....
তারপর অার কি??
সব স্বপ্নের মত ঘটছিলো। শুধু অামার বিয়ের অাগে অাগে নীপা ভারতে চলে গেলো, ওখানের ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে সে! পুরো একটা বছর ড্রপ দিয়ে চলে গেলো।
ব্যস, বিয়েতেও সে নেই।
তারপর অার সেই ফিরলো, তপু হবার পরে!
নীপার
এত কিছুর এই মানে ছিলো??
শিহাব অার নীপার মোট সাতটা চিঠি। শিহাবের দুটো। নীপার পাঁচটা।
চিঠিগুলোর জিস্ট বলছে, শিহাব নীপাকে ইউনিভার্সিটিতেই প্রথম দেখে; সেখানেই পছন্দ!মূলত নীপার জন্যই শিহাব আমাদের বাড়িতে প্রপোজালটা পাঠায়।নীপার দিক থেকে পজিটিভ সাইন পেয়েই, সে এই কাজটা করে, নীপাকে সারপ্রাইজ করতে। কিন্তু কে জানতো?? শিহাবের জন্যই বিশাল সারপ্রাইজ ওয়েট করছিলো সেইদিন । শিহাব জানতো না যে, নীপার বড় বোন ছিল!
অার নীপা??প্রপোজালের পর সে কি বলেছিলো?? অামায় যদি সত্যিই পছন্দ করে থাকেন, অামার বড়বোনকে অসম্মান করতে পারবেন না। অামার অাপা পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার মেয়ে! অাপনি তাঁর সাথে দারুণ কাটাবেন।
জোড়া যে সত্যি সত্যিই সৃষ্টিকর্তা বেঁধে দেয়, এবার বিশ্বাস হলো তো???
শিহাব তাহলে নীপাকে পছন্দ করার পরীক্ষাটা দিতে অামায় বিয়ে করেছে?? অথচ এই এতটা বছরে অামি একবার ও টের পাইনি! অামার প্রতি তাঁর যত্ন, মনোযোগ, দায়িত্ব সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
বুঝতেই দেয়নি ভেতরে ভেতরে কি চূড়ান্ত ব্যাথা সে বয়ে বেড়াচ্ছে! অার নীপাটা?? সে তো বিয়েই করলো না! বিয়ের কথা বললেই, চোখ কুঁচকে তাঁকিয়ে বলবে,
-----বুঝলি অাপা, বিয়েটা হলো অদৃশ্য শেকল। অদৃশ্য হোক অার দৃশ্যমান হোক! শেকল পড়ার দরকারটা কি??
⏰⏰⏰
চিঠিগুলো হাতে অামি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিলাম।
পাশের ঘর থেকে
শিহাব ডাকলো,
--------রূপা এসোতো, তোমার প্রিয় মুভিটা দিচ্ছে। শাহরুখ ভাই প্রীতিকে.......
অামি চট করে সব গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
শিহাব ততক্ষণে চলে এসেছে,
--------উফ রূপা! তুমি কেনো অাবার পাঞ্জাবি খুঁজতে এলে?? অামিই তো খুঁজতাম। সারাদিন কাজ করে তোমার বাসায় ফিরে এত কাজ করতে কি করে যে ভালো লাগে???
শিহাব কাছে এসে দাঁড়ালো অামার, কাঁধে হাত রেখে মিষ্টি হেসে বলল,
--------এসোনা রূপা, চিকেন ফ্রাই রেডী তো.....
---------যাও... অাসছি।
---------দু'মিনিটের মাঝে অাসবে, এমনিতেই রাত দশটা বেজে গেছে, সকালে তোমার ওটি অাছে না অাবার??
শিহাব হেসে অামার মাথায় টোকা মেরে চলে গেলো।
অামার ভেতর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো। এই মানুষটা তাঁর ভালো খারাপ সময়ে নীপাকে চেয়েছিলো। শীতের রাতে, বৃষ্টির দিনে, কুয়াশার সকালে, রোদপড়া বিকেলে সে অন্য কাউকে ছুঁতে চেয়েছিলো।
অামি নই সেটা।
সেটা অন্যজন!
অথচ কি অাশ্চর্যরকম মনের জোর তাঁর। প্রতিটা মুহূর্তে অামায় নিগূঢ় ভালোবাসায় অাগলে রেখেছে। অামার পছন্দমত হানিমুন হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, ফ্যামিলি প্লানিং হয়েছে, বছর ঘুরে অামরা যে একবার ফ্যামিলি ট্রিপে যাই সেটাও অামার পছন্দে ঠিক করা হয়! নিজের জন্য কখনো কিচ্ছু চায়নি। এমনকি অামার প্রতিটি খারাপ সময়ে সে ঢাল হয়ে সব সামলেছে! এই মানুষটা.....
এই মানুষটা নিজে ভালো নেই, তাহলে। ছিলোনা ও বোধহয়??
অথচ অামি একদিন ও জানতে চাইনি, সে ভালো অাছে কিনা??শুধুমাত্র একজনকে ভালোবাসার অপরাধে এরকম তীব্র শাস্তি কি এমন হাসি মুখে সহ্য করা যায়?? সম্ভব??
শিহাব চিকেন ফ্রাই প্লেটে করে এবার এঘরে চলে এসেছে,
--------রূপা তুমি এতো দেড়ী করছো যে? চিকেন ফ্রাই ঠান্ডা হয়ে গেছে দেখো....
তপুও সাথে সাথে বলল,
---------সত্যি মা... ডান্ডা হয়ে গেছে.... ডেখো..... ডেখো....
অামি হাঁ করলাম,
--------হাতে নোংরা অামার। তুমি খাইয়ে দেও তো......
বাবা-ছেলে দুজনে মিলে অামার মুখে ইচ্ছেমত চিকেন ফ্রাই ডেসে দিলো!
অামি দু-গাল ফুলিয়ে চাবাতে লাগলাম।
------মাকে রাক্ষস ডেখাচ্ছে! কি মজা! কি মজা! (তপু দ'' বলতে পারে না)
তপু হাততালি দিচ্ছে। শিহাব শব্দ করে হাসছে......
হাসলে শিহাবের ভ্রু কাঁপে! কি যে মিষ্টি লাগছে দেখতে তাঁকে.....
রাতে ঘুমোবার সময় শিহাব অালতো করে অামার গায়ে হাত রেখে পাশ ফিরলো।অামি কেঁপে উঠলাম,
নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হেসে গলায় বললাম,
--------কেমন অাছো শিহাব??
শিহাব অারেকটু গাঢ় করে কাছে টানলো অামায়,
--------ভালো নেই গো, ডাক্তার, অামি একদম ভালো নেই....হার্টটা অপারেশন করে দেওনা একবার.....
তারপর খানিকক্ষণ সে চুপ! ঘুম এসে গেছে তাঁর..... দুনিয়া ভেঙে কান্না পাচ্ছে তখন অামার।
অাস্তে করে বললাম,
--------অাচ্ছা, শিহাব তোমার বিশেষ সময়গুলোতে, ধরো সাফল্যের সময়ে, অাবার ধরো টেনশানের সময়গুলোতে কি দেখলে তোমার ভালো লাগে??কিসের দিকে তাঁকালে তুমি নিশ্চিন্ত হও!
শিহাব চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
---------এটা কি ধরনের প্রশ্ন রূপা???
-------অারে ধরো বিশেষ কারো মুখ?? যার মুখ দেখলে তুমি সাহস পাও, অানন্দে তাঁর মুখ দেখলে তোমার সেলিব্রেশন হয়... এমন কিছু??
--------এই তো, দেখি তো..... অামি তোমার মুখ দেখি। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে অামি তো তোমাকেই দেখি রূপা!
শিহাব এবার চিৎ হয়ে বিছানায় শুলো!
--------এটা তো বিয়ের পরে শিহাব ; বিয়ের অাগে?? ধরো তোমার জন্য লাকি ফেইস! এই যেমন, হয়না..?;ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যখন তুমি সেই মুখটা দেখলে, তোমার হৃদয় শীতল হয়ে গেলো......
-------ধুর ; এরকম অাবার হয় নাকি??
তুমি যে, মাঝে মাঝে কি অদ্ভুত কথা বলো না রূপা!
তপু
অাবার শিহাবের পেটের উপর পা তুলে দিয়েছে। শিহাব পা টা সরালো না।
রুমের অাবছা অালোতে অামি স্পষ্ট দেখলাম, শিহাব অসহায় অার ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে সিলিং এর দিকে তাঁকিয়ে অাছে.... সে নিশ্চয়ই এখন নীপার মুখটাই ভাবছে???
অামার খুব রাগ হচ্ছিলো তখন ভালোবাসা নামক বস্তুটার উপর! হৃদয় কাটাছেঁড়া করে ব্যাথা দিতেই এর জন্ম বোধহয়!
অামি মনপ্রাণের সমস্ত কাতরতা দিয়ে ব্যাকুল হয়ে বললাম,
"ভালো থাকো শিহাব, প্লিজ ভালো থাকো......
অামি খুব ভালোবাসি তোমাকে!
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen247.Pro